জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে - পলাশ মজুমদার

জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে - পলাশ মজুমদার

২০২২ সালের বইমেলায় প্রকাশিত "জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে" শিরোনামের গল্পগ্রন্থ নিয়ে লেখক পলাশ মজুমদার বিবিধ কথা বলেছেন। তুলে ধরেছেন বইটিকে ঘিরে পরিপার্শ্বের বৈচিত্রময় জীবনযাত্রার একাধিক টুকরো চিত্র। পাঠকের মননে নতুন গল্পগ্রন্থের একটা প্রতিচ্ছবি যেন ভেসে ওঠে সেই প্রত্যাশা থেকে প্রকাশ করা হল 'পলাশ মজুমদার' রচিত "জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে" নামক গল্পগ্রন্থের ভূমিকা।

জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে-এর গল্পগুলো ধারণ করছে একুশ শতকের প্রথম দুই দশকের সমাজ, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। মূল্যবোধ, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও পরিস্থিতিগত পরিবর্তন। এমন সময়ের কথা গল্পগুলোতে বলা হয়েছে, যখন প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যাচ্ছে এই দেশের মানুষ, বিশেষত তরুণসমাজ, একই সঙ্গে জনজীবন ও সমাজব্যবস্থা।

কোনো গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে প্রেম, কোনোটিতে বিরহ। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। কখনো শেয়ারবাজার, মাদক, অপরাধ, খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, পরকীয়া, যৌনতা। কোথাও জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতা। করোনাকালীন জটিল পরিস্থিতি। এসেছে পারিবারিক জটিলতা ও অসংগতি, যার অনুষঙ্গ পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি, বিবাহবিচ্ছেদ, মনোদৈহিক বিকলাঙ্গতা।

বেশির ভাগ গল্পই জীবন থেকে নেওয়া। চারপাশের ঘটনাগুলোকে বিভিন্ন আঙ্গিকের মাধ্যমে শৈল্পিক রূপ দিয়েছি। চেনাজানা মানুষের ভেতর থেকে অঙ্কন করেছি গল্পের চরিত্র; ঘটনা বিশ্লেষণে আশ্রয় নিয়েছি স্বতন্ত্র কৌশলের। বর্ণনা, উপস্থাপনার ভঙ্গি এবং গল্পের আঙ্গিক আমার নিজস্ব। কোথাও কৃত্রিমতা কিংবা কপটতাকে প্রশ্রয় দিইনি; কেবল গল্পের শৈল্পিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে প্রয়োজনে আশ্রয় নিয়েছি সৃজনশীল কল্পনার।

প্রযুক্তির উৎকর্ষে আমরা যেমন এগোচ্ছি, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়েও যাচ্ছি। প্রযুক্তির এই সর্বগ্রাসী থাবা থেকে মুক্তির উপায় কিন্তু নেই। অক্টোপাসের মতো মানুষ জড়িয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল জগতে; কমছে আবেগ, আবেগের জায়গায় স্থান নিচ্ছে রূঢ় বাস্তবতা, যার অভিঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে মানুষ। যন্ত্রসভ্যতার দাসত্ব করতে গিয়ে মানুষ হারিয়ে ফেলছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস। সুকুমারবৃত্তি। হয়ে পড়ছে অসহিষ্ণু। কখনো দানবের মতো হিংস্র। বীভৎস। কখনো পাশবিক প্রবৃত্তি ধারণ করছে চরম আকার।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীর শিক্ষা, অগ্রগতি ও স্বাবলম্বন দেশকে অর্থনৈতিক দিক থেকে নিয়ে যাচ্ছে উন্নতির শিখরে, পরিণত করে চলেছে মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে। অন্যদিকে স্বাবলম্বী মেয়েদের জীবন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন পাল্টে দিচ্ছে প্রচলিত সমাজ-কাঠামোর খোলনলচে। নারীর অগ্রযাত্রায় পুরুষের তাল মেলাতে না পারা, কখনো মেনে নিতে অস্বীকৃতি এবং তা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিবার ও সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে ভাঙনের দোরগোড়ায়। ভেঙে পড়ছে মূল্যবোধ; পরিবর্তন আসছে দৃষ্টিভঙ্গিতে। মানুষের সম্পর্কের মধ্যে আসছে বৈচিত্র্য।

আত্মসুখ অন্বেষণে মানুষ ব্যস্ত সময় পার করছে অন্তর্জালে, জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে ওঠা অচেনা অদেখা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে। কখনো সেই সম্পর্কের টানে ছেড়ে যাচ্ছে সংসার, আপনজন, জীবনসঙ্গী, এমনকি সন্তান। শিকার হচ্ছে ব্ল্যাকমেলের। ঘটছে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা। সম্মান রক্ষায় মেয়েরা বেছে নিচ্ছে আত্মঘাতী পন্থা।

তরুণদের কাছে বদলে যাচ্ছে জীবন ও জীবনযাপন সংক্রান্ত ধ্যানধারণা; উত্তরাধিকারের ধারণা হয়ে উঠছে অনাবশ্যক। অপ্রাসঙ্গিক। ফলে পরিবার নামক প্রাচীন সংগঠন হয়ে পড়ছে অকার্যকর। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে তার জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে লিভ টুগেদার বা চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক। বদলে যাচ্ছে যৌন-সম্পর্কের সংজ্ঞা। বংশ রক্ষার চিরাচরিত প্রথা। বাড়ছে সম্পর্কের টানাপোড়েন, নিঃসঙ্গতা, হতাশা আর অস্থিরতা।

নীরবে ঘটে চলেছে সমাজের এই পালাবদল। তরুণেরা কোনো বিষয় আর লুকিয়ে রাখার পক্ষপাতী নয়। এত দিন যে বিষয়গুলো গোপন রাখা হতো, সেখানে এই প্রজন্ম রাখঢাকের বিরোধী; তারা প্রকাশ্যে জানিয়ে দিচ্ছে তাদের মতবাদ, জীবন নিয়ে ভাবনা। এটি অবশ্যই ইতিবাচক, যদিও এর নেতিবাচক দিক স্পষ্ট।

সমাজ স্থানু কোনো প্রতিষ্ঠান নয়; বদলে যায় সময়ের তালে তালে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সমাজ পরিবর্তনশীল। এ সময়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষে বৈশ্বিক পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের প্রত্যন্ত জনপদেও। পরিবর্তনের এই দৃশ্য সবার চোখে সমানভাবে ধরা পড়ে না। এটি কেবল তারাই দেখেন, যারা সমাজকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।

পর্যবেক্ষণের মাত্রা ও স্বরূপ একেকজনের একেক রকম। সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজ পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত বিষয় নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেন। লেখক অবশ্যই সমাজবিজ্ঞানী। যে লেখক সমাজ পর্যবেক্ষণ করেন না, অনুধাবন করেন না চারপাশের মানুষের যাপিত জীবন, তিনি অবশ্যই তাঁর সময়কে লিখে যেতে পারবেন না; লেখা অসম্ভব।

একজন লেখক তাঁর সময়কে লেখেন। পরবর্তী প্রজন্ম পূর্বসূরির জীবনযাত্রা, সমাজবাস্তবতা, সামাজিক-পরিবর্তনসহ যাবতীয় বিষয় জানতে পারেন ওই সময়ের লেখকের লেখা থেকে। ব্যক্তিজীবনে লেখক যেমনই হোন না কেন, লেখায় তাঁকে সৎ হতেই হবে। তিনি সময়ের বুকে লিখে যাচ্ছেন অক্ষর, যা একসময় হয়ে উঠতে পারে সময়ের দলিল।

বলার অপেক্ষা রাখে না, মহৎ লেখক সমাজের মর্মমূলে আঘাত করেন, স্পর্শ করেন সমাজের অন্তরাত্মা। আঁকেন বিদ্যমান সমাজচিত্র ও সমাজের নানা অসংগতি। কখনো এমন সমাজের চিত্র আঁকেন, প্রণয়ন করেন রূপরেখা, যেভাবে তিনি দেখতে চান স্বপ্নের সমাজকে। ঠিক এই কারণে লেখকদের কখনো কখনো বলা হয় দ্রষ্টা।

এই কাজ করতে গিয়ে লেখক হয়ে পড়েন সমাজ ও রাষ্ট্রের চক্ষুশূল। ব্যতিক্রমের প্রতি গড়-মানুষের বরাবরই অস্বস্তি। অন্যদিকে রাষ্ট্র চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। আনুগত্যহীনতা কখনো সাব্যস্ত হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে। তখন রাষ্ট্র উপড়ে ফেলতে চায় লেখকের বিষদাঁত। লেখক গতানুগতিকতার ধারক নন; মনে-প্রাণে প্রগতিশীল। এই জন্য তথাকথিত সমাজপতি ও প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব।

এই বইয়ের গল্পগুলোতে বিভিন্নমুখী দ্বন্দ্ব উপস্থাপনে আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, অনুধাবন ও অনুমান, আবার কখনো কল্পনা-শক্তিকে ব্যবহার করতে সচেষ্ট থেকেছি; তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু দেখার ব্যাপারে কোথাও আপোস করিনি।

গল্পগুলোতে আমি গুরুত্ব দিয়েছি সমাজবাস্তবতাকে। সে হিসেবে গল্পগুলো বিদ্যমান বাস্তবতার অনুপুঙ্খ চিত্র। প্রতিনিয়ত মানুষকে অবলোকনের মাধ্যমে আমার মনে যে ধারণা জন্মেছে, তাকে নানা রঙেঢঙে নির্মোহভাবে গল্পের অবয়বে উপস্থাপন করেছি। পাঠক যদি গল্পগুলোতে নিজেকে এবং চারপাশের মানুষকে খুঁজে পান, তবেই বুঝব এই সিরিজের গল্প লেখা সার্থক।

-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-:-


জনৈক বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যা প্রসঙ্গে
পলাশ মজুমদার


প্রকাশকঃ বিদ্যাপ্রকাশ
প্রকাশকালঃ ২০২২ একুশে বইমেলা
প্রচ্ছদ শিল্পীঃ রাজীব দত্ত
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৪৪
মূল্য: ২৩০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ