আলোচক: জালাল খান ইউসুফী
বাংলাদেশ গানের দেশ, মরমি সাধকদের দেশ। এদেশে অগণিত মরমি সাধক জন্ম গ্রহণ করেছেন। যারা জীবিতকালে অমূল্য সৃষ্টি তথা মণিমুক্তা রেখে গেছেন যা আমাদের লোক সংগীতের অমূল্য সম্পদ। বাউল গান বাঙালি সাংস্কৃতিক জীবনে উজ্জ্বল এক সংগীতধারা। যা বাঙালির সাহিত্য ও সংগীতে একটি স্বতন্ত্র আসন অধিকার করে আছে। বাংলার আকাশ-বাতাস, সবুজ শ্যামলিমা, হাওর-বাঁওড়, নদ-নদীর সঙ্গে বাউল ও বাউল গান মিশে আছে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাদের উপলদ্ধি বিচিত্র ও বহুমুখী। চিন্তাচেতনার প্রতিফলন ঘটেছে তাদের মরমি গানে। তাদের গান কেবল মরমি দর্শন চেতনাকেই সমৃদ্ধ করেনি, মরমি সংগীতের ধারাকেও করেছে সঞ্জীবিত।
মানুষ এখন ইচ্ছে করলে নানাবিধ উপায়ে মনোরঞ্জন করতে পারে বা সময় কাটাতে পারে। এখন সবার হাতের মুঠোয় রয়েছে পৃথিবী। যখন যা মন চায় গুগলে, ইউটিউব, ফেবুতে, টুইটারে সার্চ দিলেই মূহুর্তে পেয়ে যাচ্ছে সব কিছুই। টেলিভিশন দেখতে চাইলেও তা সম্ভব, পাশাপাশি নানাবিধ সংগীত, নাটক, সিনেমা পছন্দের শিল্পীর গান কোনো কিছুই বাদ নেই, সবই তাৎক্ষণিক চলে আসে হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইল হ্যান্ডসেটে। অথচ আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে দশ গ্রাম ঘুরে যেমন একটি টেলিভিশন পাওয়া যেত না, তেমনি একটি টেপ রেকর্ডারও গ্রামে দুষ্প্রাপ্য ছিলো। সে সময় মানুষ মনোরঞ্জনের জন্য পুঁথিপাঠের আসর, জারিগানের আসর, কবিগানের আসরে নিজেদের ব্যস্ত রাখতো। মাঝে মাঝে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাউলগানের আসর, পালাগান বা মালজোড়া গানের আয়োজন হতো। শরিয়ত মারেফতের পালা, গুরু শিষ্যের পালা, দাদী নাতিনের পালা ইত্যাদি ছিলো মানুষের মনোঞ্জনের উপায়। সেসময় বৃহত্তর সিলেটে ৫৫৫ টেপরের্কডারের বিস্তৃতি ছিলো। যাদের টেপ রেকর্ডার বাজাতে দেখেছি তারা সাধারণত বাজাতেন- ক্বারী আমীর উদ্দিন ও মুজিব সরকারের গান। সে সময় এ দুজন বাউল এতো জনপ্রিয় ছিলো যে সাধারণ মানুষ মনে করতো এ দুই বাউল ছাড়া আর কোনো বাউল নেই। যখন কোথাও এ দুজনের পালাগানের আসরের কথা শোনা যেত- পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখতো গ্রামবাংলার বুড়ো-যুবক-কিশোরের দল।
বাবা মায়ের শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে সন্ধ্যার পর ছুটতো সেই মালজোড়া গানের আসরে। দুই বাউলের বাক-বিতন্ডার মাঝেই চলতো অলিস্মরণ, নবীস্মরণ, আল্লাহস্মরণ, বিরহ বিচ্ছেদী গান- লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে..,আমার প্রতি ভালোবাসা থাকে যদি মনে.., যৌবন ফুলের মালা তোমায় পরাবো গলে.., তোমার প্রেমো পইরারে বন্ধু যাইমু নাকি মইরা.., লাইলাহা ইলল্লাহু মোহাম্মদ রসুল.., আমার কপালে জিয়ারত নসীব ওইবনি.., সয়াল জুড়ে শুনি তোমার দয়াল নামের ধ্বনি খাংগালের বন্ধুরে আমার বাসরে আইবায়নি। এমন অসংখ্য মনভোলানো মনজুড়ানো গানের গীতিকার, সুরকার কণ্ঠশিল্পী বাউল ক্বারী আমির উদ্দিন ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাউল সাধক। তার গানের কথা, সুর, পরিবেশন ভঙ্গি যেমন মানুষের কাছে মনোরঞ্জনের অবলম্বন ছিলো তেমনি বাচন ভঙ্গিমাও মানুষ খুব উপভোগ করতো। বর্তমানে সেই মালজোড়া বা পালাগানের যুগ নেই কিন্তু এখনো নানি-দাদি-চাচি-ফুফুদের মুখে মুখে আজো শোনা যায় ক্বারী আমির উদ্দিনের গান। এখনো যদি শোনা যায় যে ক্বারী আমির উদ্দিনের গানের আসর হবে কোথাও, নিঃসন্দেহে বলতে পারি তার গান শুনতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
সেই বাউল গানের জীবন্ত কিংবদন্তী ‘বাউল সাধক ক্বারী আমীর উদ্দিন জীবন ও আমিরী সংগীত’ গ্রন্থটিতে সেই সময় ও সেই বাউল ক্বারী আমির উদ্দিনের জীবনের নানা দিক ও গ্রাম্য বউ-ঝিদের মুখ থেকে সংগৃহীত কিছু গানের সমন্বয় করেছেন সাংবাদিক লেখক ও লোকসাহিত্য গবেষক এবং আমীর উদ্দিনের চাক্ষুষ মালজোড়া গানের শ্রোতা সফিকুল হাসান সোহেল। প্রায় পাঁচ হাজার গানের রচয়িতা ও গায়ক আমীর উদ্দিন নানা কারণে এখন যুক্তরাজ্যের স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। প্রায় নব্বই বছর বয়সী এই জীবন্ত কিংবদন্তী এখনো গান করেন। ইউটিউবে নিয়মিত তা পোস্টও করেন। বাউল সাধক ক্বারী আমির উদ্দিনকে জানার জন্য এ গ্রন্থটি বর্তমান একমাত্র মাধ্যম। লোক সাহিত্য গবেষকদের কাছে এই গ্রন্ত্রটি মনোযোগ ও গুরুত্ব দাবি করে। অসম্ভব জনপ্রিয় বাংলার অন্যতম বাউল ক্বারী আমীর উদ্দিন আহমদ। মরমী আকাশের এক উজ্বল নক্ষত্র। তাকে অনায়াসে বাউল, ফকির,সুফি সাধক ও বাউল কালের দিকপাল বলে অভিহিত করা যায়। সাধনার জগতে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জনে যারা সাফল্যের চরম শিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছেন ক্বারী আমীর উদ্দিন তাদেরই একজন। বাংলার লোকায়ত ধারায় লালন সাঁই, রাধারমণ দত্ত, হাসন রাজা, শিতালং শাহ,আরকুম শাহ,দুর্বিন শাহ, উকিল মুন্সি, শাহ আব্দুল করিম প্রমুখের ধারায় ক্বারী আমীর উদ্দিন অসাধারণ প্রতিভার সফল সাধকের নাম। তার সাধনাময় জীবনে সৃষ্ট সমৃদ্ধ গানের ভান্ডার মরমি চিন্তাজগতে ও বাংলাদর্শন পরিমণ্ডলে এক অনন্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমীরী সংগীত নামে আলাদা একটা আমেজ সৃষ্টি করেছেন বাংলার সংগীত অঙ্গনে। মালজোড়া গানের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী গায়ক আমীর উদ্দিন। আরেক দিকপাল দুর্বিন শাহের স্বার্থক উত্তরাধিকারী এই সাধক। তার রচনা, শব্দ চয়ন, গভীর অর্থবোধক শব্দ প্রয়োগ ইত্যাদিতে দুর্বিন শাহের প্রভাবে প্রভাবিত। অন্যদিকে হযরত শাহজালাল (রা.) এর বন্দনা সূচক গান জালালি সংগীত গেয়েও সমান জনপ্রিয় আমীর উদ্দিন। তার গানের ভাষার বিশেষত্ব ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপন শ্রোতাদের গভীর আনন্দের খোরাক যোগায়। সারা বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী সবার কাছে সমান জনপ্রিয় তিনি। তিনি যেমন একদিকে গানের রচয়িতা ও গায়ক তেমনি নিজের গানের সুরকারও। চিত্তবিনোদনের খোরাক যোগালেও তার এসব গানের মর্মকথা স্বতন্ত্র দর্শন হিসেবে বিভিন্ন পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে।
সব মিলিয়ে এই বাউল সাধককে নতুন করে পরিচয় করে দেয়ার জন্যই এই গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়েছে। স্বজীব ওয়ার্সীর প্রচ্ছদ বইতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে। এই গ্রন্থের মোট অধ্যায় ৬টি। শেষ অধ্যায়ে সংযুক্ত করা হয়েছে দেশ বিদেশে তুমুল জনপ্রিয় হওয়া তার গাওয়া প্রায় অর্ধশতাধিক গান। যা তার অমূল্য সৃষ্টি, পাঠককে তার সম্পর্কে বুঝতে সহায়ক হবে।
=-=-=-=-=-
বাউল সাধক ক্বারী আমীর উদ্দিন জীবন ও আমিরী সংগীত
সফিকুল হাসান সোহেল
প্রচ্ছদশিল্পী: স্বজীব ওয়ার্সী
প্রকাশক: কাব্যকথা
প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১
দাম: ৩০০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম