'অমানুষ' - 'হুমায়ূন আহমেদ' সম্পর্কে মরিয়ম মেরিনা

অমানুষ - হুমায়ূন আহমেদ


তিন পুরুষের সিল্কের ব্যবসা এগিয়ে নিতে পারছে না ভিকি। ধারদেনা, ব্যাংকের লোন সব মিলিয়ে দারুণ ঝামেলায় ভদ্রলোক। কিন্তু শহরে তার নামডাক বেশ ভালো।

এদিকে অনিন্দ্য সুন্দরী স্ত্রী রুনের চাহিদা কম নয়। সবধরনের বিলাসিতা থাকা সত্ত্বেও তার আরো চাই। বাজারে নতুন মডেলের কোন জামা আসলে, সব কয়টাই তার দখলে চাই। যাতে অন্যকেউ সেই মডেলের জামা আর পরতে না পারে। তা যতই ব্যয় বহুল হোক। অথচ তার নিজের যথেষ্ট টাকা-পয়সা আছে। কিন্তু সে নিজের টাকা-পয়সা তার দুঃময়ের জন্য রেখেছে। রুনের স্বামী ভিকি হলেও তার প্রেমিক এতারা। স্বামীর চেয়ে এতারাকেই বেশি প্রাধান্য দেয় সে। ভিকির অবর্তমানে রুনের বাসায় তার অবাধ চলাচল।

রুন আর ভিকির একমাত্র সন্তান অ্যানি। মায়ের মতই সুন্দরী। অ্যানি ভীষন একা। বাবা ব্যবসার কাজে ব্যস্ত আর মা এতারা কিংবা তার রূপ চর্চা নিয়ে থাকে। অ্যানিকে সময় দেওয়ার মত সময় কারো নাই। অ্যানি স্কুলে যেতে চাইলে রুন আর দশটা ধনী পরিবারের মত বডিগার্ড ছাড়া মেয়েকে ছাড়তে চায়না। যদিও অ্যানির বাবার টাকা নেই কিন্তু অ্যানির মায়ের আত্মসম্মানের জন্য বাধ্য হয় হয় ভিকি বর্ডিগাড রাখতে। সেক্ষেত্রে সহয়তা করে এতারা। ভিকি বরাবরই হেরে যেত রুনের জেদের কাছে।

বডিগার্ড তেমন হাসি খুশি মানুষ নয়। দেখতেও তেমন ভালো নয়, লম্বা, রোগা, একটু যেন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় চুল সাদা-কালো ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। চোখও যেন শক্ত। বাংলাদেশের মানুষ সে। নামটাও অদ্ভুদ, 'জামশেদ'। অ্যানি ওকে নাম দিয়েছে বুড়ো ভালুক। কি যেন সব ভাবে সারাদিন। প্রয়োজন ছাড়া যেমন কথা বলে না, তেমনি কাজ ছাড়াও বাহিরে আসেনা। তবুও কথা বলতে চেষ্টা করে অ্যানি। খুব একটা কথার জবাব দেয়না। প্রথম প্রথম অ্যানির খারাপ লাগতো। এর মধ্যে বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়। ওরা ঘুরতেও যায়। রাগী মানুষটাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। অ্যানির স্কুলের কম্পিটিশনে হেল্প করে বুড়ো ভালুক। তাকে দৌড় শেখায়। মূল প্রতিযোগিতার দিনে শেষ অবধি সার্পোট করে গেছিল বুড়ো ভালুক। অ্যানি যখন মুখ থুবড়ে পরে গেল, তাকে বারবার উঠায় জন্য সাহস দিয়েছিল গ্যালারিতে বসে বর্ডিগাড। তাকে শিখিয়েছে, পরে যাওয়ার পরও দাঁড়ানো উচিত এবং দৌড়ানো উচিত। থেমে থাকতে নেই। এবং বলেছিল,

পৃথিবীতে বেশিভাগ মানুষই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। খুব অল্প কিছু মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারে।


এতারার কু নজর অ্যানির উপর পরলে বাবা-মা বুঝতে পারে নাই। ১২ বছর বয়সী অ্যানিকে কাছে পেতে চাইলে বডিগার্ড কৌশলে অ্যানিকে রক্ষা করে।

ভিকির সময় দিন দিন আরো খারাপ যাচ্ছে। সে ব্যাংক থেকেও আর লোন পাচ্ছে না। ব্যবসা দিন দিন খারাপ গেলে অস্থির হয়ে ওঠে সে। স্ত্রী রুনের টাকা নিতে চাচ্ছে না। যদিও বাধ্য হয়ে অল্প কিছু নেন তাতে তো সমাধান আসেনা। ভিকিকে বুদ্ধিদাতা এতারা এই সময়েই একটা দারুণ খেলা খেলে ভিকির সঙ্গে। এতারা ১২ বছরের অ্যানিকে পেতে চাইত আগে থেকেই। এসময়কে কাজে লাগিয়ে ভিকিকে পরামর্শ দেয়, লয়েডস ইন্সুইরেন্স কোম্পানীতে অ্যানির দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া। এরপর অ্যানিকে নিজেদের দিয়ে কিডন্যাপ করা। যদিও বাবা হিসাবে ভিকি প্রথমে মানতে চায়নি কিন্তু অসহায় ভিকির না মানলেও আর কোন পথ ছিল না। তবে এতারা জানায়, অ্যানির কোন ক্ষতি হবেনা। এসবের কিছুই জানত না রুন। পুরোটাই একটা সাজানো নাটক। শুধু উপস্থাপনের অপেক্ষা।

অ্যানিকে যেদিন কিডন্যাপ করা হল, সেদিন বডিগার্ড জামশেদ অপ্রান চেষ্টা করেছে তাকে রক্ষা করতে।কিন্তু পারেনি। কিডন্যাপারদের তিনজনকে গুলি করে মেরেছে জামশেদ, আর তার ফুসফুসে লেগেছে ৩টি গুলি। সারাদেশে এ নিয়ে যখন তোলপাড় ভিকি তখন নিশ্চুপ। প্রতিটা নিউজ চ্যানেলের হিরো তখন জামশেদ। প্রশংসা পেল খুব দায়িত্ববান বলে।

এদিকে রুন মেয়েকে হারিয়ে এলোমেলো হয়ে গেল। ভিকি মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু সব সময় পাচ্ছে না। তাকেও অসহায় লাগছে। এতারাকে অ্যানি দেখে অনেকটা সাহস পেয়েছি। আশা করেছি, আঙ্কেল হয়ত তাকে নিতে এসেছে। কিন্তু ভুল প্রমাণ হলো। এতারা অ্যানিকে ভোগ করল। পরবর্তীতে অ্যানি গণধর্ষণের স্বীকার হয়।

জ্ঞান ফিরার পর জানতে চায় জামশেদ অ্যানি কথা। অ্যানিকে এতারা ও তার দলবল ধর্ষণ করার পর নৃশংস ভাবে হত্যা করে। অপরাধ এবং অপরাধী যখন বেড়েই গেল তখন জামশেদকে দেখা গেল তার আসল রূপে।

জামশেদকে আর হাসপাতালে পাওয়া যায় নি। সে একের পর এক অপরাধীকে খুঁজে বের করে এবং অ্যানি হত্যার প্রতিশোধ নেয়। পরিকল্পনার মূল হোতা এতারা বাজে স্বপ্ন দেখা শুরু করে।মৃত্যুভয় তাকে তাড়া করে বেড়ায়। পাহারা বাড়িয়ে দিয়েও সে শান্তি পায় না। রবিবার মায়ের সাথে দেখা হলে মাও তাকে নিয়ে খারাপ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে। এমনকি দেশ থেকে পালিয়ে যায়। জামশেদকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরষ্কারও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু জামশেদ তখন সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এঞ্জেল ফসিলো, উইয়ি, নিওরো এবং দলের মূল হোতা ভিকাইডিয়ারকে হত্যা করে বর্ডিগাড জামশেদ।

মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর রুন মেয়ের অভাব গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারে। মেয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। নিজের ভুল গুলো শুধরে নেয়।

ক্রিমিলানদের একে একে হত্যা করার সময় পুলিশ অফিসারদের নিরব থাকতে দেখা যায়। অপরাধী ক্যানটারোলার সহায়তায় জামশেদ পৌঁছায় ভিকাইডিয়া পর্যন্ত। ক্যানটারোলের মায়ের হত্যাকারীও ছিল ভিকাইডিয়া। ভিকাইডিয়ার কাছে যাওয়ার আগে জামশেদের শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলে সে বলে,

যদি সম্ভব হয় অ্যানির পাশে একটু জায়গা রাখবে। মেয়েটি বড্ড ভীতু। আমি পাহারায় থাকলে হয়ত শান্তিতে ঘুমুবে।


তবে জামশেদকে দেওয়া কথা ক্যানটারোলার রক্ষা করে। সে এতরাকে হত্যা করে।

ইস্টার্ব সিমেট্রিতে অ্যানি নামের মেয়ের কবরের পাশে একজন বিদেশির কবর আছে। তার গায়ে চার লাইনের একটি ইতালিয়ান কবিতা। যার অর্থ অনেকটা এরকম—

এখানে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে।তাকে শান্তিতে ঘুমুতে দেও।


কবরের পাশেই দুটি প্রকান্ড চেরি ফুলের গাছ। বসন্তকালে কবরটি সাদা রঙের চেরি ফুলে ঢাকা পড়ে থাকে। বড় চমৎকার লাগে দেখতে।

পুরো গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যায় নায়ক চরিত্রের বাংলাদেশী জামশেদ। সে তার  দায়িত্বে অনড়। রুন একজন বিদেশি মা, যিনি সন্তানের জন্য খুব একটা ভাবেন না। বাবা অসহায় তবে নিজেকে মেয়েকে জিম্মি করে টাকা আদায়ের ধান্দা। বইটিতে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও কোথাও যেন ঘাটতি থাকে। হয়ত বিদেশি বাবা মা এমনই হয়। অ্যানি নামের মেয়েটি বন্ধু সুলভ। সে বন্ধু করে নিতে পারে রাগী সেই বর্ডিগাডকে। তাদের নিয়ে ছোট ছোট গল্প, কথা বন্ধুত্বের প্রকাশ পায়। অ্যানির কিডন্যাপের পর বডিগার্ড জামশেদ একে একে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয় তার বন্ধুর খুনিদের। গল্প মোড় নেয় সিরিয়াল ক্লিলিং এ। জামশেদও খুন হয় ক্রিমিনালদের হাতে কিন্তু সে মরার আগে এতারার হত্যাকারীকে নিযুক্ত করে। বডিগার্ডের তেমন কিছু চাওয়ার থাকেনা। তার শেষ চাওয়া সে তার বন্ধুকে মৃত্যুর পরেও পাহারা দিতে চায়। বইটি বন্ধুত্ব ও দায়িত্বের যথাযথ মর্যাদার প্রকাশ।

==========
বইঃ অমানুষ
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশনীঃ অন্বেষা, ঢাকা
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
মূল্যঃ ২০০ টাকা
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী বইমেলা ২০০৯
পঞ্চম মুদ্রণঃ ফেব্রুয়ারী বইমেলা ২০১৬

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ