কোন জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সম্মিলিতভাবে চর্চিত সাহিত্যকে লোকসাহিত্য বলে। এই জাতীয় সাহিত্য কোন একক ব্যক্তির সৃষ্টি নাও হতে পারে। হয়ত কখনও কোন একক ব্যক্তির কল্পনাতে সাহিত্যভাবনাটি মূর্ত হয়েছিল, কিন্তু তা যখন সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, তখন মূল রচয়িতাকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে গণমানুষের সংহতি।
মুখে মুখে পার হয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবন যাপনের সহজ সরল ভাষায় ফুটে ওঠে। তাই বলা যায়, লোকসাহিত্য কোন জাতির ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর 'বাংলার লোকসাহিত্য' (২০০৪) গ্রন্থে বলেছেন-
জাতীয় সংস্কৃতির যে সকল সাহিত্যিক ও মননশীল সৃষ্টি মুখ্যত মৌখিক ধারা অনুসরণ করে অগ্রসর হতে যায়, তাই লোকসাহিত্য; যেমন গীতিকা, কথা, সঙ্গীত ইত্যাদি - পৃষ্ঠা-৭
বাংলাদেশে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে চাকমা জাতিসত্ত্বার পরিসর সবচেয়ে বড়। তারা কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বাস করে আসছেন। তাদের লোকসাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ। তাদের নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি আছে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময় লোকসাহিত্য থেকে তাদের প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সমাজের নানাচিত্র জানা যায়। চাকমা লোকসাহিত্যে রয়েছে অজস্র প্রবাদ, ছড়া, ধাঁধা, পৌরাণিক কাহিনী, ইতিকথা, উপকথা, বারমাসী, লোকগাঁথা, গীতিকা, ভাবসঙ্গীত ইত্যাদি। জীবনের নানাবিষয়ে চাকমা সমাজের গভীর ভাবনার পরিচয় এই রচনাগুলোতে পাওয়া যায়। নন্দলাল শর্মা চাকমা সমাজে প্রচলিত এই লোকসাহিত্য দিয়ে রচনা করেছেন 'চাকমা লোকসাহিত্য'। স্বল্পায়তনের এই বইয়ে লেখক সংক্ষেপে চাকমা সমাজের লোকসাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন।
সূচীপত্র দেখলে আলোচনার পরিধি বোধগম্য হবে।
- প্রসঙ্গ কথা
- লোকছড়া
- লোকগীতি
- বারমাসী
- গীতিকা
- ধর্মসম্পৃক্ত লোকসাহিত্য
- প্রবাদ
- ধাঁধা
- লোককথা
- সূত্রনির্দেশ
‘লোকছড়া' অধ্যায়ে জানা যায় চাকমা লোকসাহিত্য নিয়ে প্রথম আলোচনা পাওয়া যায় সতীশচন্দ্র ঘোষের ১৯০৯ সালে প্রকাশিত 'চাকমাজাতি বইয়ে। এখানে লেখক কয়েক প্রকারের চাকমা লোকছড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আব্দুস ছাত্তার ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত 'আরণ্য জনপদে' বইয়ে ১৪টি চাকমা ছড়া আলোচনা করেছেন। ১৯০৯ সালে Hutchinson সাহেবের অনূদিত 'জামাই মারনী' নামক চাকমা লোককাহিনী ১৯৭১ সালে প্রকাশিত Bangladesh District Gazetteers- CHITTAGONG HILL TRACKS গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়েছে। এই বইয়ে রচনাটি রোমান বর্ণে চাকমা উচ্চারণে ইংরেজি অনুবাদে মুদ্রিত হয়েছে।
লোকছড়াগুলোর বিষয় বৈচিত্র্যময়। প্রার্থনা, প্রশংসা, কৌতুক ছাড়াও লোকখেলা, সঙ্গীতযন্ত্র, লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার প্রভৃতি বিষয়ে চাকমা জীবনের অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে। চাকমা ছড়ার উৎপত্তির ইতিহাস জানা না গেলেও ব্রিটিশ পূর্ব যুগের সংস্কৃতির চিহ্ন চাকমা সাহিত্যে রয়েছে।
‘লোকগীতি' অধ্যায়ে চাকমা জাতির বিভিন্ন প্রকারের লোকগীতির পরিচয় পাওয়া যায়। চাকমা ভাষায় গানকে বলে গীত। ধর্মীয়, সামাজিক, ব্যক্তিগত প্রভৃতি উৎসবে গীত গাওয়া হয়। একক, দ্বৈত, সমষ্টি সকল প্রকারের গীত চাকমা সমাজে প্রচলিত আছে। তরুণ-তরুণীদের ঐতিহ্যবাহী পারস্পরিক লোকসঙ্গীত 'উভাগীত' সম্পর্কে সতীশচন্দ্র ঘোষ তাঁর 'চাকমাজাতি' বইয়ে বলেন-
প্রাণের আকুল পিয়াসা মিটাইতে প্রায় সকলেই উভাগীতের আশ্রয় লইয়া থাকে। ইহাতে সাধকের হৃদয়োচ্ছাস, উদাসীনের ফরমকাহিনী, বিরহীর প্রাণের জ্বালা, প্রেমিকের বিশ্রম্ভালাপ অতি সংক্ষেপে, অথচ স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়। পৃষ্ঠা- ২০
এমন অনন্য ধারার গানের পাশাপাশি আছে প্রতীকধর্মী, দীর্ঘ আকারের বিমিশ্র সঙ্গীত, কর্ম সঙ্গীত, প্রেম সঙ্গীত প্রভৃতি ধারার লোকগীত। বোঝা যায় যে, চাকমা লোকসঙ্গীত বেশ সমৃদ্ধ।
‘বারমাসী' অধ্যায়ে লোক সঙ্গীতের একটি বিস্মৃতপ্রায় ধারা সম্পর্কে জানা যায়। তের থেকে আঠার শতকের সমসাময়িক সময়ে বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের ধারা লক্ষ্য করা যায়। এই মঙ্গলকাব্যের কোন কোনটিতে নায়িকা চরিত্রের বর্ণনায় 'বারমাস্যা' নামে একটি অংশ ছিল। বঙ্গীয় অঞ্চলের নারীগণ সারা বৎসর ধরে পরিবারে-সমাজে যেসব লাঞ্ছনার শিকার হতেন, সেসবের দুঃখগাঁথা এই 'বারমাস্যা' বা 'বারমাসী'। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকসাহিত্য থেকে এই সাহিত্য উপাদানটি বিলুপ্তপ্রায় হলেও চাকমা লোকসাহিত্যে সদর্পে বেঁচে আছে। কির্বাবি, মেয়াবি, তান্যাবি, রঞ্জনমালা, সাননোয়বী, সান্দবী (চান্দবি), কালেশ্বরী প্রভৃতি 'বারমাসী' চাকমা সাহিত্যে এখনও নিয়মিত চর্চিত হয়।
‘প্রবাদ' হল প্রাচীন অভিজ্ঞানের সারাৎসার। প্রবাদ অধ্যায়ে চাকমা সমাজে প্রচলিত প্রবাদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন গবেষকের সংগৃহীত তথ্য থেকে চার শতাধিক প্রবাদের কথা জানা যায়।
ছিয়াশি পৃষ্ঠার স্বল্প পরিসরে খুব বেশি আলোচনা সম্ভব নয়। তারপরও লেখক আন্তরিকতার সাথে সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও চাকমা সমাজের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্যের উপর আলোকপাত করতে পেরেছেন। চাকমা জাতির প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চিহ্ন তাদের লোকসাহিত্যে প্রতিফলিত। বিষয়টি নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে নন্দলাল শর্মা চাকমা লোকসাহিত্যের প্রতি উৎসাহীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সফল। সংক্ষিপ্ত তথ্যে পাঠক অতৃপ্ত থেকে যাবেন; চাকমা লোকসাহিত্যের নানাদিক সম্পর্কে জানতে উৎসাহী হবে।
বইয়ের শেষে 'সূত্রনির্দেশ' অধ্যায়ে ২৫টি বইয়ের একটি মূল্যবান গ্রন্থতালিক আছে। আগ্রহী পাঠক এই তালিকা অনুসরণ করে সবিশেষ উপকৃত হবেন।
সাদা কাগজে মুদ্রিত বোর্ড বাঁধাই বইটির ছাপানোর মান ভাল। চাকমা সমাজের লোকসাহিত্য সম্পর্কে কৌতুহলী পাঠকের প্রাথমিক চাহিদা এই বই পূরণ করতে পারবে বলে মনে করি।
========+========
চাকমা লোকসাহিত্য
নন্দলাল শর্মা
প্রকাশ: ২০০৯
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
সূচীপত্র প্রকাশনী, ঢাকা
পৃষ্ঠা: ৮৬
মূল্য: ১৫০ টাকা
ISBN: 984-70022-0109-4
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম