পুতুল নাচের ইতিকথা - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | এস. এম. নুরুন নবী

পুতুল নাচের ইতিকথা - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কে রিভিউ করার মতো যোগ্যতা, সামর্থ্য বা স্পর্ধা আমার নেই, আর কোনদিন হবে বলেও আমার মনে হয় না। পাঠ্যপুস্তক হিসেবে 'পদ্মা নদীর মাঝি' পড়ার পর এই প্রথম শখ ও সাহস করে 'পুতুল নাচের ইতিকথা' পড়া।ইন্টারমিডিয়েট পড়া আমার মন ও মস্তিষ্ক নিয়ে তখন মানিক বাবু সেভাবে খেলে উঠতে না পারলেও, আমার বর্তমান মন বা মস্তিষ্ক নিয়ে কেমন একটা ছেলে খেলাই খেলে ফেললেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাস দিয়ে।

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বা সাইকোলজিক্যাল নভেল বলতে যা বোঝায়, পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসখানা তার সার্থক উদাহরণ।

প্রথমত, মূল চরিত্র -শশী নিয়ে একটু লিখি। সাধারণত লেখক যখন কোন চরিত্র বেঁধে ফেলেন বা চরিত্রের কাঠামো তৈরি করেন, লেখার শেষ পর্যন্ত সেটা আর ভাঙার সাহস দেখান না। যদিও বা কেউ কেউ ভাঙার সাহস দেখিয়েই ফেলেন, সেটাকে জাস্টিফাই করে দেন ঘটনার ঘূর্ণ আবর্তনে। অথচ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কী অবলীলায় 'শশী' চরিত্রটুকু নিয়ে ভাঙা গড়ার খেলা খেললেন। সেই সাথে যেন আমার সাথেও এক লুকোচুরি খেলা হয়ে গেল।

আমি কী চাই??? এই প্রশ্ন নিয়ে যতটুকু না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি জুড়ে থাকে বৈষয়িক বিষয়াদি। এই দেখুন না- শশী অনেকদিন ধরেই ভালোবাসে কুসুমকে, অথচ বেখেয়ালি বন্ধুর ভালোবাসার 'ফাঁদ' হতে বাঁচাতে বিয়ে করতে চাইলো মতিকে....!

আবার যে সেনদিদিকে বাঁচাতে নিজের পিতা ও সেনদিদির স্বামীর কত অপমান, কত লাঞ্ছনা সহ্য করে বসন্তের চিকিৎসা দিয়ে গেছে, অথচ পরে কত অবলীলায় সেই শশীই সেনদিদির মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া দেখলো।

কিংবা কত দিনের অব্যক্ত ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও কুসুমকে বেঁধে রাখার সাহস করতে পারলো না শশী, অথচ মুখ ফুটে বলেই দিয়েছিলো।

আমার নিজের মধ্যেই প্রশ্ন জেগে উঠে- আমি কী শশীর মতো? মনের কথা বলতে পারি না, আবার রাগ অভিমানও কম না। যাকে ভালোবাসি, তাকে বলা হয়ে উঠে না।

অন্যদিকে কুমুদ যেন আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যায়- আমিই যেন একটা পুতুল। জগৎ সংসারের এত সংস্কার ও নিয়মের বেড়াজালে আটকা পড়ে আমি যেন 'মেলার পুতুল নাচের' অনুষঙ্গ। সমাজ, পরিবার ও সংস্কার আমাকে যেভাবে নাচতে বলেছে- আমি ঠিক সেভাবেই নেচে চলেছি।

কুমুদ আমার গায়ে ঈর্ষা ধরায়, উড়ে বেড়ানোর লোভ দেখায়, ইচ্ছেমতো জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু আমি যে সমাজেরই পুতুল....! সমাজ যেভাবে আমাকে নাচতে বলবে, আমার তো সেভাবেই নাচার কথা। সেভাবেই নাচছি আমি।

উপন্যাসটির আরেকটি আনপ্রেডিক্টেবল চরিত্র- গোপাল, শশীর পিতা। খুবই বৈষয়িক, স্বার্থপর, চতুর ও বেনিয়া স্বভাবের গোপাল কেমন বুদ্ধি করে তার মেয়ে বিন্দুকে গছিয়ে দিলো 'পয়সাওয়ালা' নন্দলালের কাছে। অথচ সেই গোপালই শেষদৃশ্যে শুধু সন্তানের অজানাযাত্রা ঠেকাতে নিজে ঘর ছেড়েছেন, যেটা গোপালের সাথে যায় না।

উপন্যাসে বিন্দুও একটি ভাবনার উদ্রেক দিয়ে যাবে পাঠককে। নন্দলালের কারাগার হতে আকুল বিন্দু অকস্মাৎ মুক্তি পায় শশীর কল্যাণে। কিন্তু দিন কতক গড়াতে না গড়াতে ঐ কারাগারের জন্যই বিন্দুর জীবন ওষ্ঠাগত।  একরকম স্বেচ্ছায় ফিরে গেলো সেই চিরচেনা 'কারাগারে'।

মানব জীবনের অন্যতম কঠিন ও অপ্রিয় সত্য বেরিয়ে আসে এ অংশটুকু থেকে। জীবনের অনেক অপ্রিয় জিনিস ও ব্যক্তি আমাদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা। এপ্রিয় জিনিস বা ব্যক্তি হতে আমরা মুক্তি কামনা করি বটে, কিন্তু মুক্তি পেলে যে সেই 'সুখ' সহ্য করতে পারবো না, সেটাই শিখিয়ে যায় বিন্দু।

মানুষের মন আর চিন্তা নিয়ে এমন সর্বনাশা ছেলেখেলা করার অধিকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কোত্থেকে পেয়েছে জানি না। মানুষের মনে অস্তিত্বের প্রশ্ন, চাওয়া পাওয়ার সংশয় জাগিয়ে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত সংস্কার ও শৃঙ্খলা ভেঙে এক বেখেয়ালি কিন্তু স্বাধীন মানুষের স্বপ্ন দেখিয়ে মানিক বাবু যে আলাদা ঘরানার সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, তার জন্য পুরো বাঙালি জাতি মোহিত ও কৃতজ্ঞ থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ