নব্বইয়ের দশকের অন্যতম লেখক মিজান খন্দকার। তিনি প্রধানত কবি। কবিতাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। তাঁর 'যথাকবি নিরঞ্জন' কাব্যগ্রন্থের আলোচনা গ্রন্থগত সাইটে এর আগে প্রকাশ করা হয়েছে। নিরন্তর কবিতানিষ্ঠ জীবন যাপনের অবসরে লিখেছেন চারটি গল্প। সেই গল্পগুলো নিয়ে তাঁর একমাত্র গল্পের বই "পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ"।
গল্পগুলোর সূচিবদ্ধ শিরোনামগুলো একবার দেখে নেয়া যেতে পারে।
- দখল
- পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ
- একটি দূরপাল্লার কোচ ও গতির অভ্যন্তরে কিছু বহুভেদক প্রাণ
- ডানা
প্রতিটি গল্পের কাহিনী সংগঠনে লেখকের মুন্সিয়ানা চোখে পড়ে। মানুষ, তার অন্তর্লীন মনোজগত, এই জগতে নিরন্তর বিক্ষুব্ধ চিন্তারাশি ও সেই চিন্তাপ্রসূত আবেগের বিচ্ছুরণ লেখকের প্রধান মনোযোগের বিষয়। মানুষের আবেগসঞ্জাত আচরণ সংগঠনের পিছনে যে কাহিনী তার রূপ নির্মাণে লেখকের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
প্রথম গল্পের কথাই ধরা যাক। গল্পের নাম 'দখল'। মানব সমাজ বিকাশের অন্যতম অনুষঙ্গ যন্ত্র। কিন্তু যন্ত্রের প্রসার যে সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে তা লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি। ডিঙ্গি নৌকার মাঝি নুরুলের রুজি হাতছাড়া হয়ে যায় শ্যালোনৌকার মালিক বদরুদ্দিনের কাছে। তার যান্ত্রিক ঔদ্ধত্য রূপ নেয় ব্যক্তিক আক্রোশে। যান্ত্রিক শক্তির অহংকার নুরুলকে আহত করে, শারীরিক আঘাতের বেদনা ও অপমান তার চেতনায় অপার্থিব বোধ জাগিয়ে তোলে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শক্তিমানরা হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রক। এমন সামাজিক কাঠামোয় আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া শোষিতের আর কোন উপায়ও থাকে না।
যন্ত্রবিদীর্ণ নদী নুরুলের অবচেতন মনে আর শান্ত থাকতে পারে না। এক তরঙ্গায়িত নারীর রূপ ধরে নুরুলকে আশ্রয় দিতে চায়। নুরুল সচেতন হয়ে উঠলেও বিস্রস্ত হয়ে ওঠে।
তাই সে নদীবক্ষেই খুঁজে পেতে চায় নারীজীবনের আদিম আহ্ববানকে। স্ত্রী খোতে'কে সাথে নিয়ে নদীবক্ষেই জলক্রীড়ার আয়োজন করে। কিন্তু সফল হয় না। কারণ-
আতি পাতি করে খুঁজেও কোথাও খুঁজে পায় না সে এক নব্য-যৌবনবতী নারীর মুগ্ধতাকে। পৃষ্ঠা-১৭
এ যেন মানবিক পরাজয়ের এক অভিনব বিনির্মাণ। নুরুল তার প্রাত্যাহিক জীবনে যে স্বাভাবিক যাপনের প্রত্যাশা করে তা আর পূরণ হয় না।
দুদিক থেকে টান অনুভব করে নুরুল মাঝি, একটি নদী ও একজন নারী নুরুলের দখল নিতে যুদ্ধে মেতে ওঠে। পৃষ্ঠা-১৭
‘পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ' শীর্ষক দ্বিতীয় গল্পে পরস্পর বিচ্ছিন্ন একাধিক ঘটনার মধ্যে মিজান খন্দকার একজন কৌশলী লেখকের মত তিনটি অধ্যায়ে নিজের ভাবনা উপস্থাপন করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের নগর সভ্যতার উত্থানের বিকট প্রতিচ্ছবি। আর তাকে চিত্ররূপময় করেছেন দ্বিতীয় অধ্যায়ে। তৃতীয় অধ্যায়ে পরিণতি পায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে অঙ্কিত ১৭টি গল্পের দগদগে ফলাফল। বাংলাদেশী শহরগুলো তো মূলত গ্রামেরই বর্ধিষ্ণু রূপ। তাই অনিবার্যভাবে এখানে রাস্তার পাশে জেগে থাকে পুতিগন্ধময় ডাস্টবিন ও বস্তির নোংরা ঝুপড়ি। যেখানে অবাধে ক্ষমতা বিস্তার করে সর্বব্যাপী কাক ও কাকের দঙ্গল।
মিজান খন্দকার কাককে দেখেছেন এক সর্বজ্ঞ দূরদর্শী পর্যবেক্ষকরূপে। তাই ঘটনা পরম্পরায় একটি কাকের অনিবার্য উপস্থাতি থাকে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৭টি গল্পের প্রতিটিতে একটি কাক এসে উপস্থিত থাকে। কখনও নির্মোহ আবেগে ঘটনার বীভৎসতা দেখতে থাকে, কখনও বা প্রকাশ করে বিবমিষা জাগানো প্রতিক্রিয়া। গল্প সংঘটনের চরিত্রগুলোতে কালো কাকের অবস্থান বিশেষায়িত হয়ে ওঠে মিজান খন্দকারের দক্ষ রচনাশৈলীতে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে দেশ গঠনের যে অঙ্গীকার ছিল, তা থেকে আমাদের বিচ্যুতি সেই কাক উপেক্ষা করে না। তাই রাজনৈতিক নেতা যখন উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করেন -
… আজকের এই সমাজ ব্যবস্থা কেউ মেনে নিতে পারে না। এখন সর্বত্র শুধু বৈষম্য, ক্ষুধা আর মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।… পৃষ্ঠা- ৩১
তখন সে পিচিক করে মলত্যাগ করে সমাবেশ ঘিরে থাকা প্যান্ডেলের উপরে। এই সাংকেতিক ঘৃণা পাঠককেও আবেষ্টন করে। ফলে দ্বিতীয় অধ্যায়ের জীবনের টুকরো ঘটনাগুলো তৃতীয় অধ্যায়ে গ্রহণ করে অনিবার্য পরিণতি।
গল্পে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা দেশের সামাজিক নিরাপত্তা, নৈতিক মান, রাজনৈতিক অঙ্গীকার, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা প্রভৃতির ভঙ্গুর অবস্থার গল্প বলে। প্রতিটি ঘটনার বৃহত্তর গল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। পল্লবিত কাহিনীর আবরণে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতো। কিন্তু মিজান খন্দকার অল্প পরিসরের অবয়বে অনেক গল্প বলতে চেয়েছেন। ছোট ছোট টুকরো দৃশ্যপট দিয়ে বৃহত্তর সামাজিক পরিসরকে ধরতে চেয়েছেন। সমাজ জীবনের প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এক ব্যাপক প্রেক্ষাপটের বিবর্তন মূর্ত করে তুলেছেন স্বল্পায়তনের ক্ষুদ্র ঘটনার আবহে।
'একটি দূরপাল্লার কোচ ও গতির অভ্যন্তরে কিছু বহুভেদক প্রাণ' গল্পটি অভিনব। ঢাকাগামী একটি নৈশকোচের যাত্রীদের নানাবিধ জীবনচেতনার জীবন্ত বিবরণ। বাংলা ভাষার স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে চিহ্নিত ক্ষুদ্রায়তনের অনুচ্ছেদ বা বাক্যগুচ্ছ দিয়ে গল্পটি নির্মিত। এই অনুচ্ছেদগুলো দিয়ে মিজান খন্দকার মানবজীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ সময়যাপনের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়, অর্থনীতি, সমাজচিত্র, দর্শনবোধ ইত্যাদি বিষয়কে একসূত্রে গাঁথতে চেয়েছেন। একটি বাসের মধ্যেই যাত্রীদের বিবিধ চিন্তা, কথোপকথন ও কার্যক্রমের মধ্যে সমকালীন সমাজের বিবিধ অনুষঙ্গের উপস্থাপন করেছেন। ব্যক্তিক, রাষ্ট্রিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানসূত্র অন্বেষণ করেছেন। কিন্তু নিয়তি যেন সহায় নয়। কোন এক অজানা গহ্বরে দেশের পতিত হওয়ার মত গন্তব্যের অভিমুখে দ্রুতগামী বাসটিও পথ হারায়। সকল যাত্রীদের আশা আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণা-বেদনা, স্বপ্ন-ভবিষ্যত সবকিছু নিয়ে তলিয়ে যায় অন্ধকার সলিল সমাধিতে। ড্রাইভার শত চেষ্টা করেও বিপর্যয়কে এড়িয়ে যেতে পারে না। পাশ কাটাতে পারে না অনিবার্য ভবিতব্যকে। দেশের অবশ্যম্ভাবী গতিপথ লেখকের দূরদর্শী কল্পনায় বাসের রূপ ধরে মূর্ত হয়েছে।
চতুর্থ গল্প 'ডানা' পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী নির্যাতনের বীভৎস ঘটনা নিয়ে রচিত। পারিবারিক কলহের পরিণতিতে গৃহবধু সাবিত্রীকে খুন হতে হয় স্বামীর হাতে। যৌতুকের দাবী রূপান্তরিত হয় পরকীয়ার অভিযোগে। যার সমাপ্তি ঘটে গৃহবধুর মৃত্যুতে। বাংলাদেশের মত অশিক্ষা ও দারিদ্রপীড়িত জনপদের এই নিয়মিত ঘটনা একজন সমাজ সচেতন লেখক হিসেবে মিজান খন্দকারের চোখ এড়ায় নি। তিনি সহৃদয়তার সাথে ঘটনার আনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। বিবরণে নারীহত্যার ঘটনাটিকে স্পষ্ট করে বাস্তবানুগ করে ফুটিয়েছেন। মৃত লাশ গুম করতে গিয়ে সদলবলে ধরা পড়ে স্বামীসহ সবাই। ঘটনার পরম্পরায় প্রকাশ হয় একই গ্রামবাসী জোবেদার ঘটনা। সাবিত্রীর লাশ গুম করতে না পারলেও জোবেদার লাশ তার খুনী স্বামী সোলেমান নিরাপদে গুম করতে পেরেছে। কিন্তু তার কোন প্রমাণ নেই। লেখকের সমাজবীক্ষণে কোন ঘটনাই এড়িয়ে যায় না। বাংলাদেশের গ্রামান্তরে কত নারী তাদের নিকটজনের হাতে খুন হয়, হয়ে যায় গুম। তার কয়টির খবরই বা পৌঁছায় মিডিয়ার কাছে! লেখক বিষয়টি নিয়ে সকলকে সচেতন করতে চান। তিনি মনে করেন সমাজের প্রতিটি নারী নির্যাতনের ঘটনা উন্মোচন হওয়া দরকার। তাই সাবিত্রী খুনের পাশাপাশি জোবেদার গুম হয়ে যাওয়া ঘটনারও আভাষ দেন। সাবিত্রী ও জোবেদা দুজনই 'মুক্তনারী' নামক একটি এনজিও চালিত সংস্থার সদস্য ছিল। তাদের এই সংযোগ জীবন বাঁচাতে কোন ভূমিকাই রাখতে পারে নি।
এই গল্পেও এক অনিবার্য ভূমিকায় একটি কালো কাকের আবির্ভাব ঘটে।
… কোত্থেকে যেন একটি কাক উড়ে এসে প্রথমে ডালে বসলো, তারপর সেটা এক পা দুই পা করে পাশে হেঁটে সাইনবোর্ডের উপর গিয়ে বসলো, বসে বিষ্ঠা ত্যাগ করলো সেখানে। হঠাৎ সফি ভালোভাবে খেয়াল করলেন যে, পাখির শুকনো বিষ্ঠার নিচে সাইনবোর্ডটির বেশ কিছু অংশের লেখা ঢাকা পড়ে গেছে। বড় বড় করে লেখা 'মুক্তনারী' অক্ষরগুলোর মধ্যে 'রী' অক্ষরটি বিষ্ঠার আড়ালে চাপা পড়ায় 'মুক্তনা' শব্দটিই শুধু পড়া যাচ্ছে। প্রাণীজগতের উড়ন্ত আর স্বাধীন পাখিগুলো হয়ত পৃথিবী নামক ভূ-খণ্ডের নারীদের পরাধীনতা বুঝতে পেরে কম্পিউটার-সভ্যতার যুগের মানুষদের 'নারীরা যে এখনও মুক্ত না' সেটা বোঝানোর জন্যই শৈল্পিক চাতুর্যের সাথে এই কাজটি করেছে। পৃষ্ঠা ৭৯
মিজান খন্দকারের সামাজিক সচেতনার চিত্র গল্পগুলোতে স্পষ্ট। তিনি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে বিশ্লেষণ করেন। বুঝে নেন নিজের মত করে। যা তার গল্পে জেগে ওঠে চিত্ররূপময় হয়ে। তাঁর উপমা নির্মাণ মনোহর, বাক্যগঠন সুখপাঠ্য, কাহিনীবিন্যাস যথাযথ, বাক্যভঙ্গী সাবলীল, শব্দচয়নে তিনি আধুনিক ও পাঠকবান্ধব। তার গল্পপাঠে পাঠক নিমগ্ন হয়ে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে ডুবে যায়। এক নতুন অভিযাত্রার টানে এগিয়ে যান অনিবার্য পরিণতির দিকে। পাঠশেষে নিজের বুকে জড়িয়ে নেন এক মৌলিক অভিজ্ঞতার আলোক। এখানেই লেখক সফল। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজবোধ, দর্শন অনুধ্যান মানবিক। শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজের ওপারে যে অবাধ প্রান্তর রয়েছে, তিনি তার স্বপ্ন দেখেন। শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন বুকে নিয়ে রচনা করেন গল্প, কবিতার অনবদ্য দৃশ্যপট।
-০-০-০-০-০-০-
পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ
মিজান খন্দকার
প্রচ্ছদ: মামুন হোসাইন
প্রকাশকাল: ২০০৯
প্রকাশক: ভাষাচিত্র, ঢাকা।
পৃষ্ঠা: ৮০
মূল্য: ১০০ টাকা
SBN: 984-70346-0007-0
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম