বয়স যখন ৮৫ তখন আর বিছানা-বালিশের দরকার নাই। আলো-আঁধার শুরু থেকেই অস্পষ্ট। বাড়ির যেসব জিনিস ফেলে-দিই ফেলে-দিই করে ফেলে দেওয়া হয় না, পচে যাওয়া, ধসে যাওয়া, হাড়ির মধ্যে পোড়া, বস্তার মধ্যে ঢোকানো — সেইখানেই জায়গা হয়েছে তার। ভালোবেসে কেউ কথা বলতে চাইলে কানের কাছে জিজ্ঞাসা পৌঁছে দিতে হয়। উত্তর একই ঝাপসা দেখি। আসলে কিছুই দেখে না। বায়ু নিঃসরণ করতে গিয়ে দুর্গন্ধ তরল বেড়িয়ে আসে, ময়লা শাড়িটা ভিজে যায় পেচ্ছাবে। জেগে আছে কি না জানে না।মরছে না বেঁচে আছে জিজ্ঞেস করলেও তার মানে বুঝতে পারে না। শুধু চোখ দুটো চেয়ে আছে একদম গোল ঘোলাটে সাদা মার্বেল হয়ে।
বর্তমান সাবিত্রীর দিনকাল এমনই। তবে কোনকালেই তার ভালো যায়নি।
১৯৩৮ সালের নভেম্বরের আট তারিখ চার আনা স্ট্যাম্পের দামে একটি সাক্ষ্যে সাবিত্রী তার পরিচয় ব্যক্ত করেছে। পরিচয় দিতে কোর্ট, স্ট্যাম্প লাগে না। কিন্তু হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রী উপাখ্যান উপন্যাস, নামত কিছু বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাসের সব চরিত্রই লেখকের রচনা।
সাবিত্রী দেবী বাল্যকালে মাতাকে হারিয়েছে। সাত বছর বয়সেই বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছিল পাশের গায়ের ভূদেব ঠাকুরের ছেলে দুকড়ির সাথে। বাবা তাকে জোড় করে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়েছিল মাঝে মাঝে। আর তখনই নিশিবালার হাত ছাড়া হয়ে গেছিল ঠাকুরের মেয়ে। নিশিবালা সাবিত্রীদের বাড়ির দেখ-ভাল করে। বড় ভাই গুরুদাস কাপড়ের দোকানদার। এরপর বাবাও যখন তাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেল শ্বশুর ঘর আর তেমন যাওয়া হয়নি। নিশিবালার বিয়ের পর একাকী হয়ে পরে সাবিত্রী। কিন্তু কলেরায় বর মরলে আবার ফিরে আসে সাবিত্রীর কাছে। সাবিত্রীরও একাকী থাকার কষ্ট ঘুচে যায়। সংসারে সাবিত্রী, নিশিবালা আর দাদা গুরুদাস।
সাবিত্রী নারী হয়ে উঠল, শ্বশুর বাড়ি যাবে যাবে করে যায়নি তখনো। দুকড়িকে তার বাবা কলকাতায় পাঠালো উপার্জনের জন্য। কিন্তু দুকড়ির হাতে দেয় দুই টাকা। সাবিত্রীর কাছে বাকি আট টাকা চাইলে অন্তর বন্ধক রেখে টাকা দেয় সে। বাড়িতে জানলো কেবল নিশিবালা।
আষাঢ় মাসে দুকড়ি টাকা পাঠায় অন্তর ছেড়ে নিতে। দুর্গাপদ অন্তর ছাড়তে চায় না। নিশিবালাও ব্যর্থ হয় অন্তত আনতে। ক্রমে ক্রমে অন্তত বন্ধকের কথা ছড়িয়ে পরে। দাদা, শ্বশুর মশাই সবাই চেষ্টা করলেও অন্তত দেয়না দুর্গাপদ। এমনি করে পৌষ মাস পর্যন্ত।
বিয়ের পর ঘর-সংসার হয়নি সাবিত্রীর। সেই রাতেই নতুন করে শুরু হবার কথা ছিল দুকড়ি আর সাবিত্রীর জীবন। সাবিত্রী পথ চেয়ে আছে দুকড়ির জন্য। সেদিন সন্ধ্যায় নলিন কেওটের স্ত্রী সরোজিনী সাবিত্রীকে ডেকে বলে, দুর্গাপদ আসছে, তার কাছে গিয়ে গয়না ফেরত চাইলেই দিবে। এই বলে ডেকে নিয়ে যায় তাকে। নলিনকে ১০ টাকা দেয় দুর্গাপদকে দিতে। নলিন তাকে ডেকে আমবাগানে নিয়ে যায় এবং তার শিসের শব্দে তিন জন আসলো। সাবিত্রী ফিরতে চাইলোও আর ফিরতে পারেনি।
সাবিত্রীর বয়স ১৫/১৬ হবে। রূপে অতুলনীয়। শকুনের চোখ পরেছিল তার রূপে। সেদিন রাতে জোছনা ছিল, দিনের রোদও হার মানায়। আকাশের চাঁদটা যেন মস্ত বড় তবুও শীতের রাত। সেই আলোর রাতেই অন্ধকার নেমে আসে তার জীবনে। সাবিত্রী সতীত্ব হারায়। দুর্গাপদ, সবুর, নলিন, বটবৃক্ষ তাকে ভোগ করে। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর চিৎকার করতে গেলে সবুর তাকে ছুরি বের করে ভয় দেখালো। কিন্তু তারা সেখানে সাবিত্রীকে ফেলে রেখে গেলো না।
শুরুতেই তাকে একটি টিনের ঘরে আটকে রাখে। পরেরদিন দুর্গাপদ তাকে তার আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যায়। দুর্গাপদ সেখানেই থাকে তাই আত্মীয়ের সাহায্য সাবিত্রী নিতে পারে না। এরপর সবুরের হাতে পড়ে সে। পুরো উপন্যাসেই সবুর তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর নিজের তৃষ্ণা মেটায়। মামীর বাড়ি নিয়ে গিয়ে তার হাতের শাখা, নোয়া ভাঙ্গে, কপালের সিঁদুর মুছে ফেলে। তাকে মুসলমান করে তোলার চেষ্টা করে, যাতে বাহিরের লোকে বুঝতে পারে সে সবুরের বউ। এরপর বেশারতুল্লা সবুরের মেসোর বাড়ি। তারপর বেলাত পীরের বাড়ি। সেখানে সৈয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। প্রথম দিকে তাকে সাহায্যকারী মনে হলেও সেও পরিচয় দেয় একজন ধর্ষক হিসেবে। ধন্যগ্রামে হাকিম আসে কিন্তু সৈয়দ তার হাতে কিছু নোট গুছিয়ে দেয়।
সময়ে সময়ে কিছু চরিত্রের দেখা মেলে, যাদের মনে হয় হয়ত গল্পের মোড় ঘুড়িয়ে দিবে। ঘুচে যাবে সাবিত্রীর কষ্ট। কিন্তু না সময়ের অপেক্ষা শেষে তারাও নাম লেখায় ধর্ষকের খাতায়।
এরপর সবুর তাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। সেখানে মুসাফিরখানায় একটি দোতালা ঘর ভাড়া নেয় সে। সেখানে ৭/৮ দিন থাকার পর সবুরের বন্ধু হুদা তাকে বগুড়ার বাড়িতে নিয়ে যায়। হুদার বাড়ি এবং মাওলাবখশের বাড়িতে মাঘ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত থাকে।সেখানে মাওলাবখশ, হুদা ও সবুর দ্বারা বারবার ধর্ষিত হয় সাবিত্রী।
ভাদ্র মাসের এক শনিবারে হুদা এবং সবুর সাবিত্রীকে কলিকাতায় নিয়ে আসে। হুদা বগুড়ায় ফিরে যায়। পরের শুক্রবার সবুর তাকে হাওরা থেকে বর্ধমানে নিয়ে এসে একটি রিকশায় তুলে দেয় সাবিত্রীকে। রিকশাওয়ালা এক ভদ্রলোকের বাসার সামনে নামিয়ে দেয় সাবিত্রীকে। এটা বর্ধমান কোর্ট।
সেদিন রাতে অন্তর আনতে গিয়ে আর ফেরেনি সাবিত্রী। সেকথা জানলো কেবল নিশিবালা, সরোজিনী, নলিন কেউটে। দুকড়িও সেরাতে বাড়ি আসেনি।
একজন ব্রাক্ষণ কন্যা। মুসলমান বাড়ি সম্পর্কে যার কোন ধারণা নেই, তার শাঁখা-সিঁদুর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। হাতে কাঁচের চুড়ি, মেহেদী পাতার আবরণ, সবুজ শাড়ি পরিয়ে তাকে মুসলিম বাড়ির বৌ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনি কি তার খাওয়া-দাওয়ার ভিন্নতায় খেয়াল ছিল না। গোমাংসও তাকে খাওয়ানো হয়েছিল। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তার নরক যন্ত্রণায় কেটেছে। কিন্তু সুযোগ হয়নি ফিরে আসার। দুর্গাপদ, সবুর, ধন্যগ্রামের সৈয়দ, নলীন, বগুড়ার হুদা, মাওলাবখশ তাকে বলাৎকার করত।
সাবিত্রী ছিল জীবন্ত লাশ। যারা তাকে নিয়ে একদিন পালিয়েছিল, সাবিত্রী তাদের কাছে অনেক বড় বোঝা হয়ে গিয়েছে। ওরা নুয়ে পরেছিল। কোথায় ফেলবে এই বর্জ্য। তখন আর্বজনার মত ফেলে দিয়ে গেছে বর্ধমানে। সাবিত্রী ফেরার খবরে পাড়ার টকটকে সিঁদুর পরা বৌ-ঝিরা মুখ বেঁকিয়ে বলেছে -
সাবি, আপনা-আপনি ফিরে এসেছে কুল খুইয়ে।
দু-চার খানা গানও গাওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে।
বর্ধমানের কোর্টে আসার পর ভাই তাকে নিয়ে ভাড়া করা বাড়িতে আসে। নিশিবালাও তার বরের মত কলেরায় ওপার চলে যায়। সংসারে নতুন বৌ, বাচ্চা আর উটকো ঝামেলা সাবিত্রী।
বিচারের রায়ে কারোর ফাঁসি হয়নি, কিংবা যাবজ্জীবন জেল। শুধু বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড। একসময় ফিরে আসে নর পশুরা। কিন্তু মুক্তি পায় না, কলঙ্ক মুছে না সাবিত্রীর।
সাবিত্রীর হাড়গুলো আজ গুঁড়ো। একটি চামড়ায় আটকে আছে মাত্র। কিন্তু তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অনশ্বর সাবিত্রী। তার দেহ নেই তবু সে অলৌকিক নয়, অতিপ্রাকৃতিক নয়। ঠিক জীবন যেমন সেও তেমনি। রোদ মেখেছে, জলে ভিজেছে, বাতাসে ভেসেছে, ফুলের ঘ্রাণ নিয়েছে। কখনো বা একটি-দুইটি মল্লিকার সঙ্গে মৃদুকণ্ঠে আলাপও করেছে।
একটি কন্যা শিশুর নারী হয়ে ওঠার সাথে সাথেই সংসারে পদার্পনের কথা ছিল। কিন্তু তার রূপ তার জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। জীবনের হিসাবের খাতায় পূর্ণ হয়ে থাকে শূন্যতা আর ব্যর্থতা দিয়ে। সাবিত্রীকে প্রতিবাদী কিংবা তেজী দেখা যায়নি। সে নিরবে সব অত্যাচার সহ্য করে গেছে কেবল। উঁচু বংশ তাকে রক্ষা করেনি। তার ফুলের মত জীবন একটা সময় আবর্জনা মনে হয়। সংসারে মর্যাদা হারিয়ে গেলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়, জীবন্ত লাশ হয়ে ভাইয়ের সংসারে।
~~~~0~~~~
সাবিত্রী উপাখ্যান
হাসান আজিজুল হক
উৎসর্গঃ সাবিত্রী দেবীকে
মূল্যঃ ৩২৫টাকা
পেজ সংখ্যাঃ ২২২
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
প্রকাশনীঃ ইত্যাদি, ঢাকা
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী ২০১৩
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম