কোনো বই পড়ার পর ভালো লেগে গেলে সে বইটার রিভিউ নিরপেক্ষ স্থান থেকে লেখা বেশ কষ্টকর। বই না পড়ে তো আর রিভিউ করা সম্ভব না। আর পড়তে গেলে ভালো লাগতেই পারে। এটা চায়ের কাপে বিস্কিট ভেঙ্গে পড়ার মত স্বাভাবিক ঘটনা।
কাহিনী সংক্ষেপ:
প্রেম-ভালোবাসা মানুষের চিরন্তন প্রবৃত্তি। রোগ-শোক, মহামারী, যুদ্ধ কোনো কিছুই দুটি হৃদয়ের কাছাকাছি আসাকে রোধ করতে পারে না। আর তাই যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেও ইতালীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ফ্রেডারিক হেনরি, ইংরেজ নার্স ক্যাথরিন বার্কলের প্রেমে পড়েন। তাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে একসময় ক্যাথরিনের গর্ভে সন্তান আসে। কিন্তু সন্তান প্রসবের সময় ক্যাথরিন মারা যায়। অতঃপর বৃষ্টিক্ষুব্ধ রাতে নিরুপায়, ভগ্নহৃদয় হেনরি চলতে থাকে এক অজানা, বিস্ময়কর ও নিরুদ্দেশ জীবনে।
মুল আলোচনা গঠন প্রক্রিয়া:
দি সান অলসো রাইজেস এবং ফেয়ারওয়েল টু আর্মস উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তার কালের জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবন যাত্রার মূল স্রোতধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সমর্থ হন। এই নুতনতর জীবন জিজ্ঞাসার রূপদানে তিনিই একমাত্র পথিকৃৎ। মোট কথা, তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোর বিশ্বাস এবং ঝোঁক হচ্ছে সহিংসতা, উদগ্র কাম বাসনা, ক্রীড়া, ষাঁড়ের লড়াই, খাওয়া, সুরা পান এসবের দিকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং বিভীষিকার দ্বারা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস-এর পাত্র পাত্রীরা কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত। যুদ্ধ আর প্রেম পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে আছে নানা বিভীষিকা, ভয় এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও।
হেমিংওয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার অর্জিত অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে এ উপন্যাসের কাহিনী নির্মাণ করেছেন। এ উপন্যাসের কাহিনী তৈরির পটভূমিকে পর্যবেক্ষণ করতে হলে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে সংঘটিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধই এর মূল পটভূমি। এ যুদ্ধে পৃথিবীর শীর্ষ শক্তিগুলো ক্রমান্বয়ে জড়িয়ে পড়ে। একদিকে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, তুরস্ক, বুলগেরিয়া; অপরপক্ষে ফ্রান্স, গ্রেট বৃটেন, রাশিয়া, জাপান, বেলজিয়াম, সার্বিয়া, রোমানিয়াও পর্তুগাল।
উপন্যাসের মূল নায়ক লেফটেন্যান্ট হেনরি আমেরিকান বংশোদ্ভূত, কিন্তু সে ইতালিয়ান রেডক্রসের এ্যাম্বুলেন্স বাহিনীতে যোগদান করে। অন্য দিকে যুদ্ধে উপন্যাসের নায়িকা ক্যাথরিন বার্কলি ইতালিয়ান বংশোদ্ভুত, কিন্তু সে কাজ করছে আমেরিকান রেডক্রস পরিচালিত একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে। উপন্যাসের নায়ক হেনরি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, এবং সেখানেই নার্স ক্যাথরিনের সাথে তার পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ই শেষে চূড়ান্ত প্রেমের দিকে মোড় নেয়। তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে বলে একে অপরকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
হেমিংওয়ে পুরোপুরি তার সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসে বর্ণিত প্রেমিক যুগল অর্থাৎ হেনরি ও ক্যাথরিন দু জনের দৈহিক মেলামেশার কারণে ক্যাথরিন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে এবং হাসপাতালে শিশু জন্মের সময় মা ও শিশু দু জনেই মারা যায়। হেমিংওয়ের ব্যক্তি জীবনের দিকে তাকালেও আমরা প্রত্যক্ষ করি যে, হেমিংওয়ে যখন যুদ্ধ ক্ষেত্রে মারাত্মক ভাবে আহত হন, তখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী পলিন দীর্ঘ সময় ধরে যন্ত্রণা ভোগ করার পর তার অস্ত্রোপচার করা হয় এবং পলিন দেহত্যাগ করে।
হেনরি আমেরিকান, কিন্তু ইতালির পক্ষে, এটা বড়ো কোনো বিষয় হয়ে উঠেনি। এ উপন্যাসে। এখানে নায়িকা ক্যাথরিনের হেনরিকে যুদ্ধের ডামাডোল ও ভয়াবহতা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার যে আকুলতা, এটা গভীর এক মানবিক মর্মবেদনা নিয়ে হাজির হয়েছে। যুদ্ধের এই ভয়াল রূপকে প্রত্যক্ষ করতে কৃ করতে তারা যেন ক্লান্ত। নিজেদের তারা সরিয়ে নিতে চেয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে, সুখী গৃহকোণে। মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস ফেলতে চেয়েছে তারা যুদ্ধের ও বিষবাষ্পকে পরিহার করে।
একদিকে যুদ্ধের ডামাডোল, নানা প্রতিকূলতা, সন্দেহ, সংঘাত— এসব উপেক্ষা করেও প্রেম তার গতিবেগ অব্যাহত রেখেছে। সব শেষে অন্তঃসত্ত্বা ক্যাথরিনকে নিয়ে হেনরি নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে স্কটল্যান্ডে হাজির হয়েছে। সেখানেই মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে ক্যাথরিনের শিশু জন্মের সময়। মোট কথা যুদ্ধ আর প্রেম এ উপন্যাসে গভীর এক আবহ নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছে। কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত এবং ভয়াবহতাই যে প্রেমের পথকে রুদ্ধ করতে পারে না, এ উপন্যাসে হেমিংওয়ে সে বিষয়টিকে পরিচ্ছন্ন একটি মাত্রা প্রদান করেছেন।
প্রিয় লাইন:
- ১."আমাকে যেমন করে ভালোবেসেছ অমন করে আর কাউকে ভালোবাসবে না তো? আমাকে যা যা বলতে আর কাউকে তা বলবে না বলো।"
- ২.“আমি সব সময়ই তোমাকে ভালোবাসব।
- ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসব---- ঝড়ে-বৃষ্টিতে, তুষারে-তুফানে শিলাবৃষ্টিতে, ধ্যৎ! এই আর কী কী দুর্যোগ আছে বলো না?"
- ৩.“আমি জানি যুদ্ধ অতি মন্দ জিনিস, তবু আমাদের একাজ চালিয়ে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত।'
- ‘যুদ্ধ কখনো শেষ হয় না লড়াই-এর শেষ নেই।"
##########
এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
অনুবাদক: অধীর দাস
প্রকাশক: ফ্রেন্ডস বুক কর্ণার, ঢাকা।
প্রকাশকাল: ২০১১
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৫৬
মুদ্রিত মূল্য: ৯০.০০ টাকা
ISBN: 984-643-147-3
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম