রাহুল সাংকৃত্যায়ন পণ্ডিত ব্যক্তি। সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত প্রভৃতি ধ্রুপদী ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য সুপরিচিত। ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী। জ্ঞানসাধনা তার যাপিত জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। জ্ঞানান্বেষণে তিনি ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এশিয়া ইউরোপের অনেক দেশে। নিজেকে তিনি পরিচয় করিয়ে দেন ভবঘুরে হিসেবে। অনুবাদক মলয় চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'গ্রন্থ প্রসঙ্গে' অংশে বলেন-
পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন আমাদের কাছে অনেক পরিচয়ে পরিচিত, কিন্তু তাঁর অন্য সমস্ত পরিচয়কে ছাপিয়ে যে পরিচয়টা বড়ো হয়ে আমাদের সামনে আসে সেটা হল তাঁর পরিব্রাজক পরিচয়, যেটা তাঁর ভাষায় ভবঘুরে বৃত্তি। তিনি এশিয়া ইওরোপের বহুদেশ ঘুরেছেন কিন্তু হিমালয়ের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। হিমালয়ের এপারে লাদাখ, লাহুল, কিন্নরভূমি, গাড়োয়াল উপত্যকায় তিনি যেমন অনেকবার ভ্রমণ করেছেন, তেমনি ওপারে তিব্বতেও ভ্রমণ করেছেন একাধিক বার।
বইয়ের মূল ভাষা হিন্দি। প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৫৬ সালে। সেই সংস্করণের ভূমিকায় রাহুল সাংকৃত্যায়ন লেখেন-
'এশিয়ার দুর্গম ভূখণ্ডে' আমার ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কিছু যাত্রার বিবরণ। বাইশ তেইশ বছর আগে ওই যাত্রাগুলো হয়েছিল।
অনুবাদক মলয় চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্য থেকে জানি পাঁচটি দেশের ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে 'এশিয়ার দুর্গম ভূখণ্ডে' বইটি লিখিত। তিনি বলেন-
তাঁর বইটি শুরু হয়েছে লাহুল ভ্রমণ থেকে, তারপর তিব্বত, নেপাল, ইরান হয়ে আফগানিস্থান ভ্রমণের পর শেষ হয়েছে। এই ভ্রমণ যাত্রা একবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে হয়নি। দশ-পনেরো বছর সময় লেগেছে। ইরানে তিনি দশ-বারো বছরের ব্যবধানে তিনবার গিয়েছেন এবং ইরানের প্রাচীন ইতিহাস যুক্ত করে 'ইরান নামে স্বতন্ত্র একটা বই লিখেছেন যার মধ্যে তাঁর 'এশিয়ার দুর্গম ভূখণ্ডে' বইয়ের 'ইরান' অংশটি যোগ করেছেন। তেমনভাবেই তিনি 'আমার লাদাখ যাত্রা' বইয়ে 'লাহুল' পর্যায়ের ভ্রমণ বৃত্তান্তটি উপরোক্ত বই থেকে নিয়ে যুক্ত করেছেন।
এই কারণে আলোচ্য বইয়ে শুধু তিব্বতের চিঠি, নেপাল ও আফগানিস্তান ভ্রমণের অংশ আছে।
তিব্বতে তিনি হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন ভারতীয় বই খুঁজতেন। দর্শন, সাহিত্য, কাব্য, ন্যায় ইত্যাদি জ্ঞানভাণ্ডারের অনেক অমূল্য বই ভারতের ভূখণ্ড থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। অথচ আচার্য বসুবন্ধুর 'অভিধর্মকোষ', মহান দার্শনিক ধর্মকীর্তি রচিত 'প্রমাণবর্তিক' প্রভৃতি বই তিব্বতে পাওয়া গেছে। ভারতের পণ্ডিতগণ নেপাল-তিব্বতের বিভিন্ন মঠ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। তাদের অনুবাদকৃত বই তিব্বতের বিভিন্ন মঠে সংরক্ষিত আছে। অনেকে ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া, সাথে থাকা বই উপহার দিয়েছেন। রাহুল সাংকৃত্যায়ন এইসব প্রাচীন বইপত্র তিব্বত নেপালের মঠে থাকা লাইব্রেরিগুলোতে খুঁজেছেন।
এই বইয়ের তিনটি অংশের প্রথমটির নাম 'তিব্বতের চিঠি'। এই অংশে তিনি ভ্রমণপথের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রিয় বন্ধু কৌশল্যায়নকে চিঠি লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে প্রতিদিনের বৈচিত্র্যময় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আছে। ২৭/৭/৩৪ তারিখের চিঠি দিয়ে বইয়ের শুরু। এরপর ১/৮, ৪/৮, ৭/৮, ১০/৮ তারিখে চিঠি লিখেছেন। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাত্রা করেছেন। যেখানে রাত থেকেছেন, সময় পেলে সেখান থেকেই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতার বিবরণ তুলে ধরেছেন। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি সহজ। গল্প বলার নিপুণ শক্তি থাকার কারণে যাত্রাপথের দৃশ্যমান কোন কিছুর উপস্থাপন বাদ দেননা। স্থানীয় শব্দের উচ্চারণ যথাযথ রেখে দেন। নতুন ভাষার সাবলীল উপস্থাপনে রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা আরও অলংকৃত হয়, আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। 'গ্যাংচি' নামক স্থান থেকে লেখা চিঠির সূচনাংশ এরকম-
য়ুম-ডক হ্রদের এই উপত্যকায় ঠান্ডা খুব বেশি। উচ্চতা মনে হয় চোদ্দো হাজার ফুটের কম হবে না। আমরা আজ ভোর পাঁচটায় চলতে শুরু করেছি। রাস্তা যদি একদম সোজা সরল হত তাহলে আমার সঙ্গীদের মধ্যে যারা বেশ সুস্থ সবল, নঙ-গর্চে পৌঁছাতে তাদের তিন চার ঘন্টার বেশি লাগত না। কিন্তু আমাদের বিশাল হ্রদটাকে প্রায় চক্রাকারে পরিক্রমা করে নিতে হবে, রাস্তা সেরকম হবার জন্য ছয়-সাত মাইল অতিরিক্ত পথ চলতে হয়। এখান থেকে তিব্বতের অন্যতম বিখ্যাত জায়গা টশি-লুন-পোর দিকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে। পৃষ্ঠা- ৩১
বিভিন্ন মঠে আলাদাভাবে বইয়ের সংগ্রহ থাকে। হাজার বছর আগে থেকেই পুরনো মঠগুলোতে আলাদা পাঠাগার গৃহ থাকত। সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৪,৭১৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত স-ক্য বিহারের লাইব্রেরি থেকে লেখা চিঠিতে তিনি জানান-
এগারো দিন পর আজ আবার চিঠি লিখতে বসেছি। সারা সময় 'প্রমাণবর্তিকালঙ্কার' বইটি নকল করতে ব্যস্ত ছিলাম। 'প্রমাণবার্তিক' -এর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পরিচ্ছেদের মহাভাষ্য সম্বলিত এই বইটি খুঁজে পেয়েছি। বইটি খন্ডিত, আদিও নেই, অন্তও নেই। বইয়ের লেখক প্রজ্ঞাকরগুপ্তের সময়কাল মনে হয় অষ্টম শতাব্দী হবে। তিনি ধর্মকীর্তির শিষ্যপরম্পরার অন্তর্গত ছিলেন এবং ছন্দ নির্মাণে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। পৃষ্ঠা ৫৪ … আমরা আবার একটু বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি সুরু করেছি এমন সময় ধর্মবর্ধনের হাতে একটা কাগজে লেখা পুথি এসে পড়ল। পুথিটা লম্বা ২৭ ইঞ্চি আর চওড়া ৪ ইঞ্চি, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৯। সাধারণভাবে কাগজে লেখা পুথিকে আমরা তিব্বতি বই ভেবে ভালো করে না দেখেই রেখে দিতাম। কিন্তু ধর্মবর্ধনের হাতের পুথির পাতা উল্টে দেখি, এ তো ভারতীয় পুথি। বইটির বিষয় প্রমাণবার্তিকের ভাষ্য 'বার্তিকালংকার'। পুথিটি যদিও খন্ডিত কিন্তু ওটাকে পেয়ে যথেষ্ট আনন্দ হয়েছে। পৃষ্ঠা ৫৫
তিব্বতের স্থানীয় জনপদের নামগুলো এত মজার ও ধ্বনিমধুর যে লেখক সাবলীল দক্ষতায় শব্দগুলোর ব্যবহার করেছেন। একটি বাক্য এরকম-
বিকেল চারটের সময় এনম্ পৌঁছালাম। নে-বু-তঙ এর চো-লার জন্য তিং-রি থেকে চিঠি এনেছিলাম। পৃষ্ঠা - ৬৩
পথের বিবরণ দিতে লেখক কার্পণ্য করেননি। সরাসরি অভিজ্ঞতার বর্ণনালিখন বেশ দুরূহ। লেখকের সহজ স্বভাবশৈলীর কারণেও তাঁর বিবরণ সহজবোধ্য।
আজ সকাল সাতটায় বেরিয়ে জব-শো-লার দিকে চললাম। প্রথম দিকে চড়াই খানিকটা সহজ হওয়ায় খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম। তারপর যে চড়াই এল, তাতে চড়াই কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিল। একে তো দুর্গম পথ, তার ওপরে বৃষ্টিও পড়ছিল। তিব্বতের লা কিংবা জোতগুলো দস্যু তস্করের বিচরণের জায়গা, খুব সাবধানে চলতে হয়। জব-শো-লার চড়াইটা যেমনই কঠিন তেমনই বিস্তৃত। উচ্চতার জন্য ধর্মবধন হেঁচকি তুলতে লাগল। পৃষ্ঠা- ৩১
নেপাল ভ্রমণের সময়েও তাঁকে একের পর এক পাহাড় পার হতে হয়েছে। লেখকের বিবরণে যাত্রাটি এরূপ-
১৫ নভেম্বর খাওদাওয়া সেরে সকাল নটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়া হল। রাস্তা যেহেতু ওপরের দিক দিয়ে গেছে, সেজন্য আমাদেরও চড়াই ভাঙতে হচ্ছিল। ধর্মবর্ধনকে ভারবাহকদের সঙ্গে আসতে বলে আমি এগিয়ে গেলাম। সি-পা গ্রামে একটা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সংস্কৃত পাঠশালা আছে। কয়েকঘর ব্রাহ্মণের বসবাসও আছে এখানে। শেষ তিন মাইলের চড়াইকে সহজ চড়াই বলা যেতে পারে। চড়াই শেষে আবার সেই উতরাই। পৃষ্ঠা- ৬৯
নেপালে এসে লেখক দেখা করেন রাজগুরু মহাবিদ্বান হেমরাজ শর্মা'র সঙ্গে। তাঁর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে লেখকের বর্ণনা এরকম-
সমস্ত রকমের জ্ঞানচর্চার প্রতিই তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ। তাঁর কাছে হিন্দি-ইংরেজি ভাষার অনেক দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা আসে। সংস্কৃত ভাষায় হাতে লেখা দুর্লভ পুথিপত্র ছাড়া মুদ্রিত বইপত্রের একটা বিরাট সংগ্রহ তাঁর আছে আর সেই সংগ্রহকে আরও স্ফীত করেছে প্রচুর হিন্দি, ইংরেজি বই। পৃষ্ঠা- ৭০
পাহাড়ী পথে, চরম ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভ্রমণ করতে গিয়ে রাহুল সাংক্রত্যায়ন একাধিকবার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। নেপাল থেকে বিদায় নিয়েছেন অসুস্থ অবস্থায়। লেখক জানান-
৩০ নভেম্বর একটু জ্বর মতো এল এবং তা দ্বিতীয় দিনও থাকল। ২ ডিসেম্বর রাজগুরুর কাছে বিদায় নিতে গেলাম। আমার শরীরের অবস্থা দেখে রাস্তার জন্য দুটো ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। বেলা এগারোটায় তাঁরই মোটর গাড়িতে করে থানকোট পৌঁছালাম। সন্ধেবেলা জ্বর বেশ চেপে এল। জ্বর এবং চার পাঁচ দিনের উপবাসক্লিষ্ট শরীর নিয়ে পাঁচই ডিসেম্বর পাটনা পৌঁছালাম। ৪০ পাউন্ড ওজন কমে গিয়েছিল। পৃষ্ঠা ৭৪
প্রাচীন পুথিপত্রের জন্য তিব্বত ছিল লেখকের প্রিয় জায়গা। আফগানিস্তানে তিনি গিয়েছেন প্রাচীন ইতিহাস খুঁজতে। সেদেশের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা ভ্রমণ করে তিনি প্রাচীন আফগানিস্তানকে চিনতে চেয়েছেন।
আলোচ্য বইয়ে মাজার-এ শরিফ থেকে যাত্রাপথের বিবরণ পাওয়া যায়। আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে তখন ফরাসী পুরাতাত্ত্বিকরা খননের কাজ করছিল। কাবুলে যাওয়ার পথের ধারে তিনি ভ্রমণ করেছে 'বল্খ' নামক একটি প্রত্নস্থান। লেখক জানান-
দেখলাম মজুরেরা খুঁড়তে খুঁড়তে একটা বাড়ির ভিত বের করে ফেলেছে। বাড়ির দেয়াল পৌনে দুগজ মোটা আর ইটগুলো একফুট লম্বা এক ফুট চওড়া এবং পৌনে দু-ইঞ্চি মোটা। বল্খকে মাদরেশহর অর্থাৎ শহরের মা বলা হয় এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি বিশ্বের প্রাচীনতম শহরের একটি। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশো-ছ'শো বছর আগে যখন ইরানের অখামনশি সম্রাটদের রাজত্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও ইওরোপ, এই তিনদেশেই প্রসারিত ছিল, তখন বল্খ ছিল এক মহানগর। কোনো না কোনোভাবে যিশুখ্রিস্টের জন্মের এক হাজার বছর আগেও এই শহরের অস্তিত্ব ছিল। আলেকজান্ডারের আমলে বল্খ গ্রিক রাজত্বের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে মিনান্দারের (মিলিন্দ) রাজধানী ছিল বল্খ। পৃষ্ঠা - ৮২
আফগানিস্তান সম্পর্কে জানতে লেখক আফগান একাডেমিতে যান। সেখানে পরিচালক শাহজাদা আহমদ্ আলি খান দুরানি'র সাথে পরিচয় হয়। তিনি পণ্ডিত মানুষ। আফগান সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী। -
তাঁর ইচ্ছা, ধর্মের কারণে আফগান সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ভাষা চর্চা অত্যন্ত পিছিয়ে পড়ছে, তার প্রতিকার হোক। প্রতিটি পাঠান বামিয়ান, হড্ডা, বেগরামে পাওয়া উৎকৃষ্ট কলা শিল্পের জন্য গর্বিত হোক। তারা বলুক যে ওগুলো তাদেরই পূর্বজদের সৃষ্টি। তারা জানুক যে আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদের অনেক মহত্বপূর্ণ অংশের সৃষ্টি হয়েছে এই পাঠান মুল্লুকে, পাঠানদের মস্তিষ্ক থেকে। পাঠান জাতির মধ্য থেকেই পাণিনির মতো সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাকরণবিদের জন্ম হয়েছে। অসঙ্গ এবং বসুবন্ধুর মতো মহান দার্শনিকদের জন্ম এই পাঠান ভূমিতেই হয়েছে, যাদের সুগভীর জ্ঞানের প্রভাব শুধু মাত্র ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের ওপরেই পড়েনি, তাদের অনুগামী হবার জন্য চিন, জাপান, তিব্বতের বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরাও প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন। পৃষ্ঠা- ৯৮
আফগান একাডেমির পরিচালক শাহজাদা আহমদ্ আলি খান দুরানি ভাষাতত্ত্ব চর্চায় শিক্ষার্থীদের মত কৌতুহলী ও উৎসাহী। লেখক তাঁর সম্পর্কে জানান-
শ্রী ইয়াকুব হোসেন খান যদিও প্রথাগতভাবে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেননি এবং তিনি সংস্কৃতজ্ঞও নন, তথাপি তিনি যথেষ্ট প্রতিভাবান ব্যক্তি। পাঞ্জাবি, হিন্দুস্থানি, পশ্তো এবং ফার্সির ভালো জ্ঞান থাকার জন্য ভাষার মিল ও অমিলের দিকে তাঁর দৃষ্টি ভালো মতোই আকর্ষিত হয়েছিল।… তিনি প্রায় হাজার খানেক পশ্তো শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ আমার কাছে জানতে চান। পশ্তো ভাষাকে অনেকে টেনে হিঁচড়ে ফার্সির সঙ্গে মেলাতে চায়। কিন্তু ইয়াকুব হোসেন খান পাঞ্জাবি, হিন্দুস্থানি এবং কিছু ইওরোপিয়ান ভাষাতত্ত্ববিদদের সংগৃহীত সাদৃশ্য দেখিয়ে পশ্তোর সঙ্গে সংস্কৃতের মিল প্রমাণিত করেছেন। যখন আমরা দুজনে পশ্তো শব্দের সঙ্গে সংস্কৃত শব্দের মিল খুঁজতাম, তখনই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পশ্তো হচ্ছে সংস্কৃতেরই এক উত্তরাধিকার। তার উচ্চারণে এবং শব্দকোষে অবশ্যই খানিকটা ফার্সির প্রভাব পড়েছে, কিন্তু সংস্কৃতর তুলনায় তা নগণ্য। সংস্কৃত 'আপ' শব্দ ফার্সিতে 'আব' এবং পশ্তোতে 'ওবা' হয়। কিন্তু পশ্তো ভাষায় সেরকম শব্দেরই আধিক্য বেশি, যার সাদৃশ্য ফার্সির চেয়ে সংস্কৃতের সঙ্গেই বেশি। যেমন সংস্কৃত 'বারি' শব্দ পশ্তোতে 'বালি', সংস্কৃত 'তোয়' শব্দ পশ্তোতেও 'তোয়'। অনেক বৈদিক শব্দের প্রয়োগ পশ্তোতে দেখা যায় যেমন 'গিরীশ' থেকে 'গরসে' (পাহাড়ে বসবাসকারি), ‘আপসা' থেকে 'ওসে' জলবহনকারী। পৃষ্ঠা - ১০৭
কাবুলে একটি সিনেমা হল আছে। সেটা কখনও কখনও সারা সপ্তাহজুড়ে হাউজফুল থাকে। লেখক জানান-
আফগান আর হিন্দুস্থানি সংগীতের মধ্যে এত মিল আছে যে আফগানরা ভারতীয় ছবির গান খুব পছন্দ করে। পৃষ্ঠা - ১০৮
আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে লেখক ঘুরে বেড়িয়েছেন। পেয়েছেন ইতিহাসের নানাবিধ চিত্তাকর্ষক উপাদান। এমনও নিদর্শন আফগানিস্তানে পাওয়া গেছে, যা ভারতের কোথাও মেলেনি। আবার, ভারতীয় ইতিহাসের সংশ্লিষ্ট সূত্র আফগানিস্তানের প্রতিটি প্রত্নস্থানে পাওয়া গেছে। লেখকের ভাষ্যে-
বেগরামের খনন থেকে দেড় হাত লম্বা কাঠের একটা গঙ্গা-যমুনা মূর্তি পাওয়া গেছে। এটি গুপ্তযুগ কিংবা তার পরবর্তী কালে তৈরি। যদিও কাঠ অনেক জায়গাতে পচে গেছে তবুও স্ত্রী আকার, মকর (গঙ্গাবাহন), কচ্ছপ (যমুনাবাহন) -এর রূপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বেগরামের সেই ধনী গৃহস্থের বাড়ি থেকে প্রচুর কাচের পানপাত্র আর চষক পাওয়া গেছে। এই কাঁচের বাসনের বেশির ভাগটাই হয়তো রোম কিংবা গ্রিস থেকে এসেছিল। পৃষ্ঠা - ১০২
আফগানিস্তান থেকে ফেরার পথে সীমান্তের এক কাষ্টম অফিসের অভিজ্ঞতা ভিন্নরকম। লেখকের বিবরণে-
পাসপোর্ট অফিসার সাদুল্লা খান একজন তরুণ বয়স্ক পাঠান অফিসার। উনি অত্যন্ত সমাদর করে আমাকে বসালেন। প্রথমে তিনি আমার ভ্রমণ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, তারপর যখন জানলেন যে বৌদ্ধ সংস্কৃতি এবং ইতিহাস আমার অধ্যয়নের প্রধান বিষয়বস্তু, তখন তিনি সে বিষয়ে আরো জানতে উৎসুক হলেন। তিনি বললেন, আমি মর্দাতে থাকি এবং ওখানে মাটি খুঁড়ে বৌদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন (মূর্তি) পাওয়া গেছে। আসলে ওগুলো তো আমাদের পূর্বজদেরই সৃষ্টি। তাছাড়া ওই নিদর্শনগুলো প্রমাণ করছে যে একসময় আমাদের পাঠানদের তমদ্দুন (সংস্কৃতি) কত উন্নত স্তরের ছিল। উনি মর্দা যাবার জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানালেন। পৃষ্ঠা- ১১১
তিনটি স্থানের ভূমিরূপ আলাদা। তিব্বতে বরফঝরা ঠান্ডা, গাধার পিঠে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহাড়ের খাড়া চড়াই উৎরাই মেঠো পথ, নেপালের অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডা আর সরকারিভাবে তৈরি মসৃণ পাকা পথ, আফগানিস্তানের রুক্ষ্ম বৃক্ষহীন খয়েরী ঘাসে ঢাকা পাহাড়ি ঢাল; কাঁচা ভাঙ্গা রাস্তায় ট্রাকে করে ভ্রমণ – এমন বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা স্থান তিনটির উপহার। তিন স্থানের ভূমির গঠন ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। অতএব অভিজ্ঞতার এমন ভিন্নতা স্বাভাবিক।
জ্ঞানার্জনে যাত্রা বলে যাত্রাপথের ক্লেশ তাকে স্পর্শ করেনি। অসুস্থ হয়েছেন, শক্তি হারিয়েছেন, কিন্তু উদ্যোম ধরে রেখেছেন। বিশ্রাম নিয়ে একটু সুস্থ হয়ে রওনা হয়েছেন পরবর্তী গন্তব্যের পথে। ভ্রমণের নেশা তাকে কোন জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে দেয়নি। নতুন বই, নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার খোঁজে তিনি দিনের পর দিন পথে চলেছেন। ভবঘুরে বৃত্তি বেছে নিয়েছেন যিনি, জীবনের পথ তাকে ডাকবে। লেখক ভূমিকাতে বলেছেন-
যার মধ্যে ভবঘুরে বৃত্তির সুর জেগেছে তাকে কোনো বাধাই আটকাতে পারে না।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের লিখনশৈলী ও মলয় চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ অনবদ্য। পাঠক তিব্বত, নেপাল ও আফগানিস্তান ভ্রমণের বাস্তব অভিজ্ঞতা অনুভব করতে পারবে। মানশ্চক্ষে দেশ তিনটির বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতিকে দেখতে পারবে। চিনে নিতে পারবে নতুন নতুন প্রাচীন জনপদ। পাবে পর্যটনের অপার আনন্দ।
-=-=-=-=-=-=-=-=-=-
এশিয়ার দুর্গম পথে
রাহুল সাংকৃত্যায়ন
চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা
প্রথম প্রকাশ: ২০০৫, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ২০১০
প্রচ্ছদ: প্রণবেশ মাইতি
পৃষ্ঠা: ১১২
মূল্য: ৬০/-
ISBN: 81-85696-62-6
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম