মানুষ সম্পর্কে যে জ্ঞান আলোচনা করে তার নাম নৃবিজ্ঞান। মানুষের জৈবিক বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তার বৈচিত্র্য ও বিবর্তন এর আলোচনার বিষয়। মানুষ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগত গবেষণার মাধ্যমে নৃবিজ্ঞান মানুষের ব্যবহার, সংস্কৃতি, সমাজ, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে পর্যবেক্ষণজাত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। প্রাসঙ্গিক আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনার বই সাহেদ মন্তাজ রচিত 'নৃবিজ্ঞান ভাবনা'।
বইয়ের প্রথম ব্লার্বে বইটি সংক্ষেপে বলা হয়েছে-
এই গ্রন্থে নৃবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক সূচনাকালের পথিকৃৎদের অন্যতম কয়েকজনের নৃবিজ্ঞান বিষয়ক মৌলিক চিন্তা-ভাবনা এবং সমাজ-সংস্কৃতির নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে। উঠে এসেছে গবেষণায় সাফল্য অর্জনের পদ্ধতিগত দিকসমূহ নিয়ে তাদের চিন্তা-চেতনা।
লেখক নিজের বই সম্পর্কে ভূমিকাতে লেখেন-
নৃবিজ্ঞানের সূচনালগ্নের পথিকৃৎদের চিন্তা-ভাবনা এবং অন্যান্য নৃ-বৈজ্ঞানিক বিষয়ের গবেষণা-প্রবন্ধের সংকলন গ্রন্থ এটি।
লেখক স্বীকার করেন গ্রন্থভূক্ত প্রবন্ধগুলির বেশিরভাগ 'বাংলা একাডেমী' পত্রিকায় পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইয়ে রচনাগুলো একত্রিত করা হয়েছে। সূচিপাতা'য় দেয়া প্রবন্ধগুলোর শিরোনাম একবার দেখে নেয়া যেতে পারে-
- বিবর্তনবাদ ও লুইস হেনরি মর্গান
- নৃবিজ্ঞানে ফিল্ড-ওয়ার্ক ও ম্যালিনোস্কি
- মানবসমাজের বিকাশ: ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ
- নৃবিজ্ঞানে ফ্রাঞ্জ বোয়াসের অবদান
- দক্ষিণ এশিয়ায় মানবজাতিতত্ত্ব
- দক্ষিণ এশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিবর্ণ প্রথার গুরুত্ব
মোট ছয়টি দীর্ঘ প্রবন্ধে লেখক প্রাসঙ্গিক আলোচনা উপস্থাপন করেছেন।
প্রথম অধ্যায়ে নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের পথিকৃৎ লুইস হেনরী মর্গানের তত্ত্ব আলোচনা করা হয়েছে। লুইস হেনরী মর্গান সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে গবেষণা করে মানুষের বিকাশ সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর Ancient Society বেশ বিখ্যাত একটি বই।
মর্গানের সময়কাল ইউরোপে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার বিকাশের কাল। জীববিজ্ঞানে ল্যামার্ক, দর্শনে অগাস্ট কোৎ, স্পেন্সার প্রমুখ সমাজ সম্পর্কে নতুন নতুন চিন্তার জন্ম দিয়ে সমাজে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিলেন। মর্গান বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন সময়ের মানুষ। ফলে তিনি মানুষ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি ও বস্তুনিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে তিনি আদিবাসী মানুষদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীর বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রম সম্পর্কে তার আগ্রহ ছিল। দীর্ঘদিনের গবেষণা শেষে তিনি বলেন-
… ভাষার মতো আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ছাড়া মানসিকভাবে প্রাণীদেরকে মানুষ থেকে আলাদা করার মতো বিষয় অল্পই আছে। পৃষ্ঠা- ২১
এই অধ্যায়ে লেখক মর্গানের পরিচিতি, তার সময়কালের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতি, মর্গানের সমাজ নিরীক্ষা, তত্ত্ব প্রভৃতি আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনাও উপস্থাপন করেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক নৃবিজ্ঞানী ব্রনিসার কাসনার ম্যালিনোস্কি প্রণীত 'মাঠকর্ম' সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আগে বেশিরভাগ নৃবিজ্ঞানী মিশনারী, অনুসন্ধানকারী, ভ্রমণকারী, সরকারি কর্মকর্তা, উপনিবেশকারী প্রমুখের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন। অন্যের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তকে ভিত্তি ধরে মানবসমাজকে ব্যাখ্যা করতেন। ম্যালিনোস্কি আরেক নৃবিজ্ঞানী ফ্রাঞ্জ বোয়াসের কাজে উৎসাহী হয়ে মাঠ পর্যায়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে গবেষণা কার্যের গুরুত্ব বুঝতে পারেন।
তবে বোয়াস এবং ম্যালিনস্কির কাজের পদ্ধতিতে পার্থক্য আছে। আদিবাসীদের ভাষা শেখাকে তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। এ প্রসঙ্গে জানা যায়-
গবেষণাধীন জনগোষ্ঠীর ভাষা গবেষক আয়ত্ত করতে না পারলে কিছুতেই তাদের সাথে মিশতে পারবে না, হয়ে উঠতে পারবে না একান্তভাবে তাদেরই একজন। পর্যবেক্ষণের সময়ও এটি গবেষকের কাছে অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। কেননা ভাষা না বুঝলে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অনেক তথ্যই গবেষকের কাছে অজানা থেকে যেতে পারে। নেটিভদের ভাষা শেখা নৃতাত্ত্বিক গবেষণার প্রাথমিক কাজ বলে ম্যালিনোস্কি মনে করেন। পৃষ্ঠা- ২৯
লেখকের ভাষ্যে জানা যায়, ম্যালিনোস্কির কাজের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, তার নিজেরও কিছু ব্যক্তিগত দুর্নাম ছিল; কিন্তু, সবকিছু ছাপিয়ে তার গবেষণা সামাজিক বিজ্ঞানে জ্ঞান অর্জনের এক নতুন দিকের জন্ম দিতে পেরেছে। অধ্যায়ের উপসংহারে লেখক বলেন-
… মানব প্রকৃতির জটিলতার সামগ্রিক বিবরণ বিবেচনায় এবং মানবক্রিয়ার যৌক্তিক ভিত্তি আবিষ্কারে ম্যালিনোস্কির প্রচেষ্টার জন্য তিনি সামাজিক বিজ্ঞানে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে আসীন থাকবেন। পৃষ্ঠা- ৩৭
নৃবিজ্ঞানের পরিচিতি ও তত্ত্ব উপস্থাপন লেখকের মূল লক্ষ্য। মানুষ ও মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সমাজকে বোঝার জন্য নৃতাত্ত্বিক ধারণা ও চেষ্টা সহস্রাধিক বৎসর আগে থেকেই ছিল। হেরোডটাস থেকে শুরু করে মেগাস্থিনিস প্রমুখ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবসমাজের জীবনযাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন। আলোচনা করেছেন সংশ্লিষ্ট সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতি, দর্শন, বিশ্বাসের বিভিন্ন রূপ।
গবেষণাধীন জনগোষ্ঠীর ভাষা গবেষক আয়ত্ত করতে না পারলে কিছুতেই তাদের সাথে মিশতে পারবে না
সামাজিক অবস্থান, আচরণ, পারস্পরিক সহযোগীতা ও শত্রুতা, উৎসবে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, বিবাদে-বিপদে সংঘবদ্ধ অবস্থান- সবকিছুই একজন নৃবিজ্ঞানী গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করেন। নৃতত্ত্বের সংজ্ঞায়ন, উৎপত্তি, বিষয় সংশ্লিষ্ট পণ্ডিত, তাত্ত্বিক, পর্যবেক্ষক, গবেষক প্রমুখের সম্পর্কে পরিচিতিমূলক বিবরণ প্রদানে লেখক সফল। অসংখ্য তত্ত্ব উপাত্ত্বের সমন্বয়ে লেখক তার বক্তব্যকে পাঠকের সামনে পরিষ্কার করতে পেরেছেন।সাদা কাগজে মুদ্রিত বইয়ের ছাপানোর মান ভাল। বোর্ড বাঁধাই হওয়ায় বেশ শক্তপোক্ত। পরিচিতিমূলক রচনাগুলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে লেখা। পরিভাষাজনিত ব্যাপার ছাড়া কোথাও জটিল বা অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। লেখকের বক্তব্যভঙ্গি সরল ও সাবলীল। ফলে বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ পাঠকেরও বইয়ের বক্তব্য সহজে বোধগম্য হবে। বইটি নৃবিজ্ঞান সম্পর্কে উৎসাহী পাঠকের প্রাথমিক জ্ঞান লাভের জন্য বেশ সহায়ক।
বইয়ের শেষে ১৫টি বইয়ের প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ নির্দেশিকা আছে। ফলে আগ্রহী পাঠক বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে গিয়ে দিক হারাবেন না।
০-০-০-০-০-০-
নৃবিজ্ঞান ভাবনা
সাহেদ মন্তাজ
প্রকাশকাল: ২০১৩
প্রচ্ছদ: সুখেন দাস
প্রকাশনী, দি স্কাই পাবলিসার্স, ঢাকা
পৃষ্ঠা: ১০৮
মূল্য: ২০০
ISBN: 984-701450101-6
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম