একটি সাধারণ প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা 'নৌকাডুবি' হতে এত ঝঞ্ঝা, এত গল্প, ঘটনার মারপ্যাঁচ বের করে আনা সাধারণ মানুষের যে কর্ম নয়, সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া আর কে দেখাতে পারতো...! 'নৌকাডুবি' উপন্যাসের মত সংশয়ী ও অকূলপাথার টাইপ কাহিনী বুনন আমার ছোট্ট অভিজ্ঞতায় আজো বেশ দুর্লভ।
আজ প্রায় ১১৫ বছর হলো 'নৌকাডুবি' প্রকাশের। শতবছর আগে বাংলা ও বাঙালির নানা রকম সংকীর্ণতা, সীমাবদ্ধতা ও সংস্কারের ইতিহাস আজ আমাদের পাঠ্য। অথচ সে সময়েও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আধুনিকতার পুরোধা। বৃটিশ মুলুকে নারীর ভোটাধিকার দেয়া হয় ১৯১৮ সালে, মার্কিন মুলুকে সেটা ১৯২০ সালে। কিন্তু তারও ১৪/১৫ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করে ফেললেন- 'হেমনলিনী' চরিত্র। শিক্ষিত, মার্জিত ও আত্মমর্যাদায় ভাস্বর এক নারী প্রতিমা। রবীন্দ্রনাথ পড়লে আমার যেন মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যেন নারী চরিত্রের প্রতিই মনযোগী ছিলেন চিরকাল। পুরুষ চরিত্রগুলো হয় অবহেলার, না হয় হেঁয়ালীর পাত্র। শুধু কাহিনীর প্রয়োজনেই পুরুষের ব্যবহার। ব্যবহার শেষ হলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়া। এই উপন্যাসেও একই ব্যাপার ঘটেছে বলে অন্তত আমার ধারণা। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমার অভিযোগ সম্ভবত চিরদিন থাকবে।
তবে উপন্যাসটির বেশ কয়েকটি বিষয় আমার কাছে বাঙালি সমাজের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে দিয়ে যায়। যেমন একটির বিষয়ে লিখছি। একবিংশ শতাব্দীর আজকের সময়েও, বাঙালি সমাজে কনের মা বরের সংসারে থাকবে, সেটা যেন অচিন্তনীয়। সাধারণ প্রতিষ্ঠা হলো- কনের মা কিভাবে বরের সংসারে এসে থাকবে???? কুটুম বলে দু-চারদিন বেড়ানো হলে, তা ঠিক আছে। কিন্তু স্থায়ী বসবাস.....? অসম্ভব!!!!
অথচ প্রগতিশীল রবীন্দ্রনাথ প্রায় শতবছর এরও আগে কত সাধারণভাবে রমেশের পিতা ব্রজমোহন বাবুকে দিয়ে এই সংস্কারভেদী কাজ করালেন। কন্যার মা'ও যে এসে বরকনের সাথে থাকতে পারেন, উপন্যাসের শুরুতে তা দেখিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও একটা বিষয় টেনে আনি। বিয়ের ফিরতি যাত্রাপথে পুরো বরযাত্রী ও কন্যার মাতা সহ অনেকেই নৌকাডুবি'তে পরলোকগমন করেন। বিজ্ঞান ও উৎকর্ষের আজকের দিনেও মেয়েটিকে সম্ভবত 'অপয়া' 'রাক্ষসী' বা হতভাগী আখ্যা দিতে কারও গলা কাঁপতো না। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে রমেশের মনে জায়গা করে দিলেন। সমস্ত পাঠককূলকে হতভম্ব করে রবি ঠাকুর কমলাকে সবার প্রিয় করেই গড়ে তোলেন, আঁচল ভরা ভালোবাসা দিলেন।
ভালোবাসা যে কত সহজ, সেটা পাওয়া যায় 'নৌকাডুবি' উপন্যাসে। যে রমেশ শহরের এফ এ পড়ুয়া মেয়েকে পছন্দ করে বিয়েতে ইতস্তত ছিলো, সে রমেশই নৌকাডুবির পর প্রায় জীবন্মৃত গ্রাম্য গরীব বালিকাকে দেখেই স্বগোতক্তি করলো-
ইহাকে যে বিবাহ সভায় কলরব ও জনতার মধ্যে দেখি নাই, সে ভালোই হয়েছে। ইহাকে এমন করিয়া আর কোথাও দেখিতে পাইতাম না। ইহার মধ্যে নিশ্বাস সঞ্চার করিয়া বিবাহের মন্ত্রপাঠের চেয়ে ইহাকে অধিক আপনার করিয়া লইয়াছি। মন্ত্র পড়িয়া ইহাকে আপনার নিশ্চিত প্রাপ্যস্বরূপ পাইতাম, এখন ইহাকে অনুকূল বিধাতার প্রসাদের স্বরূপ লাভ করিলাম।
নারীর এক ভয়ংকর শক্তির বিষয়টিও এখানে সামনে আসে। রমেশ তাঁর অজানা গৃহবধূর মুখখানা দেখে গৌরবে বুক ফুলিয়েছিলো পদ্মার চরে। ভুলে গিয়েছিলো হেমনলিনীর কথা। আবার ঘটনাচক্রে ঘোড়ার গাড়িতে হেমনলিনীকে দেখে পুনরায় মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলো রমেশ। কীসের শক্তি রমেশকে দিয়ে এমন করায়....? কে এমন করতে বাধ্য করে....?
একটি নিদারুণ সত্য বিষয় হলো- পুরুষের জীবন কাটে নারীকে কেন্দ্র করে। এই যে রমেশ, তাঁর জীবন একটা সময় হেমনলিনীকে কেন্দ্র করে যাপিত হতো। মাঝখানে এলো কমলা। আবার কমলার অন্তর্ধান এর মাধ্যমে রমেশকে নিয়ে একধরনের ছেলেখেলায় মেতে উঠে রবিঠাকুর। রমেশকে কতটা তুচ্ছ, কতটা অসহায় দেখানো যায়, তার প্রায় সবটুকু চেষ্টা ছিলো ভানুসিংহ ঠাকুরের ফন্দিতে। রমেশকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছেন লেখক, কোন নারীকে ততটা কষ্ট দিতে নিশ্চয়ই রবি ঠাকুরের হাঁত কাঁপতো। একজন পুরুষ হিসেবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরুষ চরিত্রগুলো নিয়ে যে ভীষণ রকমের ভাঙ্গাগড়ার খেলা খেলেন, তা নিয়েও আমার বিস্তর অভিযোগ।
ঘটনার ঘূর্ণন এত জটিল আকারে এসে দাঁড়ায় যে, এক সময় আমার মনে হয়, এই জটিলতার নিরসন হয়তো সম্ভব না। জটিলতা রেখেই পাঠকের হাতে তুলে দেয়া হবে ইচ্ছেমতো কল্পনার দায়িত্ব। কিন্তু সেদিকে গল্প যায়নি। অপ্রত্যাশিতভাবে কমলার বেঁচে থাকা, নলিনাক্ষ ডাক্তারের আবির্ভাব, খুঁড়োর বুদ্ধি, সব মিলিয়ে একটি পরিণতির দিকে এসেছে গল্প।
কিন্তু যে রমেশের ঘাড়ে চড়ে গল্প এগোলো, যে হেমনলিনীকে এত কষ্ট দেয়া হলো, তাদের মিলন শেষতক দেখতে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে একটা অংশের শেষ অঙ্ক মেলানোর ভার পাঠকের হাতেই থেকে যায়। রমেশকে নারীর মর্যাদা রক্ষায় এদেশ ওদেশ তাড়ানো হলো, শেষাঙ্কে রমেশকে একটু শান্তি, একটু ভালোবাসা দিলে রবি ঠাকুরের খুব একটা ক্ষতি হতো না বলেই আমার বিশ্বাস।
যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, এই উপন্যাসের নায়ক কে??? নায়িকা কে??? নানা বিজ্ঞজন নানারকম মত দিতে পারবেন, সে স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার অধিকার কারো নেই। ঐ একই স্বাধীনতায় আমার চোখে এ উপন্যাসের নায়ক- রমেশ, নায়িকা- কমলা। হোক না তাঁরা দুজন ভিন্ন পৃথিবীর মানুষ, হোক না তাঁদের আলাদা অক্ষ বা জোড়া আলাদা।
বৃত্তের বাইরে চরিত্রায়নই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চির অমলীন করে রেখেছে।
আজ থামি, এখন ঘটনার আবেশ উপভোগ করার পালা 🧡💚❤️
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম