লেখক পরিচিতি:
আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতা হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। তিনি একজন বাংলাদেশি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবি ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খান সহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
আলোচনা ও সমালোচনা:
'যদ্যপি আমার গুরু' বইটি চিন্তাবিদ ও কথাসাহিত্যিক আহমেদ ছফা রচিত একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ। দীর্ঘ স্মৃতিচারণামূলক রচনাটি ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে বই আকারে প্রকাশের আগে 'দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা'র সাহিত্য পাতায় প্রায় চার মাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। অত্যন্ত জ্ঞানী দুজন মানুষ একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যার অপরজন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা সাহিত্যিক আহমেদ ছফা। দুজনের মধ্যে কথোপকথনের দিকগুলো নিয়ে রচিত হয়েছে 'যদ্যপি আমার গুরু' বইটি। শুধু কথপোকথন নয় আরও জানা - অজানা অনেক কথা উঠে এসেছে।
যদ্যপি আমার গুরু শুরি বাড়ি যায়
তথাপি তাহার নাম নিত্যানন্দ রায়।
প্রথমেই বলে রাখি এই উক্তিটি তাঁর নিজের রচিত নয়।
প্রথমেই তিনি এ কথাটি উল্লেখ করেছেন এখানে যদ্যপি মানে যদিও বা একান্তই এবং শুরি মানে বিদ্বান, পণ্ডিত অর্থাৎ প্রথম লাইনটির অর্থ দাঁড়ায় 'যদিও আমার শিক্ষক বিদ্বান বাড়ি যায় অথবা একান্তই আমার শিক্ষক পণ্ডিত বাড়ি যায়।' এখানে তিনি 'যদ্যপি' না লিখে 'যদিও' লিখতে পারতেন তাতে তো কোনো সমস্যা দেখছি না। এটা না হয় বুঝা গেল কিন্তু পরের লাইনে নিত্যানন্দ রায় বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। নিত্যানন্দ রায় কে? এরকম একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এসব তিনি উল্লেখ করে কি বোঝাতে চেয়েছেন তা অবশ্য বলা খুব কঠিন। 'যদ্যপি আমার গুরু' বইটিতে আহমেদ ছফার ব্যাক্তিগত জীবন এবং শিষ্যের প্রতি গুরুর যে প্রভাব ছিল তা পরিলক্ষিত হয়েছে। গুরু শিষ্যের মধ্যে অন্তরঙ্গ ভাবের প্রকাশ পেয়েছে।
একাডেমি কারণে পিএইচডি করার নিমিত্তে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সাথে আহমেদ ছফার দেখা হয়। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সংস্পর্শে আসতে পেরে আহমদ ছফা নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। কারণ তার মত জ্ঞানী লোক আর কাউকে তিনি খুঁজে পাননি। রাজ্জাক স্যার যদিও খুব জ্ঞানী লোক ছিলেন নানান সময় নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন কিন্তু তিনি কখনো কোন বই লিখেননি। কেন লিখেন নি তা অবশ্য বলা কঠিন। আবার রাজ্জাক স্যার স্বীকার করেছেন তিনি কিছু বই অনুবাদ করেছিলেন। তিনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। খুব সাদামাটা একজন মানুষ ছিলেন। হুকা টানা তার একটা অভ্যাস ছিল। তিনি খাদ্য রসিক লোক ছিলেন । পোশাক পরিধানের দিকে তার অতটাও আগ্রহ ছিল না। তিনি সাধারণ ভাবেই চলতে ভালোবাসতেন। রাজ্জাক স্যার যেম্নি গুরু ছিলেন ঠিক তেম্নি শিষ্য ছিলেন আহমেদ ছফা এ জন্যই তো তিনি ' যদ্যপি আমার গুরু' বইয়ের মধ্য দিয়ে রাজ্জাক স্যারকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছিলেন। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার এতটাই জ্ঞানী ছিলেন যে , শুধু আহমেদ ছফা তার কাছে যেতেন না, দেশ - বিদেশ থেকে অনেক লোক আসতো তার সাথে দেখা করতে। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের স্নেহ ছায়ায় ও দীর্ঘ সহচরে থেকে তিনি তার সম্পর্কে বলেছেন - "দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা নির্মাণে, নিষ্কাম জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রচলিত জনমত উপেক্ষা করে নিজের বিশ্বাসের প্রতি স্থিত থাকার ব্যাপারে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মত আমাকে অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ অতো প্রভাবিত করতে পারেনি।" বই পড়া সমন্ধে বলতে গিয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যার আহমেদ ছফাকে বলতেন, " যখন আপনি কোন বই পড়া শেষ করে সেই বইটি নিজের ভাষায় লিখতে পারবেন, তখনই কেবল বইটি ঠিকভাবে আপনার পড়া হয়েছে। যদি বইটির সারবস্তু নিজের ভাষায় লিখতে না পারেন তবে বুঝতে হবে বইটা পড়া হয়নি।"
রাজ্জাক স্যার আহমেদ ছফাকে মৌলভী আহমদ ছফা বলে ডাকতেন। কেন ডাকতেন তা আহমেদ
ছফা নিজেও জানত না। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক স্যার আহমেদ ছফাকে যে, জ্ঞানের সমুদ্রে ভাসিয়ে তুলেছিলেন তা হয়তো অন্য কেউ পারত না। বিশ্বের বড় বড় ব্যক্তিদের সম্পর্কে যে আলোচনা গুলো করেছিলেন, তা আহমেদ ছফার মনে আরো প্রজ্জালন সৃষ্টি করে। প্রতিদিন যখন তারা বাসায় বসে চা খেতেন এবং নানান বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। একপর্যায়ে তিনি কবি নজরুলের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন..."বজ্র, বিদ্যুৎ আর ফুল এই তিনে নজরুল।" এরকম অনেক কথা বলে শুনাতেন। এভাবেই বিশ্বের খ্যাতনামা ব্যাক্তিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং সমকালীন ঘটনা নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হত। আহমেদ ছফা বলতেন, রাজ্জাক স্যার তীক্ষ্ণ ধীশক্তির প্রেমে পড়েছিলেন। জ্ঞান চর্চা ছিল তার একমাত্র কাজ।
আহমেদ ছফা রচিত 'যদ্যপি আমার গুরু' বইটি থেকে কিছু ভালো লাগা কথা তুলে ধরা হলো :
- ⭐ আমার মতো একজন আগ্রহী যুবককে আপনি একটি কথাও না বলে তাড়িয়ে দিতে পারেন না, এত বিদ্যা নিয়ে কি করবেন?
- ⭐ একটা কথা খেয়াল রাখন খুব দরকার। যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায় । আর কি পড়ালেখা করে। কাঁচা বাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা।
- ⭐ দ্যাহেন বাংলাদেশ সরকার জসীমুদ্দীনরে কিছু করল না। আমারে আর জয়নুল আবেদীন সাহেবরে মুসকিলে ফেলাইয়া দিছে। আমাগো দুইজনের ন্যাশনাল প্রফেসর বানাইছে, আর জসীমুদ্দীনরে কিছু বানায় নাই।
- ⭐ বজ্র বিদ্যুৎ আর ফুল এই তিনে নজরুল।
- ⭐ লেখার ব্যাপারটা হলো পুকুরে ঢিল ছোড়ার মতো ব্যাপার। যতো বড় ঢিল যত জোরে ছুড়বেন পাঠকের মনে তরঙ্গটাও ততো জোরে উঠব এবং অধিকক্ষণ থাকব।
- ⭐ আপনি যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দ ভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইব়্যা নিবেন আপনের পড়া অয় নাই।
- ⭐ ফ্যামিলিয়ারিটি ব্রীডস কনটেম্পট- শেক্সপীয়ার। অতিপরিচয়ে সুন্দর সম্পর্কও মলিন হয়ে যায়।
- ⭐ অনেক সময় উৎকৃষ্ট বীজও পাথরে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়।
- ⭐ পুষ্টিকর খাবারের দুস্প্রাপ্যতাই মানুষের স্বাস্থহানির আসল কারণ।
- ⭐ আমরা শিক্ষকেরা প্রতি বছরেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটি নতুন বছরে আমাদের কাছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হয়। এই তরুনদের চাহিদা , চাওয়া - পাওয়ার খবর আমাদের মতো লোলচর্মের বৃদ্ধদের জানার কথা নয়। এটাই হলো শিক্ষক জীবনের ট্রাজেডি।
- ⭐ বড় লেখক এবং বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখকদের মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে। বড় মানুষরা আসলেই বড় মানুষ।
- ⭐ বাংলা ভাষাটা বাঁচাইয়া রাখছে চাষাভুষা, মুটেমজুর__ এরা কথা কয় দেইখ্যাই ত কবি কবিতা লিখতে পারে।
- ⭐ বেঙ্গলের এন্টায়ার এডুকেশন সিসটেমটাই টপ হেভি।
- ⭐ তরুণ বয়সে মানুষের শরীরের কোন অংশে চোট লাগলে বয়স কালে সেটা অনুভব করা যায় না অনেক সময়। বুড়ো হলেই ব্যাথাটা ফিরে আসে।
- ⭐ যার মনে দয়া নাই তারে উপরে আনা ঠিক নয়।
- ⭐ যে জাতি যত বেশি সিভিলাইজড তার রান্নাবান্নাও তত বেশি সফিস্টিকেটেড।
- ⭐ আধুনিক বাংলা বঙ্গসন্তানের ঠিক মুখের ভাষা না, লেখাপড়া শিখে লায়েক অইলে তখনই এই ভাষাটা তার মুখে আসে।
- ⭐ যে মানুষ চৌদ্দটা পোলা মাইর জন্ম দিছেন, হে সাধনা করবার সময় পাইল কখন!
- ⭐ রেনেসাঁর আগে পরোকালটাই আছিল সব। রেনেসাঁর পরে এই দুনিয়াটাই সব, পরোকাল কিছুই না।
- ⭐ লেখার ক্ষমতা থাকলে লিখে যান। অন্যরা কী বলবে সেদিকে তাকিয়ে কিছু লিখবেন না।
- ⭐ যে ধরনের কাজে অমানষিক মানসিক শ্রমের প্রয়োজন হয়, সে ধরনের কাজ করার প্রেরণা আমাদের সমাজ থেকে সংগ্রহ করা একরকম অসম্ভব।
- ⭐ এখানে একজন বড় কাজ করলে উৎসাহ দেয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। আমাদের সমাজে গুনগ্রাহিতার পরিমাণ নিতান্তই সংকুচিত।
- ⭐ সুরুচিসম্পন্ন সংস্কৃতিবান অধিক মানুষ আমাদের সমাজে সত্যি সত্যি বিরল। অবশ্য সাম্প্রতিককালে অবস্থাটা কিছু-কিছু পাল্টাতে আরম্ভ করেছে।
- ⭐ এখানে প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন কাউকে সালাম দিলে, সালামটা তাঁর প্রাপ্য বলে ধরে নেন এবং যিনি সালাম দেন তাঁকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিতান্তই ছোটলোক বলে ধরে নেয়া হয়।
- ⭐ আমাদের শ্রদ্ধাভাজন বয়োজ্যেষ্ঠারা যেভাবে আমাদের উপকার করতে চান আমরা পরবর্তী প্রজন্মের তরুণেরা যেভাবে উপকৃত হতে চাই, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক।
বইটি সম্পর্কে দুটি কথা :
আহমেদ ছফা মূল্যবান এই বইটিতে যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিয়েছেন এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য প্রকাশ করেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, "রাজ্জাক স্যারের ওপর কোনোকিছু লিখে প্রকাশ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।" তারপরও তিনি যে গভীরের তথ্যগুলো আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন তা অতুলনীয়। একসঙ্গে এতগুলো বিখ্যাত মানুষের সাথে পরিচয় হতে গেলে এই বইটি পড়তেই হবে। কেননা রাজ্জাক স্যার প্রাঞ্জল ভাষায় সহজ সরল জ্ঞানচর্চার যে দিকনির্দেশনা আহমেদ ছফাকে দিয়েছিলেন তা অত্যন্ত গর্বের।
উপসংহার:
গুরু - শিষ্যের অভূতপূর্ব ভালোবাসার নিদর্শন "যদ্যপি আমার গুরু" যেখানে গুরু অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও শিষ্য আহমেদ ছফার মধ্যাকার জ্ঞানালোচনার দিকগুলো ফুটে উঠেছে।
-০-০-০-০-
বই : যদ্যপি আমার গুরু
লেখক: আহমেদ ছফা
ধরনঃ স্মৃতিচারণমূলক
প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স
প্রচ্ছদঃ কাইয়ুম চৌধুরী
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৯৮
পৃষ্ঠাঃ ১১০
দামঃ ১৭৫
ISBN: 984 410 022 4
3 মন্তব্যসমূহ
'যদ্যপি আমার গুরু শুরি বাড়ি যায়...' শুরি মানে যে মদ বিক্রি করে। নিত্যানন্দ রায় একজন পন্ডিত।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনধন্যবাদ
মুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম