মননশীল কবি শম্ভু রক্ষিত। তাঁর কবিতা সম্পর্কে রুচিশীল পাঠকের আগ্রহ আছে। জীবনকে তিনি দেখেন অন্য চোখ দিয়ে। পরিপার্শ্বের প্রাসঙ্গিকতা তিনি প্রকাশ করেন সহজ শব্দে, ভিন্ন ভঙ্গিমার অলংকরণে। উপমা নির্মাণে তিনি এক স্বকীয় শিল্পী। ভাবনা প্রকাশে দীর্ঘস্বর তাঁর বাচনভঙ্গির আরেকটি উপায়। গদ্যের আবছায়ায় ছড়িয়ে দেন কাব্যের সৌগন্ধ। পাঠক এক মৌলিক চিত্ররূপের দেখা পেয়ে বিহ্বল হয়ে ওঠেন। তৃপ্ত হয়ে আস্বাদন করেন নতুন কাব্যরূপ। 'শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কবিতা' বইয়ের শেষ ফ্লাপে কবির প্রবণতা ও রচনাশৈলী সম্পর্কে যে বিবৃতি রয়েছে তা মনোযোগী পাঠ প্রত্যাশা করে। সেগুলো মূল্যবান বিবেচনায় সম্পূর্ণ প্রকাশ করা হল। রচনাটির লেখকের নাম কোথাও উল্লেখ নেই।
এদেশি আধুনিকতার নিরিখে শম্ভু রক্ষিত ষাটের মাঝামাঝি উঠে আসা কবিদের একজন।
নানা বিচারের তাঁর শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতা নিয়ে শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কবিতা; এর নতুন সংস্করণে আরও কিছু কবিতা যুক্ত হয়েছে।
স্বয়ং কবি সতর্ক করেছেন, কবিকে তার জীবনানুষঙ্গে দেখার চেষ্টা আমরা যেন কোনভাবেই না করি। কবির ভিতর-বাহির অপাঙক্তেয়, অতএব সন্ধান যা করার করতে হবে তাঁর সৃষ্টি সমগ্রে— যে সৃষ্টিটি হওয়া চাই মৌলিক ও কালজয়ী।
ব্যক্তি শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কবি শম্ভু রক্ষিতের বিশেষ কোন তফাৎ নেই। দুটো জীবনই বেপরােয়া। তাঁর নিজের জীবনযাত্রা যেমন তার একান্তই নিজের তেমনি কবিতাও তার একেবারে স্বতন্ত্র।
তাঁর কবিতায় বহু ভাষার শব্দপ্রবাহ; সংস্কৃত, গ্রীক, ল্যাটিন, ইংরাজি, ফার্সি, আরবি, উর্দু, হিন্দী প্রভৃতি নানা ভাষা থেকে শব্দ আহরণ করে কবিতায় এমনভাবে ব্যবহার করেন যেন এইসব শব্দ তার বহুচেনা এবং এই বিশ্বাসকে সামনে রেখে তাঁর শব্দাবলী এক কাব্যিক অকাব্যিক ব্যবধান মুছে ফেলে অদ্ভুত ধ্বনিময়তার সৃষ্টি করে। আবার বিষয়ও নিয়েছেন নানান লােকাচার, মিথ, দর্শন, আধ্যাত্মবাদ, তাত্ত্বিককলা, বাউল, বাউণ্ডুলে থেকে বিজ্ঞান সব কিছু থেকেই। তিনি বাস্তব পরাবাস্তব মিলিয়ে কবিতায় এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করতে চান। তাঁর কবিতার এই স্বতন্ত্র চলন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারেনি।
পাঠকমাত্রেই জানেন, অবচেতনার সঙ্গে সুচেতনাকে মিলিয়ে জীবন-অভিজ্ঞতা পাঠ-অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ববােধকে যাঁরা কবিতায় ধরতে পারেন, তাঁদের সৃষ্টি বহুকাল পর্যন্ত অপরিম্লান থাকে। সেই রকমই এই আশ্চর্য বই শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কবিতা। এই আমাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রাপ্তি। এই শতকে পৌঁছে আশ্চর্য নবায়মানতা আমাদের ভাবিত করে -- এমন একটি গ্রন্থ সাহচর্যের মধ্যে আসার সুযােগ মিলল। যার কোন প্রতি তুলনা নেই।
মোট নয়টি কাব্যগ্রন্থ থেকে নব্বইটিরও বেশি কবিতা এই বইয়ে রাখা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি কবিতাই স্বাতন্ত্রচেতনায় বৈশিষ্টমণ্ডিত। যে কাব্যগুলো থেকে কবিতা নেয়া হয়েছে, সেগুলো হল:-
- সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ
- প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না
- রাজনীতি
- পাঠক, অক্ষরগুলি
- সঙ্গহীন যাত্রা
- আমার বংশধররা
- স্বরাহত নিষাদ
- আমি কেরর না অসুর
- ঝাড়বেলুনে জোট
এর মধ্যে 'স্বরাহত নিষাদ' কাব্যটি শুধু যৌথভাবে অন্যদের সঙ্গে রচিত।
বইয়ের প্রথমাংশে কবি নিজে 'সূচনা' শিরোনামে নিজের মনোভঙ্গির নানাদিক আলোচনা করেছেন। ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে লিখিত এই বক্তব্যের মাধ্যমে লেখক তাঁর চিন্তা জগতের নানাদিক উন্মোচন করেছেন। পাঠকের কৌতুহল বিবেচনায় লেখকের ভাষ্য সম্পূর্ণ প্রকাশ করা হল।
প্রায় তিনযুগ ধরে প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে সংকলনের জন্য কিছু কবিতা বেছে নেওয়া বেশ দুরূহ কাজ। এ কাজ এমনিতেই যথেষ্ট শক্ত। এক্ষেত্রে তিন যুগের শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন হিসেবে পাওয়াটা মুখ্য প্রচেষ্টা ছিল না। বিনয় বা অহংকার নয়, বলা আবশ্যিক, আমার অতি সামান্য কিছু কবিতার সঙ্গে শুধুমাত্র সাধারণের যাতে প্রাথমিক পরিচয় ঘটে, নানা দিক থেকে এটি সময়ের সঙ্গে আমার কবিতার নানা আমেজের নিবিড়তর সম্বন্ধস্থাপনের নিদৰ্শক হিসাবে তারা গ্রহণ করেন, আমার প্রয়াস সেই সুবিন্যাসটুকুর মধ্যে সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু এটাও সত্য, যােগ্যতর অথবা উজ্জ্বলতর কবিতা আমার নিশ্চয় থেকে যাবে।
এই গ্রন্থে অনেক ধরনেরই কবিতা রয়েছে। প্রত্যেকটিরই রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তবে এমনিতে কবিতাগুলাের কোন চরিত্র ও বয়স নেই। কবিতাগুলাের বড় গুণ এদের কোন রহস্য নেই। তবে তাদের নিজস্ব ওজন বা ভার আছে। তাদের দোলাতে হয়, চালাতে হয়। সত্যিই যদি জীবন ও কল্পনাকে একসুতােয় বেঁধে এদেরকে চালানাে যায়, নাড়াচাড়া করানাে যায়— বাস্তবের সত্যের থেকেও কবিতাগুলাের সত্য অনেক উজ্জ্বল হবে ও প্রভাব বিস্তার করবে। তাদের মধ্যে চারিত্র্য, ক্রিয়াকর্ম, ভাবনা প্রকাশ পেতে থাকবে। মানুষ দেবতা প্রাণী সমুদ্র প্রকৃতি—মহাকাশের সব কিছুকে বিদ্যুৎসম প্রভাময় বলে আমজনতা কাছে টেনে আনতে পারবে।
আর যেহেতু আমার কবিতা বিষয়ে কথা বলার, আমার শাস্ত্রীয় অধিকার নেই, কোন কবিতা শ্রেষ্ঠ তা নিয়েও আমার কোনও মতামত নেই, সেহেতু আমি সময়ের অনুগামী হব। এবং এসব ভেবেই আমি খুশি।
নতুন সংস্করণে কয়েকটি কবিতা সংযােজিত হল।
শম্ভু রক্ষিত
কবির আত্মসমালোচনামূলক বিনয় তার মননশীলতারই পরিচায়ক। আত্মপরিচিতি নিয়ে নিজের মধ্যে তাঁর কোন সংশয় নেই। তাই বোধহয় নিজের কবিতা বিষয়ে বলার অধিকার বোধ করেন না। তবে মনোযোগী পাঠক তাঁর কবিতার পাঠঅভিজ্ঞতা অনুভব করতে পারবে, বুঝতে পারবে কবি শম্ভু রক্ষিত সাধারণ নন। কবিতার অবয়ব, শব্দবিন্যাস, বাক্যগঠন, রূপকের অভিনবত্ব, উপমার নতুনত্ব সবকিছু মিলেই তিনি অন্যস্বরের দ্যোতনা ছড়িয়ে দেন। পাঠক শব্দবৈচিত্র্যের ভারবাহী না হয়ে বরং ভারমুক্ত হন। অবগাহন করেন কবিতাময়তার এক বর্ণিল স্বপ্নলোকে। শম্ভু রক্ষিত এখানেই আধুনিক, মৌলিক।
=:=:=:=:=:=:=:=:=:=:=
শম্ভু রক্ষিতের শ্রেষ্ঠ কবিতা
প্রকাশক: দি সী বুক এজেন্সী, কলকাতা।
প্রচ্ছদ: বাইজানটাইন মোজাইক
প্রকাশকাল: ২০১৫
পৃষ্ঠা: ১১২
মূল্য: ২০০
ISBN: 978-93-83816-21-7
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম