প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন রচিত ভারতবর্ষ ভ্রমণ বিষয়ক বই "ফা-হিয়ানের দেখা ভারত"। ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন 'শ্রী কৃষ্ণচৈতন্য মুখোপাধ্যায়'।
চীনাভিক্ষু ফা হিয়েন ৩৯৯-৪১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন জায়গা বিশেষত বৌদ্ধধর্মীয় তীর্থস্থানসমূহ ভ্রমণ করেন। এই সময়কালে বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন ও তত্ত্ব সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করে স্বদেশে ফিরে গিয়ে সেগুলো প্রচার করেন। স্বদেশে ফেরার পথে তিনি শ্রীলঙ্কা, যবদ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। ভারতে তিনি প্রবেশ করেন স্থলপথে গোবি মরুভূমির রুক্ষ পথ পেরিয়ে। আর ফিরে যান সমুদ্রপথে বেশ কয়েকটি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর পেরিয়ে। প্রায় ১৪ বৎসরের এই মহাভ্রমণের সময় ভারতবর্ষ ও ভ্রমণপথের অন্যান্য জায়গা থেকে তিনি বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের বিভিন্ন পুঁথি, চিত্র প্রভৃতি সংগ্রহ করেন। ৪১৩ খ্রিষ্টাব্দে ৭৯ বৎসর বয়সে স্বদেশে ফিরে আসেন। পরের বৎসর ৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে নিজের ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রকাশ করেন 'ফে-কিউ-কি' নামে। এর অর্থ 'বুদ্ধভূমির বিবরণ'।
অনুবাদক তাঁর 'অবতরণিকা' অংশে জানান-
ফা হিয়েন ছয় বৎসরকাল ভারতে অবস্থান করেছিলেন। তিনি ভারতের বহু নগর ও বৌদ্ধ তীর্থস্থান যথা মথুরা, কনৌজ, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, কুশীনগর, বৈশালী, পাটলীপুত্র, রাজগ্রহ, গয়া, বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা ও তাম্রলিপ্তি পরিদর্শন করেছিলেন। তাঁর বিবরণের বিষয়বস্তু প্রধানতঃ বৌদ্ধধর্মশাস্ত্র, বৌদ্ধকাহিনী ও বৌদ্ধকীর্তিকলাপে পরিপূর্ণ। তথাপি তাঁর উপরোক্ত গ্রন্থে ভারতের প্রসিদ্ধ স্থানসমূহের পরিচয়, বৌদ্ধধর্ম্মের তৎকালীন অবস্থা ও ভারতের সভ্যতা সম্বন্ধে আমরা একটা আভাস পাই। পৃষ্ঠা- ১৫
ফা-হিয়েনের এই ভ্রমণবৃত্তান্ত 'ফে-কিউ-কি' বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মি ভিনসেন্ট ১৮৮৬ সালে মি. জেমস লেগের করা ইংরেজি অনুবাদকে সবচেয়ে প্রমাণ্য ও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। বাংলা রূপান্তরের ক্ষেত্রে মি. লেগ এর অনুবাদকে গ্রহণ করা হয়েছে।
বইটি মোট ২২টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। বইয়ের সূচনাংশে ফা-হিয়েনের ভারত ভ্রমণপথের একটি মানচিত্র রয়েছে। ম্যাপ থাকায় পাঠকের সুবিধা হয়েছে। এর দিকে একবার তাকিয়ে ভারতভ্রমণপথের সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত স্থানগুলোকে দেখা যায়।
ফা হিয়েনের জন্ম চীনদেশের চ্যাংগান অঞ্চল। এখানেই তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন। জন্মস্থান থেকেই তিনি ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। যে পথে ভারতে প্রবেশ করেন, তার একাংশ মরুভূমির ওপর দিয়ে। ফলে সহগামী ভারতযাত্রীদের নিয়ে বেশ সমস্যায় পরেছিলেন। যাত্রাপথের ক্লেশ সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ নিজ দেশে ফিরে যায়, আবার কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কতটা কষ্টকর ছিল সে যাত্রা তার বিবরণ রয়েছে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শেষাংশে-
যাত্রীরা যতই সামনের দিকে এগোতে লাগলেন ততই পথের রুক্ষতা অনুভব করলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলেন প্রাকৃতিক আবহাওয়ার দুর্যোগ। ক্রমশঃ যাত্রীদের পথ থেকে লোকালয়ের চিহ্ন গেল মিলিয়ে, সেই সঙ্গে মিলিয়ে গেল জীবন্ত মানুষের সংস্পর্শ। মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেবল এগিয়ে চলেছেন সহায়হীন, সম্বলহীন নিঃশঙ্কচিত্ত মাত্র কয়টি দুঃসাহসী পথিক। একমাস পাঁচ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বিজয়ী হয়ে যাত্রীরা এসে পৌঁছলেন খোটানে। - পৃষ্ঠা-২২
২২টি পরিচ্ছেদে ভ্রমণপথের শহর, ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, আবহাওয়া, জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থান, নগরীর সৌন্দর্য, মঠ, পাঠাগার, বৌদ্ধধর্মীয় সমৃদ্ধি, সংস্কৃতি প্রভৃতির বিবরণ রয়েছে। ফা-হিয়ানের চোখে ভারতবর্ষের ঐশ্বর্য এক অনুপমরূপে ধরা পরেছে। ভ্রমণের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি বেশ কয়েকটি ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন। সেইসব অনুষ্ঠানের বিশদ বিবরণ তিনি আন্তরিকতার সাথে বর্ণনা করেছেন।
খোটানে পৌঁছানোর কয়েকমাস পর এক বৌদ্ধধর্মীয় মূর্তি-শোভাযাত্রার দিনক্ষণ ছিল। ফা-হিয়েন একজন উৎসুক পর্যটকের দৃষ্টিতে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন, আচারপদ্ধতি, সাধারণ জনগণ, অভিজাত শ্রেণী, রাজা ও রাণীর অংশগ্রহণ অর্থাৎ শোভাযাত্রা সম্পর্কিত বেশিরভাগ আয়োজনকে কৌতুহলী মানসে পর্যবেক্ষণ করেছেন। পৃষ্ঠা- ২৪
পামীর মালভূমির মধ্যবর্তী অঞ্চল 'খালচা'য় তিনি দেশের প্রায় সমস্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের উপস্থিতিতে হওয়া 'মহাপঞ্চবার্ষিকী সভা'য় অংশগ্রহণ করেন। এই সভায় রাজা শ্রদ্ধার সাথে উপস্থিত হন।
ভিক্ষুদের প্রতি রাজার শ্রদ্ধানিবেদনের পর রাজা তাঁর মন্ত্রীবর্গকে অনুরূপ শ্রদ্ধা জানাবার নির্দেশ দেন। শ্রদ্ধানিবেদনের পালা শেষ হলে পর রাজা তাঁর মন্ত্রীবর্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রী সমভিব্যাহারে একটি সাদা পশমের কাপড় পরে ভিক্ষুদের মধ্যে তাঁদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও সেই সঙ্গে দামী দামী মণি-মাণিক্যাদি বন্টন করে দেন। পৃষ্ঠা- ২৬
চতুর্থ পরিচ্ছেদ সম্পূর্ণ খালচার অনুষ্ঠান, ভিক্ষুদের প্রতি রাজার শ্রদ্ধা প্রদর্শন, দান, বৌদ্ধধর্মীয় পীঠস্থানের পরিচিতি, ভিক্ষুদের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। বিবরণে জানতে পারি গৌতম বুদ্ধের ব্যবহৃত পাথরের তৈরি পিকদানী ও বুদ্ধের একটি দাঁত এখানে আছে।
পঞ্চম পরিচ্ছেদে ফা হিয়েন তুষারাবৃত পামীর মালভূমি পার হয়ে উপস্থিত হন উত্তর ভারতের সীমান্ত রাজ্য 'দর্দ' এলাকায়। সেখানে তিনি কাঠের তৈরি ৮০ ফুট উঁচু মৈত্রেয় বোধিসত্ত্বের একটি মূর্তি দেখতে পান।
দক্ষিণ পশ্চিম দিকে আরও অগ্রসর হয়ে যাত্রীদের পাহাড়ের বিপদসংকুল সংকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়। দুর্গম পথে সাবধানে পা ফেলে, সাতশতটির মত পাহাড়ের ফাটল কাঠের মই দিয়ে পার হয়ে শেষে ৮০ হাত লম্বা দড়ির সাঁকো দিয়ে সিন্ধু নদ পার হয়ে তাঁরা উত্তর ভারতে পা রাখেন।
‘অবতরণিকা' অংশের তথ্য অনুযায়ী ফা হিয়ান ভারতে একে একে মথুরা, কনৌজ, শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু, কুশীনগর, বৈশালী, পাটলীপুত্র, রাজগ্রহ, গয়া, বারাণসী, কৌশাম্বী, চম্পা ও তাম্রলিপ্তি শহর পরিভ্রমণ করেন। তখন ভারতবর্ষের অধিকর্তা ছিলেন গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। তাঁর সময়ে মানুষ কিরকম জীবন যাপন করতো সেই দৃশ্য ফা হিয়ান মনোযোগের সাথে খেয়াল করেছেন। দশম পরিচ্ছেদে সহগামীদের সাথে নিয়ে তিনি মথুরায় পৌঁছান। দেখেন যমুনা নদীর তীরে অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, রাজারা বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নিয়মকানুন নিষ্ঠার সাথে মেনে চলেন। ফা হিয়েন জানান-
এখান থেকে শুরু করে দক্ষিণ দিকের সমগ্র অঞ্চলটাকেই 'মধ্যরাজ্য' বলা হয়। এই অঞ্চলের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। অন্যান্য স্থানের মত এখানে তুষারপাত হয় না বা 'লু' বয় না। এখানকার অধিবাসীরা নিজেদের সম্পদে তৃপ্ত ও সুখী। রাজাকে এদের কোন করও দিতে হয় না বা এদের সম্পত্তির কোন হিসাবও দিতে হয় না। যারা রাজার জমি চাষ করেন তাদেরই কেবলমাত্র জমি থেকে উদ্ভূত লাভের একটা অংশ রাজ-তহবিলে জমা দিতে হয়। এদেশের অধিবাসীরা যখন খুশী ও যেখানে খুশী চলে যেতে পারেন বা এসে বাস করতে পারেন। মৃত্যুদণ্ড- প্রথা ব্যতিরেকেই এদেশের রাজা তাঁর রাজ্যশাসন করেন। পৃষ্ঠা- ৩৮
ভারতবর্ষের সব জায়গায় যে তাঁরা সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছেন, তা নয়। কোথাও কোথাও তাঁদের সাথে অস্বাভাবিক আচরণও করা হয়েছে। যাত্রাপথের উই জাতিদের দেশে তাঁরা স্থানীয় বিহারবাসী ভিক্ষুদের সন্দেহের শিকার হয়েছেন। -
এখানকার ৪০০০ হীনযানপন্থী ভিক্ষু বিশেষ নিষ্ঠার সঙ্গেই বিহারজীবনের নিয়মাবলী পালন করে থাকেন, তাই তাঁরা এই চীনা তীর্থযাত্রীদের প্রথমে তাঁদের বিহারে স্থান দিতেও ইচ্ছুক ছিলেন না, কারণ তাঁদের ধারণা এই ছিল যে, চীনা শ্রমণেরা তাঁদের নিয়মাবলী মেনে চলতে সম্পূর্ণ অক্ষম। পৃষ্ঠা- ২১
স্থানীয় মানুষেরাও তাঁদের সাথে অসঙ্গত আচরণ করেছে--
বিহারে থাকবার অনুমতি পেলেও তীর্থযাত্রীরা উই-এর অধিবাসীদের কাছ থেকে খুব ভাল ব্যবহার পান নি, কারণ তাঁরা সদাসর্ব্বদাই এদের ঘৃণার চক্ষেই দেখতেন, এমন কি ভিক্ষুর মর্য্যাদায় আঘাত করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেন নি। পৃষ্ঠা- ২১
স্থানী মানুষজনের আচরণ এতটাই অসহ্য ছিল যে সহযাত্রী চেন-ইয়েন, হুই-চিং এবং হুই-উয়েই এখান থেকে আবার কাও চাং (বর্তমান কারসারে) ফিরে যান (পৃষ্ঠা- ২১)।
ফা হিয়ান ভারতবর্ষের শহরে শহরে ভ্রমণ করে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করতেন। আঠারো নং পরিচ্ছেদে তীর্থযাত্রীরা পাটলিপুত্র নগরে এসে পৌঁছান। এখানে তিনি দীর্ঘদিন বাস করেছেন। আশেপাশের অন্যান্য রাজ্যে ভ্রমণশেষে এখানে থিতু হন।
ফা-হিয়েনের পাটলিপুত্র ফিরে আসার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে 'বিনয় পিটকের' একটি পুঁথি সংগ্রহ করা। … এই পিটকে 'মহাসাংঘিক' নিয়মাবলী যা বুদ্ধের জীবিতকালে 'প্রথম ধর্ম্মসম্মেলন' লিপিবদ্ধ ও গ্রহণ করা হয়েছিল এবং যার মূল পুঁথিটি জেতবন বিহারেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল – সেইটি ফা-হিয়েন এখানে দেখতে পান। … 'মহাযান বিহারের' এই পুঁথিটি সর্ব্বদিক দিয়েই সম্পূর্ণ এবং এর প্রতিটি সূত্রের পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। এছাড়া ফা-হিয়েন সাত হাজার শ্লোক সমৃদ্ধ 'সর্বাস্তিবাদ' শাস্ত্রের একটি পুঁথিও এখানে দেখতে পান।… ফা-হিয়েন এই বিহারে ছয় হাজার শ্লোকসমৃদ্ধ 'সংযুক্তাভিধর্ম্ম হৃদয় শাস্ত্র', আড়াই হাজার শ্লোকসমৃদ্ধ 'নির্ব্বাণ সূত্র', পাঁচ হাজার শ্লোকসমৃদ্ধ 'বৈপুল্য পরিনির্ব্বাণ সূত্র' এবং 'মহাসাংঘিকাভিধর্ম্ম' পুঁথিও এখানে আছে দেখেছেন। ফা-হিয়েন তিন বছর ধরে এখানে সংস্কৃত, চলিত ও প্রাকৃত ভাষা অধ্যয়ন করে, উপরোক্ত সূত্রাবলীর একটি করে প্রতিলিপি প্রস্তুত করেন। পৃষ্ঠা - ৬৫
সহযাত্রী তাও-চিং স্থানীয় মানুষের এইসব নিয়মাবলীর প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, দৈনন্দিন জীবনে এসবের প্রতিফলন তথা জীবনদর্শনে উচ্চমানের সাংস্কৃতিক মানসিকতার পরিচয় পেয়ে বাকী জীবন ভারতেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উল্লেখিত 'শ্রাবস্তী' নগরে ফা হিয়েন এসে পৌঁছান একাদশ পরিচ্ছেদে। শ্রাবস্তী শহরে তাঁরা মাত্র ২০০ ঘর পরিবারের বসতি দেখতে পান। নগরের দক্ষিণে রয়েছে একটি বিহার যেখানে বুদ্ধদেব ২৫ বৎসরকাল বাস করেছিলেন। কাঠনির্মিত এই বিহার আগে সাততলা উঁচু ছিল-
কথিত আছে জেতবন বিহারটি প্রথমে সাততলা উঁচু ছিল। বিভিন্ন দেশের রাজারা বিভিন্ন রঙের মণিখচিত শামিয়ানা দিয়ে বিহারের উপরটা মুড়ে দিতেন, ফুল ছড়াতেন ও ধূপাদি জ্বালতেন। দিনের আলোর মতন রাতটাকেও উজ্জ্বল করে রাখার জন্য অসংখ্য প্রদীপও জ্বালিয়ে রাখা হ'ত। এখানে পূর্ব্বে প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পরিচালিত হ'ত। এইরূপ একটি উৎসব অনুষ্ঠানকালে একটি ইঁদুর একটি জ্বলন্ত প্রদীপের সলতে মুখে করে নিয়ে ওপরে উঠে যায় যার ফলে সারা বিহারটাই অগ্নিদগ্ধ হয়। অবশ্য বুদ্ধদেবের কাষ্ঠনির্মিত মূর্ত্তিটি অক্ষত থাকে। এর পর বিহারটিকে নূতন করে নির্ম্মাণ করা হয় এবং সেটি মাত্র দ্বিতল করা হয়। এইটাই ফা-হিয়েন দেখেছেন। পৃষ্ঠা- ৪৬
জেতবন বিহারের এক পাশে বাঁশবন, কিছু দূরে 'মাতা বৈশাখা' বিহার, ৭০ হাত দূরে বুদ্ধদেব যেখানে বসে ধর্মালোচনা করতেন সেই চিহ্নিত স্থান প্রভৃতি রয়েছে। অন্যান্য বিহারের মত এই বিহারেও গৌতম বুদ্ধের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা রয়েছে।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদে তাঁরা পৌছান কপিলাবস্তু নগরীতে। গৌতম বুদ্ধের জীবন-স্মৃতি বিজরিত এই স্থানকে প্রায় জনমানবহীন দেখেছেন তাঁরা। -
নগরী জনশূন্য বললেই হয়, মাত্র দুই-এক ঘর পরিবার ও কয়েকজন ভিক্ষু এই বিরাট নগরীর ধ্বংসস্তূপ আগলে পড়ে আছেন। এই নগরীতে অসংখ্য স্তূপ আছে, তাঁর মধ্যে শুদ্ধোধন প্রাসাদে মায়াদেবীর গর্ভধারণের পূর্ব্বে শাক্যমুনির শ্বেতহস্তীর পৃষ্ঠশোভিত মূর্ত্তিটি যেখানে প্রথম দেখা গিয়েছিল, যেখানে রাজপুত্র (গৌতম) দুঃস্থ লোকদের দেখে তাঁর রথ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন, যেখানে অসিত যুবরাজের দেহের চিহ্নসমূহ প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন, বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধদেব যেখানে তাঁর পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, যেখানে শাক্যসম্প্রদায়ভুক্ত পাঁচ শত নরনারী সংসার ত্যাগ করে এসে উপলীকে তাদের শ্রদ্ধা জানান, যেখানে বুদ্ধদেব দেবতাদের মাঝে তাঁর ধর্ম্মব্যাখ্যা প্রচার করেছিলেন ও যে ন্যগ্রোধবৃক্ষের তলে বসে বুদ্ধদেব মহাপ্রজাতির কাছ থেকে পোাষাকাদি গ্রহণ করেছিলেন সেই সব বিশিষ্ট স্থলের উপর নির্ম্মিত স্তূপসমূহই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পৃষ্ঠা - ৪৯
কপিলাবস্তু নগরীর পূর্বদিকে কিছু দূরে রাজকীয় বাগান 'লুম্বিনী' অবস্থিত। এখানে রাজমাতা মায়াদেবী যেখানে গৌতম বুদ্ধের জন্ম দিয়েছিলেন সেই স্থানটি চিহ্নিত করা আছে।
অনুবাদক শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মুখোপাধ্যায় তাঁর অবতরনিকা অংশে জানিয়েছেন-
খ্রীষ্টপূর্ব্ব দুই সালে চীনসম্রাট-সকাশে বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী কুষাণরাজগণ কর্ত্তৃক বৌদ্ধধর্ম্মশাস্ত্রের পুঁথিসমেত দূত প্রেরণের পূর্ব্ব থেকে উপরোক্ত ইউনান ও তৎসমীপবর্ত্তী প্রদেশে ভারত-প্রত্যাগত বৌদ্ধধর্ম্মযাজকেরা বৌদ্ধ ধর্ম্ম প্রচারের প্রয়াস পান। অতঃপর আনুমানিক ৬৫ খ্রীষ্টাব্দে মগধের দুইজন পণ্ডিত কাশ্যপ-মাতঙ্গ ও ধর্ম্মরক্ষ (মতান্তরে ধর্মরত্ন) কুষাণদিগের রাজধানী থেকে চীনদেশের রাজধানীতে গিয়ে চীনাভাষায় বৌদ্ধশাস্ত্রের অনুবাদ করেছিলেন। এরপর পারশ্যদেশের 'আরসকিদীয়' রাজবংশের এক রাজপুত্র বৌদ্ধধর্ম্মে দীক্ষিত হয়ে ভিক্ষু লোকোত্তম (চীনাভাষায় আন্-মো-কাও) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি সুদীর্ঘ বিশ বৎসর ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম্মশাস্ত্রের প্রায় ১৭৯ খানি গ্রন্থ চীনাভাষায় অনুবাদ করে চীনদেশে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার করেন। অতঃপর লোকক্ষেম নামক অপর একজন তুখারদেশীয় বৌদ্ধভিক্ষু চীনদেশে এসে ১৮৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্য্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন এবং একজন ভারতীয় ভিক্ষুর সহায়তায় ২৩ খানি বৌদ্ধধর্ম্মশাস্ত্র চীনাভাষায় অনুবাদ করে বৌদ্ধধর্ম্মপ্রচারের কার্য্য চালিয়ে যান। পৃষ্ঠা - ১৩
পূর্ববর্তী পরিব্রাজকগণের বর্ণনা পাঠ করে ফা হিয়েন ভারত সফরের জন্য আগ্রহী হন। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রকাশিত হলে ভারতীয় ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে চীনের মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এই বইয়ে ৩৯৯ সাল থেকে ৪১০ সাল ব্যাপী ভারতীয় সমাজজীবনের প্রাত্যাহিক চিত্র ফা হিয়েনের দৃষ্টিতে রয়েছে। তাঁর বিবৃতি থেকে তৎকালীন ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও প্রসস্তি কত আদরণীয় ছিল তা বোঝা যায়। প্রাচীন ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে আগ্রহী যে কোন ব্যক্তি এই বইয়ের পাতায় পাতায় ভারতের প্রাচীন সমাজচিত্র খুঁজে পাবে। মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে উৎসাহী যে কোন পাঠক এই বই পড়তে চাইবে। বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশ করে অনুবাদক ও প্রকাশক উভয়েই ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন।
ফা হিয়েনের ভ্রমণ পথ |
বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় 'ফা হিয়েন' ও 'ফা হিয়ান' দুই রকম লেখা আছে। এর দায় কতটা অনুবাদকের বা মূল প্রকাশের কিংবা বাংলাদেশী সংস্করণের তা কোথাও লেখা নেই। সর্বশেষ প্রকাশক নিজে কয়েক লাইনে এরকম কয়েকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন।
বইয়ের কোন কোন জায়গায় ছাপানোর ত্রুটি আছে। সেটা মূল বইয়ে ছিল নাকি বাংলাদেশী সংস্করণে সংঘটিত- তা কোথাও উল্লেখ বা স্বীকার করা হয়নি। দিব্যপ্রকাশের মত প্রখ্যাত প্রকাশনীর কাছে এমন অসচেতনতা কাম্য নয়। তেরোতম পরিচ্ছেদে ৫০ নং পৃষ্ঠার একটি বাক্য এরকম-
স্তূপটি বুদ্ধের 'পরিনির্ব্বাণলাভের' পর যেখানে তাঁকে দাহ করা হয়েছিল, সেই স্থলের ওপরই রচিত হয়েছিল এরই বার যোজন দূরবর্ত্তী কুশী নগরে। পৃষ্ঠা- ৫০
শব্দের বানানত্রুটি উপেক্ষা করলেও বাক্যের অর্থ বোঝা যায়। কিন্তু বাক্যাংশ অনুপস্থিত বা অসম্পূর্ণ থাকলে বক্তব্য বোঝা অনেক সময় কঠিন হয়ে পরে।
বইয়ের প্রথমাংশে পরিচ্ছেদসমূহের নাম দিয়ে একটি সূচিপত্র আছে। পরিচ্ছেদ সমূহের কোন শিরোনাম রাখা হয়নি। বাংলা অনুবাদে ২২টি পরিচ্ছেদ রয়েছে, কিন্তু অনলাইনে থাকা ইংরেজি বইটি ৪০টি পরিচ্ছেদের। বাংলা অনুবাদে এত বেশি সংক্ষিপ্ত করার কারণ কোথাও পাওয়া গেল না। দিব্যপ্রকাশ প্রকাশিত সংস্করণের প্রচ্ছদটির অভিনবত্বের প্রশংসা করতে হয়। প্রচ্ছদশিল্পী মোবারক হোসেন লিটন প্রচ্ছদের নিচের দিকে ডানে ঘোড়ায় আরোহী মানুষের চিত্রখোদিত একটি গোল পয়সার মত আকৃতির কিছু একটার ছবি যোগ করেছেন। এটা কী, এর নাম, উৎস বা ব্যাখ্যা বইয়ের কোথাও নেই। সন্ধিৎসু পাঠকের মনে অতৃপ্তি থেকে যাবে।
এই বইয়ের প্রথম প্রকাশ ১৯৬০ সালে। আর বাংলাদেশের প্রকাশনী দিব্যপ্রকাশ বের করেছে ২০১৬ সালে। সাদা কাগজে ছাপানো বইয়ের প্রিন্ট গাঢ়, ফলে পড়তে সুবিধা হয়। হার্ডবোর্ড মলাট হওয়ায় বেশ শক্তপোক্ত। বহু ব্যবহারে মলিন হয়ে যাবে না। ভ্রমণপিপাসু পাঠকের কাছে এই বই আদরণীয় হওয়া উচিত।
##########
ফা হিয়ানের দেখা ভারত
অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মুখোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ: মোবারক হোসেন লিটন
প্রকাশক: দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা
প্রথম সংস্করণ: ১৯৬০
প্রথম দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ: ২০১৬
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৭২
মূল্য: ১২৩ টাকা
ISBN: 978-984-8830-50-5
প্রজেক্ট গুটেনবার্গের সাইটে থাকা জেমস লেগকৃত ইংরেজি বইয়ের অনলাইন লিংক
A Record of Buddhistic Kingdoms
Being an Account by the Chinese Monk Fâ-Hien of his Travels in India and Ceylon (A.D. 399-414) in Search of the Buddhist Books of Discipline
Translated and annotated with a Corean recension of the Chinese text
BY JAMES LEGGE
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম