পলাশ মজুমদারের ‘হরিশংকরের বাড়ি’ বইয়ের ভূমিকা

পলাশ মজুমদারের গল্পের বই ‘হরিশংকরের বাড়ি’

সমকালের উদীয়মান গল্পকার পলাশ মজুমদারের ‘হরিশংকরের বাড়ি’ বইয়ের একটি পরিচিতিমূলক রচনা ইতোপূর্বে ‘গ্রন্থগত’ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। বইয়ের ভূমিকায় গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট, পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে লেখক বেশ অকপটে নিজের মনোভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। আজ বইয়ের ‘ভূমিকা’ অংশটি লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশ করা হল।


‘হরিশংকরের বাড়ি’ গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পের প্রেক্ষাপট দেশ বিভাগ এবং বিভাগোত্তর দুই দেশে বাঙালির সমাজ ও জীবন। দেশভাগের কারণে মানুষের বাস্তুচ্যুতি, সামাজিক অস্থিতিশীলতা ও মানবিক বিপর্যয়। সে হিসেবে গল্পগুলো দেশভাগ ও দাঙ্গাসংশ্লিষ্ট। এই বইয়ের প্রতিটি গল্পে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রতিফলন, যার প্রভাব সমকালেও স্পষ্ট। বলা বাহুল্য, সুদূর অতীত ও বর্তমানের মধ্যকার যোগসূত্র স্থাপনের প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে গভীর চিন্তার সঙ্গে সম্পর্কিত।

ওই কঠিন সময়কে গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবিন্যাসের মধ্যে বিভিন্নভাবে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছি। এ সময়ে তার ধারাবাহিক পরিণতি রূপায়ণে আশ্রয় নিয়েছি বিভিন্ন কৌশল ও পন্থার। ঘটনা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে।

গল্পগুলো ধারণ করে আছে দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির বিচ্ছেদ-বেদনা, হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস। প্রসঙ্গক্রমে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। এসেছে অবাঙালি চরিত্র। গল্পগুলোতে ঢাকা-কলকাতা- আগরতলা-গৌহাটি, পশ্চিমবঙ্গ-পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ)- আসাম-ত্রিপুরা— এককথায় ঘুচে গেছে বাংলাভাষী অঞ্চলের ভৌগোলিক ভেদরেখা; যেন সবটুকু নিয়েই বাংলা দেশ—বাঙালির ভুবন। কেবল মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাতারের বেড়া—র‌্যাডক্লিফ লাইন।

গল্প লেখার কথা ছিল না আমার; কখনো ভাবিওনি। এক সহকর্মীর সঙ্গে বাজির জেরে দৈনিক বণিক বার্তার সাহিত্য পাতা সিল্করুটে একটি গল্প পাঠাই; পটভূমি দেশভাগ। গল্পটি ছাপা হয় যথাসময়ে। একই সঙ্গে আপ্লুত হই সম্পাদকের প্রশংসায়। বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাস। অনুপ্রাণিত হই আরও লিখতে। তৎক্ষণাৎ হাতে নিই ‘দেশভাগ এবং দাঙ্গা’ সিরিজের গল্প লেখার পরিকল্পনা। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে লেখা হয়ে যায় ১২টি গল্প —

  • মহানগরী
  • সোনার মানুষ
  • হরিশংকরের বাড়ি
  • মঙ্গলদ্বীপ
  • সহোদর
  • উদ্বাস্তু
  • র‌্যাডক্লিফ লাইন
  • বিধর্মী
  • দ্বন্দ্ব
  • সহযোদ্ধা
  • যাযাবর ও
  • চক্রান্ত


লেখা শেষে গল্পগুলো পাঠিয়ে দিই বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ, লিটল ম্যাগ ও সাহিত্য সাময়িকীতে। সম্পাদকরা ছাপান আগ্রহ ভরে। প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমির সাহিত্য সাময়িকী উত্তরাধিকারে, স্বনামধন্য লিটল ম্যাগ শালুক, শব্দঘর ও গল্পকারে, অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ ২৪.কমের আর্টস বিভাগে, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, বণিক বার্তা (সিল্করুট), দৈনিক সংবাদ (সাময়িকী), দৈনিক ভোরের কাগজ, সাম্প্রতিক দেশকাল ও দৈনিক সময়ের আলোর (আলোর রেখা) সাহিত্য পাতায়। এছাড়া ছাপা হয় কলকাতার দ্য নিউজ এক্সপ্রেস পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায়।

এক বন্ধু প্রশ্ন করেছিল — শুধু দেশভাগ নিয়ে গল্প কেন? আর কি বিষয় নেই? উত্তরে বলেছিলাম—

দেশভাগ আমার অন্যতম আগ্রহের বিষয়। ভাষার সূত্রে আমি বাঙালির ঐক্যে বিশ্বাসী, সে যে দেশে বা যে ধর্মের ছায়াতলে থাকুক না কেন। ১৯৪৭ সালে আমরা খণ্ডিত হয়েছি রাজনৈতিক কারণে, যার ফল ভোগ করছি এখনো। হয়তো করতে হবে আরও অনেক দিন।


ব্যক্তিগতভাবে দেশভাগের ভুক্তভোগী না হলেও আমার বেশ কয়েকজন প্রিয় মানুষ এ ঐতিহাসিক ঘটনার শিকার। আমি দেখেছি দেশহীন এসব মানুষের হাহাকার, যন্ত্রণা ও কষ্ট। বাস্তুচ্যুত এমন অনেক মানুষের দেখা পেয়েছি ত্রিপুরায়, আসামে, সিকিমে, মেঘালয়ে, দিল্লিতে ও কলকাতায়, এমনকি ঢাকাতেও। কান পেতে শুনেছি তাঁদের হৃদয়ের কথা। আর দগ্ধ হয়েছি তীব্র দহনে। তাঁদের সেই অব্যক্ত কথাগুলোই বিভিন্ন আঙ্গিকে গল্পে তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আপন খেয়ালে আঁকতে চেয়েছি নানা রকম ক্যানভাস।

ইতিহাসের এ স্পর্শকাতর বিষয়টি আমাকে প্রথম ভাবায় ১৭ বছর বয়সে। প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পূর্ব-পশ্চিম’ পড়ার পর। তাছাড়া আমার ভাবনার বিস্তারে ভূমিকা রেখেছেন কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, হাসান আজিজুল হক ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে প্রভাবিত হয়েছি সাদত হাসান মান্টোর দেশভাগের গল্প দ্বারা, যদিও সেই গল্পগুলো পাঞ্জাবের পটভূমিতে।

তারও আগে চারপাশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার ব্যবধান ও বৈষম্য, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দেশত্যাগ আমার বুকে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে বহুবার। কেন তাঁরা সব ছেড়ে চলে যায়? এই প্রশ্নে কেঁপে উঠেছে বুক।

বন্ধুকে ভারতে চলে যেতে দেখেছি নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়। দাদা ও বউদির কাছে। তার দাদাকে আগেই পাঠানো হয়েছিল কাকার বাড়িতে; কাকা সেখানে স্থায়ী হয়েছেন দেশভাগের পরপর। তাদের বাড়ির অন্য সদস্যরাও দেশ ছেড়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে। যে বাড়িটিতে একসময় মানুষে গমগম করত, তা ধীরে ধীরে জনশূন্য হতে থাকে। পনেরোটি থেকে পরিবার এসে ঠেকে একটিতে। সবশেষে ওই পরিবারও চলে যায় এক মুসলমান ব্যবসায়ীর কাছে বিশাল বাড়িটি স্বল্প দামে বিক্রি করে। আমি জানি, এই নীরব প্রস্থানের কারণ সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাবোধ, আর কিছু নয়।

এমন অসংখ্য ঘটনা আমি জানি। শুনেছি ভুক্তভোগীদের মুখে। ইতিহাসের এই ভুলকে কখনো আমি মেনে নিতে পারব না। ক্ষমা করতে পারব না দেশভাগের কুশীলবদের।

সর্বোপরি এটি ইতিহাসের নয়, গল্পের বই। ইতিহাসকে ছুঁয়ে যাওয়া কিছু মানুষের জীবন ও তাঁদের জীবনের ঘটনাকে উপজীব্য করে গল্পগুলো লিখতে সচেষ্ট হয়েছি। আর দেশভাগের শিকার এসব মানুষের কথাই আমি দ্বিধাহীন কণ্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণে বলতে চেয়েছি এ বইয়ের বিভিন্ন গল্পে।

-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-

হরিশংকরের বাড়ি
পলাশ মজুমদার


প্রকাশকঃ বিদ্যাপ্রকাশ
প্রকাশকালঃ ২০২০ একুশে বইমেলা
প্রচ্ছদ শিল্পীঃ মোস্তাফিজ কারিগর
পৃষ্ঠা: ১২৮
মূল্য: ২০০ টাকা
ISBN: 978-984-93698-4-4

পড়ুন:

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ