মেহেদী চৌধুরীর ‘সাহিত্য ও গণিত’ বইটি ২০২২ সালের বইমেলা থেকে কেনা হলেও পড়া হয়ে ওঠেনি শারীরিক ও মানসিক নানান প্রতিকূলতা ও বিপর্যয়ের কারণে। সম্প্রতি সেই অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করা হলো। অর্থাৎ বইটি পড়া হলো।
মাত্র আটটি প্রবন্ধ নিয়ে ছোট্ট এই বইটির প্রবন্ধগুলো মোটাদাগে দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগের পাঁচটি প্রবন্ধে বিষয় হিসেবে গণিত ও সাহিত্য দুইই আছে। শেষের তিনটি প্রবন্ধ সম্পূর্ণই সাহিত্য নিয়ে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলা চলে জীবনানন্দ দাশের কাবিতা নিয়ে।
প্রথম প্রবন্ধের শিরোনাম ‘কবিতা ও গণিত’। স্বাভাবিকভাবেই এই প্রবন্ধে কবিতা ও গণিত নিয়ে আলোচনা আছে। গণিত ও কবিতার সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই দুয়ের মিল অমিলের জায়গায় নাড়া দেয়া হয়েছে। কবিদের মধ্যে যাঁরা গণিতবিদ কিংবা গণিতবিদদের মধ্যে যারা কবি তাদের সম্পর্কেও কিছু আলোচনা এসেছে এই প্রবন্ধে। তবে এই প্রবন্ধটির যে বাক্যটি আমার কাছে খটকা লেগেছে তা হলো,
‘বাংলাদেশের যারা কবিতাচর্চা করেন তাদের অনেককেই দেখা যায় সামাজিকভাবে আগেই প্রতিষ্ঠিত।’
বাংলাদেশের অতীত এবং বর্তমান কালের কবিদের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য কতটা যুক্তিযুক্ত তা পুনবিবেচনার দাবী রাখে।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি বেশ বড়ো। এবং বলা যায় এই বইয়ের শিরোনামের সার্থকতা রক্ষাকারী প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধের বিস্তৃতিও ব্যাপক। প্রবন্ধটিকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগে থাকবে বাংলা সাহিত্য বা কবিতায় গণিত, আর দ্বিতীয় ভাগে বিদেশী সাহিত্যে গণিত। প্রাচীন লোক সাহিত্য থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ইতিহাসের বিশাল অংশের বিভিন্ন পর্যায়ের কবি ও সাহিত্যিকের কাজ সম্পর্কে ধারণা আছে এই প্রবন্ধে। কমলকুমার মজুমদারের ‘অঙ্ক ভাবনা’, মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক’, সাধন দাশগুপ্তের ‘ভাষাগণিত’ থেকে শুরু করে ফরহাদ মজহার, আশরাফ সিদ্দিকী, আজফার হোসেন-এর প্রবন্ধ পর্যন্ত আলোচনায় এসেছে।
এই প্রবন্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো বিশ্বসাহিত্যে কবিতা ও গণিত অংশটিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় কবিতা ও গণিতের সম্পর্ক নিয়ে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। রয়েছে বেশ কিছু গণিত-কবিতার অনুবাদও। বিশ্বসাহিত্যের সুবিশাল রত্নভাণ্ডার থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ নিয়ে আলোচনা করা কম পরিশ্রমের কাজ নয়। যেকোনো আগ্রহী গবেষকের জন্য এই পবন্ধটি ভীষণ কাজের হবে বলে মনে করি। তবে এতো রেফারেন্স ও বিশাল গ্রন্থপুঞ্জি থেকে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত জিয়া হায়দার রহমানের ‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’ উপন্যাসটি কিকরে বাদ গেল তা এক বিস্ময়!
এর পরে আছে বিশ্বসাহিত্য নিয়ে আরো দুটি প্রবন্ধ। একটি ‘বোর্হেসের গাণিতিক বিশ্ব’ ও অপরটি ‘হাউসকিপার অ্যান্ড প্রফেসর: ইয়োকো ওগাওয়ার গাণিতিক উপন্যাস’। এই প্রবন্ধদুটি আর্জেন্টাইন লেখক লুই বোর্হেস এবং জাপানি লেখক ইয়োকো ওগাওয়ার রচনার সাথে পাঠককে শুধু পরিচয় করিয়েই দেবে না বরং তাঁদের লেখনির নানান খুঁটিনাটি দিক সম্পর্কেও অবহিত করবে।
‘হুমায়ূন আহমেদের গণিতবিদ ও গণিতের উপন্যাস’ শিরোনামের প্রবন্ধটিতে হুমায়ূন আহমেদ এর বেশ কয়েকটি কল্পকাহিনির উদাহরণ আনা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি হুমায়ূনের নীবিড় পাঠক নই, এমনকি কল্পকাহিনিরও নয়। তবে কল্পকাহিনির গণিত ও বিজ্ঞান আসলে কতটা প্রকৃত বিজ্ঞান তা বিবেচনার দাবী রাখে।
বইয়ের শেষ পর্যায়ের তিনটি প্রবন্ধ পরিপূর্ণভাবেই সাহিত্য নিয়ে। আরো বিশেষ করে বললে, বলতে হবে জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য নিয়ে। এখানে গণিতের ঠাঁই নাই। প্রবন্ধ তিনটি পড়লে লেখকের জীবনানন্দপ্রিয়তা নজরে আসবে খুব সহজেই। প্রথম দিককার প্রবন্ধগুলোতেও জীবনানন্দ এসেছে কবিতার প্রাসঙ্গিকতা। তবে ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতাতে গণিতের সরাসরি উচ্চারণ নেই’ এমনটা নয়। বরং জীবনানন্দের কবিতায় নিখুঁত বিজ্ঞানের সাথে গণিত, জ্যামিতি, বীজগণিত-এর কথা এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। কবি অত্যন্ত সুনিপুনভাবে এর ব্যবহার করেছেন। ‘কবির বিজ্ঞানবোধ ও কবিতায় বিজ্ঞান : প্রসঙ্গ জীবনানন্দ’ শিরোনামে একটি বিশাল প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল ২০১৭ সালে। সেই প্রবন্ধ থেকে কেবল কবির কবিতাংশ তুলে দেয়া হলো বক্তব্যের পক্ষে স্বাক্ষী হিসেবে।
‘সংকীর্তন শুরু হল মাইলের-পর-মাইল উপবৃত্তাকার
সাঙ্গ হোক না-ই হোক আপেক্ষিক সময়ের মীন
আজও জানে নিউটনি তরঙ্গের শেষ
হবে না ক’-আর কোনও দিন
নক্ষত্রের আলো ঘুরে, পুনরায় শৈশবে, চেয়ে দেখে ফিরেছে স্থবির...
দেখে নেয়। বেলুনের মতো তা কি উড়ে যায় কোনও এক বিশ্রুত দেশে
সেইখানে পরাহত এডিংটন জীনস’ এর কল্পিত সীমানার মান-
উট’এর চামড়া তবু জুতো বানাবার কাজে এসে
কি চায় সেই ভ্রাম্যমান জন্তুর প্রাণ...’
কিংবা
‘তবু যেন জ্যামিতিক ঢের কক্ষ ঘুরে
যত দূর কক্ষ চলে যায়
গণিত নিজের বিদ্যা এখানে হারায়
গভীর-গভীরতর রাত্রির দুপুরে-... আমাদের সকল সুশিক্ষা তবু ছেড়ে দিতে পারি
আমাদের সব স্বপ্ন-প্রকৃতির অপরোক্ষ জ্ঞান
অথবা ব্রহ্মাণ্ডে হাত রেখে তার টের পাওয়া গিয়েছিল যতটুকু নাড়ি
অথবা মোমে পাশে বই রেখে যেই সব দেবী পরি জিন এর সম্মান
পেয়ে গেছি.. ছেড়ে দিতে পারি সব-সুতো কেটে গেছে বলে-
অরুন্দ গ্রন্থির তরে।’
কিংবা,
‘যেন এতদিনের বীজগণিত কিছু নয়,
যেন নতুন বীজগণিত নিয়ে এসেছে আকাশ’
[আজকের এক মুহূর্ত, মহাপৃথিবী]
কিংবা
‘যখন নির্বাণ ছিল-কোনো দিকে জ্যোতিষ্ক ছিল না
যখন শূন্যের সাথে শূন্যের চুম্বনে গাঢ় নীল
নীহারিকা শিখা, সাধ জেগে উঠেছিল
যখন উদ্দেশ্যহীন আর্ত অন্ধ রোদসীকে চোখে রেখে তবু
অগ্নির বর্ণের মতো আমাদের এই পৃথিবীর জন্ম হলÑ
সে আবেগ সেই দিন সে আলোকে জে¦লে
কী যেন অনবতুল আভা চেয়েছিল;
বহে চলা-সূর্যকণ্ঠে কথা বলা-প্রাণ
জন্ম দেয়া
চেয়েছিল।’
[দাও দাও সূর্যকে, অপ্রকাশিত কবিতা]
কিংবা,
‘আকাশে রৌদ্রের রোল, নদী, মাঠ, পথের বাতাস
সেই স্বার্থ বুকে নিয়ে নিরুপম উজ্জ্বলতা হল
শূন্যের সংঘর্ষ থেকে অনুপম হল নীলাকাশ।’
[বিপাশা, অপ্রকাশিত গ্রন্থ]
পরিশেষে, গণিত ও সাহিত্যের মতো দুটি আপাত-বিপরীত বিষয় নিয়ে একটি পুরো বই লিখে ফেলা বাংলাদেশের সামগ্রিক কালচারে খুব একটা সাধারণ ঘটনা নয়। মেহেদী চৌধুরী সেই অসাধারণ কাজটিই করেছেন। এবং করেছেন বেশ সুনিপুণভাবে। সাহিত্য এবং গণিত এই দুটি ভিন্ন বিষয়ে সম্মিলনে লিখতে চাওয়া আগামীর যেকোনো বইয়ের জন্যই এই বইটি একটি আকরগ্রন্থ হিসেবে প্রাসঙ্গিক থাকবে অনেক দিন।
-০-০-০-০-০-০-
সাহিত্য ও গণিত
মেহেদী মাহবুব চৌধুরী
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম