নিভৃতচারী লেখক হায়দার বসুনিয়ার উপন্যাস "হাতবদল": নুসরাত জাহান

নিভৃতচারী লেখক হায়দার বসুনিয়ার উপন্যাস "হাতবদল": নুসরাত জাহান


আমাদের জীবন অনেক সংক্ষিপ্ত। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে। সময়ের সাথে সাথে যেকোনো মুহূর্তে বদলে যেতে পারে অবস্থা কিংবা অবস্থান। যেকোনো মুহূর্তে ঘুরে যেতে পারে জীবন নদীর বাঁক। প্রত্যাহিক জীবনে এমনি সব মোড় ঘোরানো ঘটনার সমাহারে জীবনঘনিষ্ঠ কিছু বাস্তবতার সমন্বয়ে নিভৃতচারী লেখক হায়দার বসুনিয়ার উপন্যাস হাতবদল। যেখানে চিত্রিত হয়েছে সমাজ জীবনের নানা উত্থানপতনের গল্প।

জীবন প্রবাহের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। কেউ হয়ে আসে আলোর দিশারী আবার কারোর সংস্পর্শ আমাদের পিছিয়ে দেয় অনেকটা। হাতবদল উপন্যাসটিতেও গল্পের নায়ক ইয়াছিনের জীবনে আলোর দিশারী হয়ে আসে প্রতিবেশী এক কেতাদুরস্ত স্কুলশিক্ষক। যার ভাষ্যে উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ অবধি পুরোটাই বর্ণিত হয়েছে।

ইয়াছিন মিয়ার বাবা ঠেলাগাড়ি চালক ঝরু বক্স। একাই দুহাত আর গতর খাটিয়ে নুন তেল চাল ডালের সংস্থান করতে হয় পুরো পরিবারের। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা কোন বিপর্যয়ের কারণে একদিন গতর খাটাতে না পারলে তো রীতিমতো না খেয়েই থাকতে হয়। এমনি টানাপোড়েনের সংসারে বেড়ে উঠছিলো সুন্দর এবং মায়াবী চেহারার অধিকারী ছোট্ট ইয়াছিন। প্রতিবেশী মাস্টার সাহবের মনে মায়া জাগে ইয়াছিনকে দেখে। কিন্তু থানা পর্যায়ের একজন বেসরকারি হাইস্কুল শিক্ষককে সংসারে চালাতে যেখানে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়, মাস শেষে যে সংসার হিসেবের অংক সবসময় গরমিল থেকেই যায় সেখান থেকে সাধ থাকলেও অন্যকে সহযোগিতা করবার সাধ্য খুব একটা হয়ে ওঠে না।

সুযোগ বুঝে একদিন ইয়াছিনের বাবার কাছে প্রস্তাব করে ইয়াছিনকে স্কুলে দেবার। প্রথমে বিষয়টাকে গ্রাহ্য না করলেও পরে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করান মাস্টার সাব। নিজেই সাথে করে নিয়ে প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন এবং কাঁধে তুলে নেন টুকিটাকি খরচের ভার৷ এজন্য অবশ্য স্ত্রীর কাছ থেকে যথেষ্ট কটুক্তিও শুনতে হতো। কিন্তু ইয়াছিনের উত্তরোত্তর সাফল্যে এসব কিছু ম্লান হয়ে যায়। একইসাথে চলতে থাকে দুই সংসারের টানাপোড়েন আর ঘটনা-দুর্ঘটনার বিবরণ। চাপ সামাল দিতে মাস্টার সাব টিউশনি করাতে শুরু করেন ট্রেজারি অফিসার সাহেবের বাচ্চাদের। সেইসুত্রে তার সাথে কথা বলে ইয়াসিনকে অফিসের পিয়ন হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দেন। আর এতেই যেন ভাগ্য বদলাতে শুরু করে ইয়াছিনের।

পরে চাকুরীরত অবস্থায় বুদ্ধিমান ইয়াছিন কর্মদক্ষতার গুণে ইন্টারভিউ দিয়ে পেয়ে যায় কেরানির পদ। তারপর  খুব অল্প সময়েই বদলে যায় পুরো জীবন যাপন। মাস্টার সাবের ভাষ্যে,

ঠেলাগাড়ি টানা ইয়াছিন বর্তমানে ইয়াছিন মিয়া। বেতন পান মাসিক চার হাজার টাকা। কিন্তু উৎকোচের টাকায় পকেট ভর্তি করে রোজই বাসায় ফেরেন আনন্দিত মনে। তা দিনে ৪-৫শ বা হাজার। ইস্ত্রি করা শার্ট-প্যান্ট ছাড়া চলে না৷ অনেকের কাছ থেকে সালাম পান, সম্মান পান। কারও বাসায় গেলে চেয়ারে বা সোফাসেটে বসে আপ্যায়িত হন সুন্দরভাবে।

বাসায় এল প্যাটার্ন বিল্ডিং উঠাল ও। ফোন, রঙিন টিভি এল। সোফাসেট এল। বিল্ডিংয়ের মেঝে মোজাইক করা হলো। ডিশ অ্যান্টেনা সেট করা হলো ছাদে। বিয়ের বাজারে চড়া মূল্য উঠে গেল ইয়াছিন মিয়ার।


কথায় আছে একটা অন্যায় কিংবা পাপ হাজারটা পাপের জন্ম দেয়। ইয়াসিন মিয়ারও লালসা বাড়তে থাকে। শুধুমাত্র ঘুষ নেওয়া বা জাল দলিল করে অন্যের জমি দখলেই ক্ষান্ত নন। ক্লাবে যান, মহুরীর বাড়িতে যান। ঘোষণা দেন দ্বিতীয় বিবাহ করবেন। এদিকে এসব অবলোকনে মনে মনে বিব্রত মাস্টার সাব। অবশ্য নিজের সাংসারিক টানাপোড়েনে এসব নিয়ে ভাববার সময় কই তার। তিনি বলেন,

জীবনের জটিলতা, জীবনের সমস্যা কত যে অন্যমনস্ক করে দেয় মানুষকে। কত অসহায় বোধ করে মানুষ। কত ঘুম বিনষ্ট হয় রাতের দিনের, সমাধান না মিললেও বুক বাঁধতে হয় আশায়। অটল থাকতে হয় পর্বতের মতো।


এদিকে একেএকে বাবা-মায়ের প্রস্থানের পর ঘটনা-রটনা মিলিয়ে মিলিয়ে ইয়াছিনের জীবনও চলতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা দুর্ঘটনার মাধ্যমে ইয়াছিন পৌঁছে যায় জীবনের অন্তিম প্রান্তে। আর তার প্রস্থানের সাথেসাথে ঘটনা পরম্পরায় হাতবদল ঘটে তার রেখে যাওয়া স্ত্রী এবং সম্পদের। এখানেই হয়তো উপন্যাসটির নামকরণের সার্থকতা লুকিয়ে রয়েছে।

সবকিছু ছাপিয়ে উপন্যাসটিতে যে বিষয়টি হৃদয়ে নাড়া দেয় সে বিষয়টি হল আমাদের দেশে অবহেলিত শিক্ষকসমাজ। একজন বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক যে কত কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করে তার জীবন চালিয়ে নেন, এ উপন্যাসে তা খুব দরদ দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। গল্পের নায়ক ইয়াছিন কষ্ট করে একটা সময়ে অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এই ইয়াছিনও একজন শিক্ষকের হাত ধরেই ওপরে ওঠার সিঁড়ি পেয়ে যায়। অথচ যার হাত ধরে ইয়াছিন এত ওপরে ওঠে, সে শিক্ষক কিন্তু তার অবস্থার কোন পরিবর্তনে সক্ষম হননি। তিনি রয়ে গেছেন তিমিরে। আঁধারই যেন তার একমাত্র সম্বল। শিক্ষক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। উপন্যাসটি পড়ে শিক্ষক সমাজের প্রতি যদি আমাদের দায়িত্ববোধ জাগে তাহলেই লেখক সার্থক হবেন বলে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। পেশায় লেখক হায়দার বসুনিয়া নিজেও একজন শিক্ষক ছিলেন। হয়তো তার পেশাগত জীবনের উপলব্ধির চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। সব মিলিয়ে বইটি যেন সময়ের সাথেসাথে মুহূর্তেই বদলে যাওয়া জীবনের চমৎকার আখ্যান।

বাংলাপ্রকাশ এর প্রকাশক প্রকৌ. মেহেদী হাসান কর্তৃক প্রকাশিত ১১১পৃষ্ঠা বিশিষ্ট উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় নভেম্বর, ২০১৯। ধ্রুব এষ কর্তৃক প্রচ্ছদকৃত বইটির মুদ্রিত মূল্য ২৫০টাকা। বইটির ISBN : 978-984-429-220-8

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ