সবুজ থাকুক বন, আগুন সরাও
অক্ষত থাকুক বন,বণিক সরাও
কীভাবে বাঁচব বলো অরণ্য হারালে?
পেশায় একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত হলেও সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি প্রবল আকর্ষণ করে কবিহৃদয়।
প্রায়শ দেখা যায়, জীবন শেষ হয়ে আসে তবুও একটি ম্যাচিউর কাব্যভাষা কবিকে ধরা দেয় না। অভিজ্ঞতা এবং গভীরতর বোধের সঙ্গে সুনির্বাচিত শব্দের সেতুবন্ধন তৈরি হতে পারে এই স্বাতন্ত্র্য। যেখান থেকে তার আর ফেরার কোনো পথ থাকে না। এমতো স্বকীয়তা নির্মাণ করেছেন নব্বইয়ের দশকের শক্তিমান কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া। তাঁর "জিলিপি পাহাড়" কাব্যগ্রন্থে। এ প্রকাশ কবিরা দেখেন ফেলে আসা কূল চোখের সামনে ভেসে যাচ্ছে তুমুল প্লাবনে।এবং তারা নিরন্তর আবিষ্কার করেন নতুন নতুন দিগন্ত। ধ্যানস্থ এই ঋষির দিকে আমরা তাকিয়ে আছি।এরপর আর কী কী চমক অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
বাংলা কবিতায় কি অরণ্য বা পাহাড়ের বিশেষ উল্লেখ নেই? রবিঠাকুর তাঁর পয়ারে লেখা চৌদ্দ চরণে কবিতা বন এ অরণ্যের প্রায় সামগ্রিক নান্দনিকতাই চিত্রিত করেন।বনকে বলেন- বিচিত্র হিল্লোলে কত /খেলা কর শিশু সনে, বৃদ্ধের সহিত / কহ সনাতন বাণী বচন- অতীত। কিন্তু বিশ্ব ও বাংলা কবিতার নমুনা সমুহে অরণ্য ও পাহাড় পর্বতের উল্লেখ গুলো প্রায়ই পরিচিত ও প্রশস্তিমূলক কিংবা নির্দ্বন্দ্ব। আমাদের কবি ভাগ্যধন বড়ুয়ার প্রতিপক্ষ প্রকৃতিবিনাশী পুঁজিবাদ।
জিলিপি পাহাড় অপার কৌতূহলের বীজবপন করেছে। এর ভেতর দিয়ে জীবনের নয়াসুর ধ্বনিত হচ্ছে, অতিক্রমণের উল্লাস পাওয়া যাচ্ছে। নানারঙা পক্ষির কূজন, পোকামাকড়ের নড়নচড়ন, সবুজ-হলুদ অতঃপর ঝরে পড়া পাতাদের কনসার্ট, পিপঁড়ের সারি, প্রজাপতির ওড়াউড়ি, তেজিরোদের বাহার, কূয়াশার কুহক, ছায়ার আল্পনা, জ্যোৎস্নার আভা,অন্ধকারের রীতিনীতি, বনদেবী, জোনাকি, কীটপতঙ্গ, বাকলের বিদার, মুলিবাঁশ, দূর্বাঘাস, শিশিরের চমক, কাঁঠালের মুচি বাঁশ পাতার মর্মরঃ এইসব আঁতিপাঁতি পাঠকের স্নায়ুতে দূরাগত শুশ্রূষা হয়ে আসে.....
এই কাব্যগ্রন্থের ফ্ল্যাপ অংশে লিখেছেন কবি ও সম্পাদক ওবায়েদ আকাশ। কবি ও কথাসাহিত্যিক খালেদ হামিদী এবং কবি, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক হাফিজ রশিদ খান।
জিলিপি পাহাড় মূলত প্রকৃতিপ্রেমের কাব্য। কেননা পঙক্তিমালাজুড়ে প্রকৃতির বর্ণনা চোখে পড়ে। পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গপুরান, মাটি, বালি ঝরাপাতা, পাহাড়, অরণ্য, বহুরঙা প্রজাপতি, বৃষ্টি, রোদ ছায়া পাখির কিচিরমিচির শব্দ, বিভিন্ন ঋতু বর্ণনা, কূয়াশা, নীলজল, নদী সমুদ্র, কাঁঠাল, শিলাবৃষ্টি, ফুল ফল কিংবা মূলে বংশের বীজ। পাখির পালক, ভ্রমণ কথন, পুকুর, সূর্যরশ্মির তাপ, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতির কথা বারবার কবিকন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। যা কবির লিখনিতেই প্রমাণ পাওয়া যায়।
কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া এর জিলিপি পাহাড় কাব্যগ্রন্থের এক একটি কবিতা এক একটি সত্যধ্বনি উচ্চারণ। অত্যন্ত সহজ, সরল, সাবলীল ভাষার প্রকাশ করে তিনি কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছেন। গ্রন্থটির ভাষায় কোনোপ্রকার জটিলতা বা আড়ষ্টতা লক্ষ্য করা যায়নি। আশা করি পাঠক বইটি পড়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করবেন।
জিলিপি পাহাড় এই গ্রন্থের কিছু চমৎকার নান্দনিক পঙক্তিমালা যা বারবার পড়ে চোখে ----
একাও ফেরা যায় সাঁঝের বেলায় যেভাবে এসেছি একা শিউলি- সকালে...
অরণ্য সবুজে লুকায়িত থাকে অবুঝ উন্মাদনা, মাতালরহস্য, ডালিম ফাটার মতো নিজেকে উন্মুক্ত করার ধারাপাত!
চৈতন্য গলিতে গলাগলি করে আছে বিদায়ী সূর্যরশ্মি আর আমার না বলা আজকের কথাসব...
তোমার কাছে অরণ্যপাঠ আমার অনন্য জীবনপর্ব...
বৃক্ষ আমার মা, একটু ছায়া দাও, শ্বাস নিই....
আমার আনন্দ বেদনা অনুভবে প্রত্যক্ষ সংযোগ তোমার, তার সাক্ষ্য দেবে অক্ষপথে ঘূর্ণমান নক্ষত্র আর জিলিপি পাহাড়ের বৃক্ষ!
সূর্যের শেষ রেশ যখন আবেশ ও আবেগ বাড়িয়ে বটবৃক্ষের ছায়াকে পূর্বপ্রান্তে প্রলম্বিত করে তখন ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে সংকুচিত হতে থাকে যাবতীয় অনুষঙ্গ...
আইয়ো, সামনে শীতের আগেই কটা যুগল দিন কাটাব পাহাড়ি টংঘরে, খাওয়াব মাতামুহুরির শোল আর চরের বাতাসে বাড়ন্ত বোত্তা শাক।
জিলিপি পাহাড় থেকে যত দূর দৃষ্টি নিক্ষেপ করি ততই
মনে হয় কুয়াশার আবরণে ঢাকা শূন্যতা আর আনত দৃষ্টিতে কাছে দেখলে অবতলীয় বুকে সবুজের বিচ্ছুরণ!
আর আমি পাথর গর্ভে জন্ম নেয়া জাতকের সহচর হয়ে
বাধাহীনে বিচরণ করি পৃথিবীর তাবৎ পাহাড়ে....
এটি মুলত প্রকৃতিপ্রমের কাব্য। তবুও কিছু কিছু লেখায় সমসাময়িক বিষয়ের উচ্চারণ শুনা যায়। তিনি তাঁর কাব্যময়তার মাধ্যমে অত্যন্ত শিল্পসমৃদ্ধ করে তুলেছেন।' জিলিপি পাহাড় -- কবিতাগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাতে তিনি সুন্দর সুন্দর ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, আছে মানবিকতার বিশুদ্ধ উচ্চারণ।
বই বাইন্ডিং চমৎকার। প্রচ্ছদখানা অদ্ভুত সুন্দর। সঠিক শব্দপ্রয়োগ, শব্দ অলংকারের মুগ্ধতা জানিয়ে দিলাম। পাঠকমন কবির পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ পাঠের প্রতীক্ষায় ব্যাকুল।
লেখক ভাগ্যধন বড়ুয়ার প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থঃ-
অপর পৃষ্ঠার বৃত্তান্ত ( ২০১৪)
নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ (২০০১৬)
লাভ লেইন (২০১৯)
Behind the page (2020)
জ্বর ও নজর ( ২০২১)
==============
বই- জিলিপি পাহাড়
লেখক - ভাগ্যধন বড়ুয়া
প্রচ্ছদ - নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান - খড়িমাটি
প্রথম প্রকাশ- ফ্রেরুয়ারী ২০২০
দ্বিতীয় প্রকাশ - ফ্রেরুয়ারী ২০২১
বিনিময় ১৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৪ টি
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম