ছোটকাগজ আন্দোলনের অন্যতম কথাসাহিত্যিক সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ফার্মেসীতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ—সাংবাদিকতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন অধ্যয়ন ও জেনোসাইড স্টাডিজ-এ৷ সরকারি আমলার চাকরী হতে স্বমুক্তি, বর্তমানে স্বনিয়োজিত গবেষণা ও লেখালেখিতে৷ আশির দশকে শব্দ-শিল্পী, মূলত গল্পকার হলেও প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস৷ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘সমগ্র রচনা-১’৷ এই সমগ্র এবং তাঁর লেখালিখির বিভিন্ন প্রসঙ্গে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাম্য রাইয়ান৷
সাম্য রাইয়ান: সম্প্রতি আপনার ‘সমগ্র রচনা-১’ প্রকাশিত হলো। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: আমার অগ্রন্হিত রচনার সংকলন বলা যেতে পারে — প্রকাশিত হয় আমার ষাটতম জয়ন্তীকে কেন্দ্র করে ৪ঠা অক্টোবর, ২০২২।
একটি আমার ষাট বছর পূর্তি আর অন্যটি সমগ্র রচনা-১ প্রকাশ (গ্রন্থ প্রকাশ তো লেখকমাত্রের জন্মদিন) দুটো ভিন্নরকম চাপ সৃষ্টি করল। সময় বয়ে যাচ্ছে--এখনও অনেক কাজ বাকি; আরো লেখা বাকি-- কত অজস্র প্লট- কাহিনী, চিন্তা, পরিকল্পনা রূপদান করা হয় নি।
যতদিন, শেষদিবস পর্যন্ত লিখে যেতে পারি, বয়সের এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার খুব সাধ হতে থাকে। সুলেখা এখনও চাই রচনা করতে শেষদিন পর্যন্ত।
আমি খুব এলোমেলো; আমার লেখাপত্র কাগজে-ওয়েবে প্রকাশের পর যত্ন নেই নাই সংরক্ষণে যেন সহজে গ্রন্থ ভার্সন তৈরি করা যায়।
গ্রন্হভূক্ত করেছি যত তারচে বেশি রয়ে গেছে দুই মলাটের বাইরে। ফলে আমি যেমন আমার লেখার সম্পূর্ণ চিত্র দেখতে পাই না তেমনি পাঠকের কাছেও এক জায়গায়, এক ঠিকানায়, সব হদিস তুলে দিতে পারি না ফলে ইচ্ছুক পাঠকের কাছে অজানা থাকে অনেক কিছু।
সমগ্র রচনা -১ প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রত্যাশার সামান্য পূরণ করা গেল। তবে প্রকাশ হওয়ার পর ভালোলাগা জীবন্ত হয়ে উঠতে গিয়েও দম হারায়।
বড় আক্রার দিন এখন। শনৈ শনৈ দাম বাড়ছে বেচে থাকার জীবন সংস্হানে। সাধ্যের বেশি দাম চুকাতে হচ্ছে জীবনযাপনে। এ অবস্হায় লেখক তার রচনার রসদ পেয়ে গেলেও পাঠক বই বিলাসে কতটা উদ্যোগী হতে পারবে, --এই ভাবনা, জটিল এক ভাবনা নেমে পড়ে।
বই প্রকাশ, বিপনন, ক্রয় সব কিছুর সঙ্গে ন্যাটো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ- সবের যোগসূত্র স্হাপিত দেখতে পাই।
ফলে একধরনের বিপন্নতা কাজ করে। বইপড়া এ-সময়ে কতটা বিলাস আর কতটা জরুরি তা আমাকে একটা বাস্তবতার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে।
সাম্য রাইয়ান: আপনার লেখকজীবনের শুরুর দিকের কথা জানতে চাই৷ লিখতে শুরু করেছিলেন কীভাবে?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: পেছনে তাকালে দেখব সুদীর্ঘকাল আমি হেঁটে চলেছি। এ সময়ের মধ্যে কাগজ-কলম দিয়ে লেখা শুরুর পর উপনীত হয়েছি নতুন লিখন-মুদ্রণ-প্রকাশন ব্যবস্হায়; এখন কীবোর্ডে অনবরত অক্ষরপাত করে চলেছি। লেখা মুদ্রণ হচ্ছে লেটারপ্রেস থেকে এখন কম্পিউটার পরিচালিত ব্যবস্হায়।
কলমে লেখা আর কীবোর্ডে লেখা দুটো প্রজন্মের ক্রিয়ার সন্ধিক্ষণের একজন লেখক এই আমি যখন লেখালেখির শুরুর গল্প করব তখন প্রায় চল্লিশ বছরের জার্নিম্যানকে দেখি: লোকটি লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল একদা আর এখন সে জানে না কতটা স্বপ্ন পূরণ হলো! আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মত বিশাল চল্লিশ বৎসরব্যাপী সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নগ্ন ও অনুপুঙ্খ দেখতে দেখতে কোথায় যেন তলিয়ে যাওয়া, হুশ করে ভেসে ওঠা হাতে নিয়ে কড়ি ও কোমল।
আমার যখন জন্ম হয়-- রাষ্ট্র তখন পাকিস্তান; পাকিস্তানের উপনিবেশিককালে বাহান্নর ভাষা সংগ্রামের এক দশক পরে জন্ম। জন্ম মাত্র সুতীব্র চিৎকারে বাক-স্ফূর্তি ঘটল। হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে ও বলতে শিখলাম।
ক্রমে হাতে-খড়ি ঘটল: কালো শ্লেটে লেডপেন্সিল চালনা; বর্ণ শিক্ষা– বাংলা, ইংরাজি, আরবি চলল।
বানান করে পড়া, -- অক্ষর লেখা, -- শব্দ ও বাক্য রচনা। নতুন দাঁত ওঠা শিশু কামড়ে বুঝে নিতে চায় বস্তু ও কণা– যা পায় তাই-ই, তেমনি কাগজ পেলে হস্তাক্ষর চর্চা বেশুমার চলে আর ছাপা বইপত্রের কালি ও কাগজের গন্ধ নতুন এক আকর্ষণের সূচনা করে।
এবার অক্ষরজ্ঞান হতে গ্রন্থজ্ঞান।
আমার ছোটবেলায় এত দুর্বিষহ দিনরাত আসেনি, ঘটেনি আনন্দের ঘটনা; আমার জীবনের মহত্তম সময় মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়; স্বাধীনতা দেখলাম, পতাকা দেখলাম।
আমরা তখন ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্হলে বাস করতাম: সন্নিকটে গভর্ণর হাউস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আর অদূরে রাজাকারদের ঘাটি; রাতের অন্ধকার ভেদ করে বাসার মধ্যে গেরিলাদের চলাচল।
শহরে কান পাতলে শোনা যাবে, বিচ্ছু বাহিনীর তালাশে ঘরে ঘরে সার্চ হবে। বাবার ছিল বইয়ের শেলফ। বলাবলি হচ্ছে, মালাউন লেখকদের বই থাকলে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। তো, বাড়িতে থাকা রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের বই, রাশান আর চায়নার বইসমূহ একরাতে বস্তায় ভরে পার করে দেয়া হল। বাবা সন্তানহারা চেহারা করে বসে রইলেন আর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন বইয়ের খালি আলমারির দিকে। বইয়ের ক্ষমতা, বইয়ের শক্তি সম্পর্কে তখন প্রথম ধারণা হল যে, এতসব থাকতে বই কেন? বই কি অস্ত্র? বই কি বোমা?
বইয়ের প্রতি, স্কুলের বইয়ের বাইরে যত বই– আমি দেশ স্বাধীনের পর এক যুদ্ধ শেষে হঠাৎ এত বড় হয়ে গেলাম– সব পড়তে থাকলাম। বইয়ের মধ্যে কী রহস্য তা আবিস্কার করতেই বোধগম্য হোক না হোক পাঠ করা শুরু করলাম। বইয়ের লেখকদের চেহারা আঁকতে, ভাবতে শুরু করলাম।
বাসার পাশে স্টেডিয়ামে খেলা চলত আর জনসভা হতো আউটার স্টেডিয়ামে। তো বাবার সঙ্গে বিকেলে স্টেডিয়ামে যেতে বইয়ের দোকানের সামনে এলে আমার চলার গতি মন্থর হয়ে যেত। বই- ম্যাগাজিন কিনে না দিলে নড়তাম না।
যখন একা একা যাওয়ার পারমিশান পেলাম– জমানো পয়সা দিয়ে বই কিনতাম, বিশেষত ছোটদের বই। কথা, আইডিয়াস পরে ম্যারিয়েটা, প্রভিনশিয়াল বুক ডিপো ও স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সসহ আরো বইয়ের দোকান মিলে বইপাড়া তখন স্টেডিয়ামে।
ম্যারিয়েটা থেকে টাইম ম্যাগাজিন, রিডার ডাইজেস্ট কিনতেন বাবা। তখন একযোগে বিদেশের সঙ্গে একই দিনে টাইম ম্যাগাজিন ম্যারিয়েটায় পাওয়া যেত।
ম্যারিয়েটার মালিক খালেদ সাহেব আর তার দোকানের শফিকভাই- আরিফভাইরা শুধু বই দোকানে বিক্রি করতেন না, বই পড়াতেনও। শফিকভাই বই হাতে তুলে দিতেন। পয়সা থাকলে কিনতাম নইলে আম্মার কাছ থেকে টাকা আদায় করে কিনতাম।
আরেকটা বিষয়: কে না জানে আমাদের মায়েরা বড় স্টোরি টেলার। আমার আম্মা এখনো যে কোনও ঘটনা গল্পের মত বলে যায়। মায়ের গল্প বলা সুস্পষ্টভাবে আমার লেখা তৈরিতে রেখাপাত করে বলে বোধ হয়। বহুপরে ২০০৫-এ জননীর জন্য গল্প আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে সময় ও বাস্তবতা।
পা বাড়ালেই ছিল স্টেডিয়াম। বই কিনি না কিনি বই- ম্যাগাজিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম- দেখতাম। ম্যারিয়েটার হাত ধরে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে পরিচয়-- কিনতাম, পড়তাম আর ভাবতাম বাবার আলমারির বইপত্রের চেয়ে কত আলাদা এক জগৎ। নতুন ধারার বইপত্র আমাকে মুগ্ধ করে রাখত; গোগ্রাসে পড়তাম--নতুন বই ও লিটল ম্যাগাজিন এলেই খালেদ সাহেব বের করে দিতেন যেন পড়ি।
প্রথাগত সাহিত্য আর নতুন ধারার সাহিত্য ও লেখক অপরিচিত থাকল না।
ছোটদের কাগজে লেখাজোকা করতাম; স্পর্ধা হল, বড়দের লেখা–তখন এইভাবে বলতাম, শুরু করলাম।
সাহস করে প্রথম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা আফ্রিকা-র গল্পরূপ দিয়ে একটা চেষ্টা নিলাম। ছাপা হলো কথক নামের একুশে সঙ্কলনে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের ম্যাগাজিনে লিখে ফেললাম: স্মৃতির উঠোনে জ্যোৎস্না, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গল্প।
লিখলেই কি সেই লেখা কি আর হয়! লেখাপড়া চলতে লাগল। শিক্ষায়তনের পড়াশোনা আড়ালে চলে গেল। পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হত তবুও। কিন্তু শিক্ষাকালীন রেজাল্ট ভালো করা আর ভালো গল্পলেখা এক কথা নয়।
আশির দশকে এলো স্বৈরাচার। এরশাদের শাসনকালে আন্দোলন রোধ করতে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকত। তখন জমে উঠল আমাদের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, রাজনীতিক-সাহিত্যিক আড্ডা ও কালি ও কলম নিয়ে লেখালেখিতে মেতে ওঠা।
ছোটদের লেখা আগে সংবাদ, ইত্তেফাক, কিশোর বাংলা প্রভৃতি কাগজে লিখতাম। পঁচাত্তরের পর জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের কথা যখন সামরিক জান্তা কর্তৃক নিষিদ্ধ ও বিকৃত, সে সময় আমি সংবাদ-এর খেলাঘর পাতায় জয় বাংলা বলে, বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করে ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প লিখতাম। বজলুর রহমান ভাইয়া ছোটদের পাতা দেখতেন। বাংলার বাণীর ছোটদের পাতায় লিখে ফেললাম বঙ্গবন্ধুর ধারাবাহিক জীবনী ইতিহাসের রাখাল রাজা নামে।
স্কাউটিং করতাম যখন, মুখপত্র অগ্রদূত- এ লিখতাম।
বড়দের লিখব কিন্তু তখন বোধ আরো পক্ক হয়েছে– উপলব্ধ হলো সিনেমার কাগজ, রম্য ম্যাগাজিন আর দৈনিকের সাহিত্য পাতায় একধরনের সাহিত্য চর্চা হয়– সেখানে নতুন করে লিখতে মন রাজি হল না।
আমার দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম গল্প জ্যোৎস্নাচারী আর তা প্রকাশ হলো সংবেদ- এ। পরের গল্প অলৌকিক সংবাদ। এভাবে সংবেদ ছাড়াও অনিন্দ্য-এ, পরবর্তী গান্ডীব জুড়ে লেখাপত্তর শুরু হল।
এইভাবে লিটল ম্যাগাজিন ও আমার যাত্রা শুরু।
কথা বলবার আছে অনেক তবে অন্য কোনোদিন, অন্য কোনোখানে মুখোমুখি হব।
সাম্য রাইয়ান: সমগ্র রচনা প্রকাশের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কীভাবে?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: আমি মূলত গল্পকার হলেও প্রবন্ধ ও উপন্যাস লিখেছি। আমি গল্প লেখার পাশাপাশি প্রবন্ধ ও উপন্যাস লিখে কম আনন্দ পাই নাই। আমি যখন প্রবন্ধ লিখি তা শুধু প্রবন্ধ হয়ে ওঠে না। ওখানে প্রবন্ধের মধ্যে কবিতা চলে আসে। অনেক সময় প্রবন্ধ রচনা করতে করতে আমি কখনো গল্প বিন্যস্ত করে আবার প্রবন্ধে প্রত্যাবর্তন করেছি।
বিষয়টি যে-রকম: একটা প্রবন্ধ লিখছি হঠাৎ পেলাম গল্প ঘটে চলেছে আবার গল্প হতে প্রবন্ধ; কবিতাও প্রবন্ধের টেক্সট হয়েছে। আমার গল্প ও প্রবন্ধ কখনো পরস্পর লক্ষণ যুক্ত হয়ে শেষ হয় নাই--- বরং বাবার লেখা চিঠি পোস্টকার্ডের কপি, প্রেসক্রিপশান, ইলাস্ট্রেশান, আমার ওপর কোনো সমালোচনা, বাবাকে নিয়ে স্মৃতিকথা, পারিবারিক সব কিছু, এমনকি কবিতা– লাইনের পর লাইন জীবনানন্দ ঢুকে পড়েছে। তো, এই রকম লেখক আমি, --না প্রবন্ধ না উপন্যাস না গল্প –কোনোটা, –আমার কাছে আমার সব লেখা ফেলনা ভাবতে পারি নাই। লেখার সময় কোনোটি বাদ দিতে পারি নাই যেমন পারি নাই বাদ দিতে বিভিন্ন চরিত্রের গ্রন্থপ্রকাশ।
এ- সকল লেখাকে শ্রেণীকরণের একটা মেজাজ বেশ কতকদিন-- বৎসরকাল নিজের ভেতর বাহাদুর হয়ে উঠছিল। বন্ধু ও সুহৃদরা বলতেন, এবার রচনা সমগ্র বের করা নাকি জরুরি!
আমি ভাবতে লাগলাম। আমাকে ভাবতে তাড়িত করল বাস্তবতা, -- যে, আশির দশক থেকে লিখছি; বই প্রথম বেরোয় ১৯৯৪-তে।
দীর্ঘকাল, --এখন পর্যন্ত লেখালেখি করতে করতে বই বের হয়েছে নানান সময়। সব বই পাওয়া যায় না আবার অনেক বই প্রচার ও ডিস্ট্রিবিউশান দুর্বলতার কারণে ঘনিষ্ঠগণ ছাড়া বহু পাঠকের চোখের আড়ালে রয়েছে। আরো দুঃখের কথা, বেশিরভাগ পাঠক আমার কয়েকটি বই ব্যতিত অন্য বইপত্রের খবর জানে না; প্রচার-প্রসার-বিস্তৃতির অভাবে অনেক পাঠকের অজানা থাকল এবং এ-সব ইত্যাদিসহ আউট অব স্টক - আউট অব প্রিন্ট হয়ে আছে অনেক বই। দুটো বই ছাড়া দ্বিতীয় মুদ্রণ হয় নাই, আর যা হয়েছে তা অবহেলার শিকার।
আমার লেখা শুরু করার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রজন্মান্তর ঘটে গেছে। তাদের কাছে আমার প্রথম থেকে প্রকাশিত লেখাপত্র উপস্থাপন করার একপ্রকার তাড়না, তাদের আয়নায় নিজেকে দেখার ঔৎসুক্য তীব্রভাবে বোধ করি।
আমি লিখতে যতটা নিষ্ঠ, বই প্রকাশে ততটা সচেতন নয় বলেই লোককে জানানো, বই প্রকাশের পর গন্তব্যে পৌঁছালো কিনা— খোঁজ-খবর রাখার ব্যাপারে উদাসীন। ফলে অনেক বইয়ের শেষটা অজানা। তিনটা বইয়ের কোনো কপি নাই আমার কাছে; হাতিয়ারওয়ালা, জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা আর বিস্মৃতি অথবা বিস্তারিত– এই তিন উপন্যাসের।
বিস্তারিত অথবা বিস্মৃতির ছাপা শেষে দুই প্যাকেটে কতক কপি পাওয়ার পর বাকি কপি প্রকাশকের ঘরে যাওয়ার পূর্বে অভূতপূর্ব এক ঘটনা ঘটল: বাইন্ডিং চলাকালে মাস্তানদের আক্রমণে প্রেস-বাঁধাইখানা তছনছ –এক রাতের মধ্যে কাঁটাবনের ভবনটি গুড়িয়ে স্কুল বানানোর বেদম কর্মকান্ডের উপসংহারে আমার বইগুলো বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। প্রেস-মেশিনপত্র সব অপসৃত আর তার সঙ্গে সেখানকার লোকজন বেপাত্তা। বইটি বিস্মৃত হয়ে গেল বলা যেতে পারে।
২০১৬ সালে বেরুলো জ্যোৎস্নায় এক প্রাচীন নৌকা; প্রকাশিত হলে টাটকা দু'চার কপি আনার পর বাকি লেখক কপি নিতে যাচ্ছি-যাব করতে করতে যে-দিন টান পড়ল গিয়ে হাজির হওয়ার পর জানতে পারলাম: সব কপি বিক্রি, দ্বিতীয় দফা ছাপা অচিরে প্রকাশ হবে। তবে তা এখনও হয়নি। তবে সংবাদটি আমাকে আনন্দিত করলেও মজার কথা এই যে, আমি আশেপাশে কাউকে পরে দেখি নাই যে, কিনেছেন- পড়েছেন! এ-রকম নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে আমার গ্রন্থ প্রকাশ অভিজ্ঞতা–নিজের দ্বারা নিজের কর্ম।
দায়ী আসলে আমি; লেখালেখি নিয়ে সৃজনশীল ও মননশীল অথচ প্রকাশিত লেখার গ্রন্হমুদ্রণের ক্ষেত্রে ভীষণ অসচেতন ও ইচ্ছা-নিরপেক্ষ।
আবার লেখাপত্র ও প্রকাশিত বই নিজের কাছে সুন্দরভাবে সংরক্ষণে ভীষণ দুর্বলতা রয়ে গেছে।
ফলে প্রকাশিত নিজের বই ও রচনা খুঁজে পেতে নিজেরই কষ্ট হয়। আমার লেখালেখির মানচিত্র স্পষ্ট করা—মানচিত্র আঁকা সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে– যেখানে সব লেখা জুড়ে তৈরি হবে আমার নিজস্ব জমিন। পুরাতন গ্রন্থের নতুন করে প্রকাশনায় ব্যাপিত হবার চেয়ে সমগ্র রচনার চিন্তা আমাকে একটি পরিণতি দিল। তাছাড়া নতুন পাঠক সমাজের কাছে নিজেকে নিয়ে যাবার দায়বদ্ধতা অনুভব করি; সমগ্র রচনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে চাইলাম।
এখন কম্পিউটারের বদৌলতে সফট কপি রাখি-- সেটাই ভরসা। তবে মুশকিল হলো আগের লেখালেখি নিয়ে-- হাতে লেখা প্রেসকপি দিয়ে লেটার প্রেসে ছাপা চলত বলে এখনকার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।
নানান অভিজ্ঞতা আমাকে জ্ঞান দিল যে, গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত কিন্তু প্রকাশিত এবং যে-সব লেখা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে – সব মিলিয়ে সমবেত লেখা খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড রচনা সংগ্রহ প্রস্তুত করতে পারলে এ-পর্যন্ত সম্পন্ন লেখাপত্তর আর ছড়ানো ছিটানো থাকবে না; একসঙ্গে পাওয়া যাবে– নতুন করে বইপ্রকাশ পর্ব শুরু করা যেন। আসলে এলোমেলো সার্বিক পরিস্হিতি এতটা দিশাহারা করে তখন এই সামগ্রিক রচনার ভাবনা গতি পায়– অবলম্বন হয়।
আর আমার লেখাধর্ম ক্রিয়াশীল থাকলে পরের যত লেখা হবে তাতো বই আকারে বের হতেই পারে; সরাসরি বই করি না আমি, ছোটকাগজে প্রকাশ করার তাড়না বোধ করি সর্বদা।
সব মিলিয়ে সমগ্র রচনা প্রকাশের সিদ্ধান্তে উপনীত এই আমি। নানামুখী চিন্তার সমীকরণ, চিন্তাধারার প্রতিফলন আবিস্কার করি এখন আমি এই গ্রন্থ আয়োজনে; লক্ষ্য করব এক ধরনের অস্হিরতা।
এই হলো সমগ্র রচনা প্রকাশ-পূর্ব ক্রিয়াশীল বিভিন্নমুখী চিন্তাধারার বিক্ষিপ্ত রূপ–অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীত।
এই ধাপে সমগ্র রচনা-১ পাঠক-সমীপে নিবেদন করা হলো। কোনও অনুপস্থিত গ্রন্থের দ্বিতীয় মুদ্রণ ও নতুন বই প্রকাশেরও সুযোগ রইল।
সাম্য রাইয়ান: সমগ্র রচনা প্রকাশ করতে প্রকাশক নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছিল কি?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: প্রকাশনাকর্মটি সবদিক মিলিয়ে জটিল হলেও প্রকাশক নিয়ে জটিলতার শিকার হতে হয় নাই। প্রকাশকগণ বই নয়, বিষয় হিসেবে বের করেছেন আমার রচনাবলী। এর বেশি আর বলব না।
অনুভব বের করেছে আমার সমগ্র রচনা-১ এবং সেই সঙ্গে জেনে বুঝে তার ওপর অর্পিত বাকি রচনা সংকলন খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড প্রকাশের দায়িত্ব এক অর্থে গ্রহণ করেছে সাদরে, সারল্যে।
সুন্দরভাবে ছেপে বের করেছে এই পুস্তক– বলা যেতে প্রায় সাড়ে চারশ পাতার ম্যাগনাম ওপাস; গ্রন্থটি নির্মাণ করতে, লেখকের চাহিদা মেটাতে যে পরিমাণ শ্রম দিতে হয়েছে তা বলার অনতিরেক।
সাম্য রাইয়ান: আপনি লিটলম্যাগের লেখক হিসেবেই পরিচিত, আপনার প্রথমদিকের বইগুলোর ক্ষেত্রে লিটলম্যাগই প্রকাশকের ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে আপনি বাণিজ্যিক প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করছেন। এ বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: জানাতে যেতে বলতে হবে সময় – বলব: সময় –সব নির্ণয় করে দেয়। প্রতিটি গ্রন্থ সময়কে ধারণ করে। সময় সব অনুষঙ্গের মিমাংসা করে অতিবাহিত হয়। সময় সবই সাজিয়ে নেয়; সময় এক বড় নির্মাতা; সময়, তার নিজের মত করে সব গড়ে নেয়।
আমার লেখালেখি, বিশ্বাস লিটল ম্যাগাজিনেই; প্রকাশিত লেখা জড়ো করে বই বেরিয়েছে লিটল ম্যাগাজিন অনিন্দ্য, দ্রষ্টব্য, চালচিত্র-এর ব্যানারে; লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা উলুখড় বের করেছে দুরন্ত সব বই– আমার গ্রন্থও ঠাঁই পেয়েছে। দারুণ উদ্যোগে উলুখড় প্রকাশ করেছে আমার বই।
পাঠক সমাবেশ বই বের করেছিল ২০০৫ সালে —ততদিনে ওরা বের করে ফেলেছে আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র। তখন এই বিক্রেতা ও প্রকাশনা কেন্দ্রটি ছিল লিটল ম্যাগাজিন অন্তঃপ্রাণ আর আমার প্রবন্ধমূলক বইটি ছিল সচিত্র। আইডিয়া আমার, ছবি এঁকে দেয় শিল্পী রনি আহমেদ– পাতায় পাতায় সচিত্রকরণসহ দীর্ঘ প্রবন্ধের বইটি কোনও দ্বিতীয় চিন্তা না করে প্রকাশ করেছিল সমাবেশ।
বই আরো বের করেছে শ্রাবণ, বেহুলা বাংলা এবং সাম্প্রতিককালীন অনুভব প্রকাশনী; আমার লেখার বানিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনা করলে, গ্রন্থ প্রকাশ না করা ছিল তাদের জন্য উত্তম; আমার বই প্রকাশে প্রকাশকগণের ছিল অকুণ্ঠচিত্ত। আমার লেখার ব্যবসায় সফলতা পাওয়ার ন্যুনতম সম্ভাবনা না থাকলেও বইপ্রকাশে তাদের পুঁজিলগ্নী করা বাণিজ্যিক বোধবুদ্ধির পরিচয় দেয় না।
নিজস্ব উদ্যোগে নিজস্ব কায়দায় বই বের করার ইতিহাস ভুলবার নয়। তখন ২০০৬, আমার হৃদ-আক্রান্ত ও সেরে ওঠার পরের বছর-- লোড শেডিং-এ জেরবার, প্রেস এক ঘন্টা পর পর কারেন্টহীন হয়ে পড়তো। ঘামে ভিজে দুর্বল শরীরে বের করে ফেললাম বই তিনটি; অনেক লেখাপত্র আমার প্রিয় ছোট কাগজে ছাপার পর অগ্রন্থিত জমা পড়ে ছিল। যদি আর না বাঁচি; কয়েকদিন আগে হৃদ-বৈকল্য অতিক্রম করে এসেছি-- নানা ভাবনায় মনে হলো বই করে রাখা দরকার। আমার গৃহের নাম নোঙর। আমার দুই আর্থিকভাবে সফল ন্যাংটাকালের বন্ধু, পরে উভয়ই অকাল প্রয়াত ওয়াসিউদ্দিন আরজু আর জাকির হোসেন খোকনের অর্থায়নে নোঙর হতে বই তিনটি বের করি। তার আগে ১৯৯৮ সালে আবদুর রউফ খান ভাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় অনিন্দ্যের ব্যানাারে প্রকাশ করি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প অ্যালবাম লাশ নাই।
বই প্রকাশে সব রকম অভিজ্ঞতা থাকলেও, দারুণ সব বই প্রকাশ পেলেও বড় দুর্বলতা– সংঘবদ্ধ আয়োজনের অনুপস্থিতি বইয়ের প্রচার, পরিবেশন, বিপননে--তাই সমস্ত এসে থমকে যায় একবিন্দুতে।
সাম্য রাইয়ান: সমগ্র রচনার পাণ্ডুলিপি গোছানোর ক্ষেত্রে কোন কোন দিককে প্রাধান্য দিয়েছেন?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: পান্ডুলিপি আয়োজনে সাহিত্যের যে-সকল শাখায় আমার বিচরণ-- গল্প-প্রবন্ধ-উপন্যাস–সব ধারা সমন্বয়ের চিন্তাকে আশ্রয় করে রচনা সংকলনের প্রথম খন্ড বিন্যস্ত করতে অগ্রসর হয়েছিলাম।
লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত অগ্রন্থিত রচনার দিকে তাকাই।
২০০৫ সালে সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধগ্রন্থ ২০১৭ সালে।
২০০৮ সালে আমলাতন্ত্র হতে স্বমুক্তি নিয়ে লেখালেখি করা, নতুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ ও গবেষণাকর্মে ব্যাপিত হই।
উপন্যাস লেখা আরম্ভ করি। এছাড়া প্রবন্ধ লিখে চলেছি।
২০০৮ সালের পর আমার লিখিত এ-যাবত উপন্যাসসমূহ লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে– প্রতিশিল্প প্রথম উপন্যাস ছাপে– বাকি রচনা সময়ের সঙ্গে লিখিত-প্রকাশিত-গ্রন্থিত হয়।
আমার লেখা প্রথম উপন্যাস গ্রন্থাকারে বের করে উলুখড় ২০১২ সালে।
উপন্যাসসমূহ গ্রন্থাকারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
এ-সময় গল্পও লিখেছি তবে লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশ পর্যন্ত; গ্রন্থাকারে উপস্হাপন করা হয়নি।
আমি প্রবন্ধ রচনা করেও চলেছি। এ-ক্ষেত্রেও গ্রন্থপ্রকাশ হয়ে হয়ে ওঠে নি–হয়তো অমনোযোগ!
{ আমার সময়কে অক্ষরে অক্ষরে চিত্রার্পিত করার প্রয়োজন বোধ করি }
আমি বর্তমান রচনা সংকলনের প্রথমভাগে ২০১৮ সালে লিখিত-প্রকাশিত একটি অগ্রন্থিত উপন্যাস, শেষ গল্পগ্রন্থের পর প্রকাশিত গল্পসমূহের সন্নিবিশিত করি।
প্রবন্ধ লেখা হলেও গ্রন্থ প্রকাশ সম্পন্ন হয়নি যদিও দেশে-বিদেশে প্রকাশিত–সমাজ বিজ্ঞানের আলোকে লেখা হয়েছে; রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক লেখাও লিখে গেছি যেমন সাহিত্যকেন্দ্রিক লেখাও রয়েছে।এই সব অগ্রন্থিত লেখার কয়েকটি এই সংকলনে জায়গা করে নিল।
সাল ধরে ধরে লেখা দিয়ে সাজাইনি পাণ্ডুলিপি তবে –গল্প বিন্যাসে কোনো সূত্রও অবলম্বন করিনি, প্রবন্ধ নির্বাচনেও না–, বরং প্রথাসিদ্ধ সূত্র ভেঙে- গড়ে হাতের কাছে থাকা লেখাসমূহ randomভাবে যোগ করে দিয়েছি। দেখি, লেখাগুলো ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বিস্তৃত, ফলে ২০০৮ সালে চাকুরি পরিত্যাগের পর হতে একদশকের লেখাপত্রের মধ্য থেকে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের একাংশ সমগ্র রচনা-১-তে থাকল। তবে অনেক লেখা– বিশেষ করে প্রবন্ধ-নিবন্ধ এখনও অগ্রন্থিত রয়ে গেল। আরো বাদ থেকে গেল পছন্দের গল্প-উপন্যাসও –যা দিয়ে কয়েক খানা গ্রন্থ প্রকাশিত হতে পারে!
লেখালেখি একটি চলমান সৃজন-মননশীলতা –আমৃত্যু ক্রিয়াশীল। মৃত্যুর পরেও লেখা অগ্রন্থিত থেকে যায়, হয়ে ওঠে গবেষণার বিষয়।
এই সমগ্র রচনার প্রথমখণ্ডের পরেও বাদ পড়ল আরো লেখা। আগামী এ প্রশ্নের উত্তর দেবে।
সাম্য রাইয়ান: শিল্প নাকি পাঠক, আপনার দায়বদ্ধতা কার কাছে?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: লেখকের দায় নিজের কাছে এবং তার রয়েছে নিজস্ব কমিটমেণ্ট; সে নিজেও একজন পাঠক, শিল্প ও কমিটমেন্ট বরাবর তার স্হির প্রতীতি থাকে জীবন্ত ।
লেখকের আয়না তার পাঠক –তার আয়না, শিল্প তার মনোচ্ছবি; অঙ্গিকার –কমিটমেন্ট হচ্ছে মূল মন্ত্র।
লেখকের ঋণ রয়েছে স্বদেশের প্রতি–এখানকার অন্ন, জল, হাওয়া, মৃত্তিকা, সবুজের পোষকতায় সে লেখক হয়েছে; রয়েছে তার রক্তঋণ। রণ-রক্ত সফলতায় তাকে জেগে থাকতে হয়।
তার লেখায় তাই বাংলার কথকতা, –ভিন্নপ্রান্তের জাদুবাস্তবতা নয় বরং বাংলার নিজস্ব তরিকা, কুহক –রহস্যসম্ভব বাস্তবতা খেলা করে। বাংলাভাষার লেখক তা অস্বীকার করবে কীভাবে?— সঙ্গে-অনুষঙ্গে? দেশ-জাতির প্রতি থাকতে হয় চেতনার সঙ্গীত।
সাম্য রাইয়ান: একজন পাঠক হিসেবে যখন সমগ্র রচনা পড়ছেন, তখন বইটিকে কেমন মনে হচ্ছে?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: তীর নিক্ষেপ করা হয়ে গেলে তা আর তীরন্দাজের কাছে থাকে না; বাহির হয়ে যায়। তীর ফিরিয়ে আনা যায় না। মহাকাল দেখে তীরের গতি ও তা লক্ষ্যে পৌঁছাল কিনা! তীরন্দাজকে অপেক্ষা করতে হয়, লক্ষ্য ভেদ না হলে নিজেকে আরো শাণিত করতে হয়।
বইয়ের পাতা ওলটাতে ওল্টাতে মনে পড়ে –লেখার দিকে চোখ রাখলে নিমিষে এসে ধর্ণা দেয় একেকটি লেখার ইতিহাস, তা হয় লেখকের ইতিহাস: লেখকের লেখার ইতিহাস অথবা লেখার ভেতর দিয়ে প্রকাশ্য লেখকের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের নান্দীপাঠ–সেই এক ভীষণ পরিক্রমণ আমাকে ভূত-ভবিষ্যতের সঙ্গে কথোপকথনে পরিবৃত্ত করে।
লেখক তো এক ধরনের শব্দের ফটোগ্রাফি করে-- বইটি তাই হয়ে ওঠে ফটোর অ্যালবাম! চোখের ভেতর দিয়ে অবলোকন করতে করতে ভেসে ছবির ইতিহাসে – সময় সময়ান্তরে।
তখন আরেকটি অধ্যায় রচিত যেখানে শুধু বিলয় আর পুনরুত্থান শিল্পের রচনা করে।
সাম্য রাইয়ান: অধিকাংশ লেখক বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করেন, কিন্তু আপনি তা করলেন না। এ প্রসঙ্গে আপনার ভাবনা জানতে চাই৷
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: বইমেলাকে মাথায় রেখে বইপ্রকাশ চলে আসছে। ইদানীং অবশ্য বইমেলার ছাড়া অন্য সময়ে বইপ্রকাশ হচ্ছে। তবে সকল বই শেষ পর্যন্ত জমায়েত হয় বইমেলায়।
বইমেলার অব্যবহিত পূর্বে কি মেলা চলাকালীন আমার বই প্রকাশিত হয়ে পাঠকের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটেছে।
বইমেলাকে বই প্রকাশের উপলক্ষ্য বলা যেতে পারে।
এবার এই রচনা সংগ্রহের পান্ডুলিপি আয়োজন শুরু হয় গত এপ্রিল হতে। আঁতুড় ঘরে একটা সময় পার করে আমার ষাটতম জন্মদিনকে কেন্দ্র করে আমার রচনা সংকলনের প্রথম খণ্ডের আত্মপ্রকাশ। অনুভব প্রকাশনীর তুষার প্রসূন আমার জন্মদিনে এই উপহার দিল। নইলে হয়তো আসন্ন বইমেলাকে এই গ্রন্থপ্রকাশের উপলক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করা হত।
তবে ঠিক কথা যে, একজন লেখক যখন লেখে, বিষয়-ভাষা-আঙ্গিক নিয়ে চিন্তা করে, নির্ঘুম কাটায় —একটা যাত্রার মধ্য দিয়ে দিয়ে যায়, তা এইজন্য না যে তার লেখা গ্রন্থাকারে দেখতে পাওয়া যাবে।
লেখক ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
লেখার গ্রন্থরূপ একটি পরিণতিমাত্র। তারপর পাঠক আছেন আর মহাকাল করে শেষ বিচার সম্পন্ন।
সাম্য রাইয়ান: পাঠকের প্রতিক্রিয়া কেমন পাচ্ছেন?
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: আমি অজস্রবার দেখেছি নীরবতার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে লেখকের হত্যাকাণ্ড। নাকের ডগা দিয়ে পতঙ্গ উড়ে গেলেও আমরা হাত নাড়ি অথচ বই প্রকাশে লেখকের শক্তির উদ্বোধন হলেও দেখা হয়ে যায় কী আশ্চর্য সব চুপচাপ তখন, এমনকি নিকটজন-সতীর্থ, সারথী সকলকে এক প্রকার নিরাবেগ পরিস্হিতি যেন গ্রাস করেছে! এটা এক প্রকার সাইলেন্ট ভায়োলেন্স।
সমগ্র রচনা-১ প্রকাশিত হলে এমন পরিস্থিতি দেখা গেল না; বরাবরের মত সকলে গ্রন্থটিকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। উষ্ণ আলিঙ্গন আমাকে প্রাণিত করেছে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রাথমিক পাঠকপ্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে: কেউ গ্রন্থ প্রকাশের সংবাদে জানিয়েছেন তাদের মনোভঙ্গি, আবার কেউ গ্রন্থটি হাতে নিয়ে প্রকাশ করেছেন তাদের অভিব্যক্তি। সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও মেসেঞ্জারে, ফোনে তাদের শুভকামনা কামনা জানিয়েছেন।
এখন এক ধরনের চাপ-- চুড়ান্ত বিচার যে বাকি রইল!
সাম্য রাইয়ান: লেখালিখি ও গ্রন্থ বিষয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি৷
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ: স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশে তখন সমর নায়কদের ১৫ বছরব্যাপী দুঃশাসন কাল, সে সময় নাৎসি কবলিত ইউরোপের মতো মানুষের জান ও বাক ওষ্ঠাগত। সেই সময়ের আখ্যান রচনার তাগিদ অনুভব করি।
ইচ্ছা আছে লিখি করোনাকালীন দুঃসহ আইসোলেশন, ইনফেকশান: ভীতি-সন্দেহ-অবিশ্বাস, বেচে থাকার স্বার্থপর চেহারা; মৃত্যুকে অবলোকন ও জীবনের অর্থ খোঁজার আখ্যান।
আমার সময়কে অক্ষরে অক্ষরে চিত্রার্পিত করার প্রয়োজন বোধ করি; সময়ের দলিল লেখার কাজটি আবশ্যিক বলে মনে করি।
সারাবিশ্বের মধ্যে আমাদের এই বাংলার উপর দিয়ে বহমান এক রহস্যময় বাতাস অথচ লেখা বাকি রইল পুরানো ভাষা বাদ দিয়ে নতুন আঙ্গিকময় রচনা: কত প্রকার বাতাসে কত প্রকার ঢুলুনি খায় বৃক্ষে বৃক্ষে পাতা আর ডালপালা।
এই নদী, এই বৃষ্টি, এই বাতাস, এই পাহাড়, এই সমতল ও এই সমুদ্রকে অন্বিত করে মানুষের বাঁচামরার সংগ্রাম কোনও দুর্ধর্ষ আঙ্গিক কুশলতায় প্রকাশ করা হল না।
এ-সব কাজ হাতছানি করে ডাক দেয় যেন সংগ্রাম।
গ্রন্থ প্রকাশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে সতত আছে এ-যাবত মুদ্রিত গ্রন্থভূক্ত গল্প ও উপন্যাস নিয়ে রচনা সমগ্রের পরবর্তী আয়োজনের দাবী।
প্রবন্ধসমূহের ক্ষেত্রে গ্রন্থনা ও পরিকল্পনায় আছে বিষয়ভিত্তিক প্রকাশের; আমার ইতিমধ্যে রচিত রাজনীতি, সাহিত্য, চলচ্চিত্র বিভাগওয়ারী প্রবন্ধের বই করা; ইচ্ছা আছে আমার রচিত সাতচল্লিশের দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, মানুষের অন্ন-জল -ক্ষুধা নিয়ে স্বতন্ত্র বই করা।
গ্রন্থভূক্ত করা দরকার প্রিয় সাহিত্যকদের মূল্যায়ন ও গ্রন্থালোচনাধর্মী প্রকাশিত লেখার।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লিখিত আমার সব গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ একত্রিত করে আমার সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ বের করার আকাঙ্ক্ষা আছে।
তবে সব-ই নির্ভর করবে – গ্রন্থাকারে মুদ্রণ সম্ভব হবে যদি মনোমত প্রকাশক এগিয়ে আসেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার খসড়ামাত্র উল্লেখ করা গেল।
অনেক কথা হল। আপনার প্রশ্নের আলোকে স্মৃতি হাতড়ে, নিজেকে নিয়ে এই আলাপ করার সুযোগ পাওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
জয় হোক।
আরো পড়ুন
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম