বই আলোচনার পত্রিকা 'বইকথা'

বই আলোচনার পত্রিকা 'বইকথা'


বাংলাভাষায় বই আলোচনার পত্রিকা খুব বেশি নেই। বই আলোচনাকে প্রাধান্য দেয়ার মত মানসিকতার অভাব এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। অন্যেরা যেখানে বই আলোচনাকে অপ্রধান বিষয় হিসেবে পত্রিকার শেষাংশে কয়েকটি পৃষ্ঠার সীমানায় বন্দী করে ফেলে, সেখানে 'বইকথা' কর্তৃপক্ষ একে মূল বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আর তাই, বাংলা ভাষায় বই আলোচনার পত্রিকা হিসেবে 'বইকথা' বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে।

বইকথার দ্বিতীয় সংখ্যার প্রকাশকাল মার্চ ২০২১। এই সংখ্যার প্রাজ্ঞ সম্পাদক 'শামসুল কিবরিয়া' বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন বাঙালী মননশীল ব্যক্তিত্বদের আত্মজীবনী ও আত্মস্মৃতিমূলক বইকে। তেরজন সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, চিত্রশিল্পী, সংগঠক, প্রকৃতিপ্রেমী, চিন্তাশীল বাঙালীর লেখা আত্মকথামূলক বই উপজীব্য হয়েছে 'বইকথা' পত্রিকার এই সংখ্যায়। সম্পাদকীয়তে সম্পাদক খবরটা জানান এভাবে-

বইকথার এ সংখ্যা সাজানো হয়েছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত ১৩জন ব্যক্তির আত্মজীবনী ও আত্মস্মৃতিমূলক বইয়ের আলোচনা দিয়ে। তারা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাদের এ বইগুলো পাঠের মাধ্যমে তাদের জীবন দর্শন, তাদের সময়ের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে।


যাদের বইয়ের আলোচনা দিয়ে এই সংখ্যা সাজানো হয়েছে, তাঁদের চিনতে সূচিপত্রের দিকে তাকাতে হবে। বইকথা পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার সূচি নিম্নরূপ-

সূচি...

  • জসীমউদ্‌দীন (জীবনকথা)
  • সরদার ফজলুল করিম (আমি সরদার বলছি)
  • দ্বিজেন শর্মা (মধুময় পৃথিবীর ধূলি)
  • শামসুর রাহমান (কালের ধুলোয় লেখা)
  • আহমদ রফিক (পথ চলতে যা দেখেছি)
  • মুর্তজা বশীর (আমার জীবন ও অন্যান্য)
  • আল মাহমুদ (যেভাবে বেড়ে উঠি)
  • আনিসুজ্জামান (বিপুলা পৃথিবী)
  • যতীন সরকার (পাকিস্থানের জন্মমৃত্যু-দর্শন)
  • হাসান আজিজুল হক (ফিরে যাই ফিরে আসি, উঁকি দিয়ে দিগন্ত, এই পুরাতন আখরগুলো)
  • আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (নিষ্ফলা মাঠের কৃষক)
  • রিজিয়া রহমান (নদী নিরবধি)
  • নির্মলেন্দু গুণ (আমার কণ্ঠস্বর)


বই নিয়ে আলোচনা সবসময় লোভনীয়। পত্রিকার আলোচনাগুলোও তেমন। প্রত্যেকটি বই নিয়ে আলোচনা করেছেন স্বতন্ত্র আলোচক। তারা প্রত্যেকেই জীবনীমূলক বইয়ে প্রাপ্ত বিবরণ থেকে লেখকের বেড়ে ওঠা, সাহিত্য ও সমাজচিন্তা, বিভিন্ন অবস্থার আলোকে লেখকের মানসিক অবস্থান, বৌদ্ধিক পরিবর্তন ইত্যাদি প্রসঙ্গের উপর আলোকপাত করেছেন। সমকালীন রাজনীতি ও ইতিহাস তাদের লেখাতে ছায়াপাত করেছে; প্রকাশ করেছে সমকালীন ঘটনার পূর্বাপর। আত্মকথা লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাবলী, সমাজের অন্য মানুষের সাথে ঘটিত মিথস্ক্রিয়া, যাপিত সময়ের নানাবিধ অনুষঙ্গ – বস্তুত লেখক নিজের স্মৃতিকথায় যা কিছু উচ্চারণ করেছেন, সেসব নিয়ে আলোচকদের মনোযোগের কোন ঘাটতি ছিলনা। প্রত্যেকেই নিজের লেখার প্রতি আন্তরিক ছিলেন।

এই প্রসঙ্গে দুয়েকটা উদাহরণ উপস্থাপন করা যেতে পারে।

প্রকৃতিসাধক দ্বিজেন শর্মার আত্মজীবনী মন্থন করে আলোচক স্বপন নাথ জানান-

সেই কৈশোরে গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় লেখকদের বই পাঠ করে ফেলেন। সে পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা, মা, বড়ো ও মেজ দাদা। উল্লেখযোগ্য যে, গাছগাছালি, লতাগুল্ম ঘেরা বাড়িও তাঁর মানসগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেসব বৃক্ষরাজি বাড়িতে তিনি দেখেছেন, সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির বৃক্ষ এখন সারাদেশের কোথাও দেখা যায় না। বস্তুত, এমন প্রাকৃতিক পরিবেশই একজন দ্বিজেন শর্মাকে প্রকৃতিসাধক হিসেবে তৈরি করেছে। তাঁর নিজের বাড়ি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা থেকেই আমরা তা উপলব্ধি করি। কবিরাজ বাড়ির বাগানে ছিল, ভেষজ, ফলজ, বনজ গাছগাছালি ও লতাগুল্ম- অশোক, অর্জুন, আমলকী, হরিতকী, বহেড়া, স্বর্ণচাঁপা, বকুল, নাগেশ্বর, শেফালি, কালো-বাসক, ছাতিম, গোলচি, কমলাগুঁড়ি, কণ্টিকারি, বালা, বিশল্যকরণী, জয়পালম, নানা রঙের ঝিন্টি (লাল ঝিন্টির আরেক নাম কুরুবক), লবঙ্গলতা, হাপরমালি ইত্যাদি। এ পরিবেশের বন্ধনে উদ্ভিদ ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর আলাদা আকর্ষণ তৈরি হয়। যা তিনি লালন করেছেন আজীবন। পৃষ্ঠা- ১৯



কবি শামসুর রাহমানের 'কালের ধুলোয় লেখা' নিয়ে আলোচনায় আলোচক মেহেদী ধ্রুব বলেন-

... এটাকে ইতিহাসের দলিলও বলা যায়, কারণ বাঙালির ঐতিহাসিক ঘটনাপুঞ্জে শামসুর রাহমানের সম্পৃক্ততা, তিনি কী করতেন, কোথায় থাকতেন, তখন তাঁর আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, ভাবনা-কল্পনা, আনন্দ-বেদনা কেমন ছিল, এসবের রেখাচিত্র অঙ্কন করেছেন। অর্থাৎ সময়ের খাপে নিজেকে আলগোছে স্থাপন করেছেন। এতে করে নিজের কথা বলতে গিয়ে বাঙালির জীবনিতিহাস ব্যক্ত করেছেন। পৃষ্ঠা - ২৭


চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশির সম্পর্কে আলোচক নাহার আলমের ভাষ্যে আমরা জানতে পারি-

১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট জন্ম নেয়া শিশু মুর্তজার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র পাঠাগারে সংরক্ষিত মাসিক পত্রিকাগুলো এবং এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় মুদ্রিত চিত্রকলা বিষয়ক রঙিন ছবি ও অলংকারসমূহ। আর ইমেজের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল মায়ের কাছ থেকে। যখন আকাশে মেঘ জমলেই তাঁর মা তাঁকে ডেকে দেখাতেন-- ওই যে মানুষের মুখ, গরুর পাল। সে থেকে শিশু মুর্তজা মেঘের সমাবেশে অনেক কিছুর রূপ কল্পনায় আঁকতেন। পৃষ্ঠা- ৪৪৩


শিক্ষাবিদ, গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ডক্টর আনিসুজ্জামান কে চিনতে হলে তাঁর তিনটি বই 'আমার একাত্তর (১৯৯৭), 'কথা নিরবধি (২০০৩) ও 'বিপুলা পৃথিবী' (২০৫) পাঠ করতে হবে। একথা জানিয়ে আলোচক অনন্ত নিগার শিক্ষাবিদের রচনাশৈলী ও ইতিহাসচেতনার পরিচয় দেন। উল্লেখ করেন তাঁর দেশপ্রেমের মর্মরূপকে। তিনি জানান-

‘বিপুলা পৃথিবী' মুক্তিযুদ্ধ- পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লেখক আনিসুজ্জামান নিরাসক্তভাবে নিজেকে উহ্য রেখে আত্মকথার অন্তরালে তুলে ধরেছেন দেশ ও দেশের মানুষের ইতিহাস। ভাষার সরলতা ও প্রাঞ্জলতা তাঁর স্মৃতিকথনকে করেছে সহজবোধ্য অথচ গভীর। পৃষ্ঠা- ৬৪



সম্পাদকের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সমকালে বই নিয়ে আলোচনা সমালোচনার আয়োজন খুব একটা চোখে পড়ে না। এরকম নিষ্ফলা সময়ে সম্পাদক বই আলোচনার পত্রিকা প্রিন্ট মাধ্যমে প্রকাশ করে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

পত্রিকার প্রকাশনার মান ভাল। ঝকঝকে সাদা কাগজে গাঢ় কাল কালিতে ছাপানো মানসম্মত হয়েছে। কোথাও রঙের গাঢ়ত্ব অস্পষ্ট হয়ে যায়নি। মলাট পেপারব্যাক হওয়ায় দাম সহনশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। আল নোমানের আঁকা প্রচ্ছদ সাদা কালো হলেও মনোহর লেগেছে। এজন্য প্রচ্ছদশিল্পী একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন।

তবে বই আলোচনার একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রসঙ্গ পত্রিকার কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। যে বইয়ের আলোচনা পড়লাম, তার একটু পরিচিতি জানা থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি আলোচনার সূচনা বা সমাপ্তিতে কোন একটি পাতায় আলোচ্য বইগুলোর গ্রন্থপঞ্জী থাকা উচিত ছিল। কোন বইকে চিনতে হলে তার সম্পর্কে প্রাথমিক কয়েকটি তথ্য জানা থাকা আবশ্যক। কত সালে প্রকাশিত, কোন সংস্করণ, পৃষ্ঠাসংখ্যা, মূল্য এসব প্রাথমিক তথ্য পাঠককে জানানো যেতে পারত। যে প্রচ্ছদশিল্পীর কর্মগুণে, শিল্পবোধে একটি বই পাঠকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়, তাঁর নামটি কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি আলোচনায় জীবনীলেখকের একাধিক উদ্ধৃতি প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো কত নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে তা প্রকাশ না করলে উদ্ধৃতির সত্যতা সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে যায়। মুর্তজা বশীরের বইয়ের আলোচনায় উদ্ধৃত বাক্যগুলির শেষে পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু কত সালে কোথায় থেকে প্রকাশিত, সে তথ্য উল্লেখ করা হয় নি। পরবর্তী সংস্করণে সম্পাদক এই বিষয়গুলো নিয়ে আরো মনোযোগী হবেন, এই প্রত্যাশাটুকু করাই যায়।

বই নিয়ে আলোচনা সমালোচনার এই ধারা অব্যাহত থাকুক। 'বইকথা' কর্তৃপক্ষ তাদের প্রচেষ্টাকে দীর্ঘকাল বহমান রাখতে সক্ষম হোন- এই কামনা করি। তাদের পরিশ্রম সফল হোক।


=O=O=O=O=O=O=

বইকথা
দ্বিতীয় সংখ্যা, মার্চ ২০২১
সম্পাদক: শামসুল কিবরিয়া, সিলেট
প্রচ্ছদ: আল-নোমান
প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১
পৃষ্ঠা: ১০৪
মূল্য: ৫০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ