এ বইটিতে থাকছে বাংলা অঞ্চলের সুফি ও বৈষ্ণব সহজিয়া আন্দোলন নিয়ে দুটি লেখা।
বৈষ্ণব সহজিয়া প্রসঙ্গে~
শ্রীচৈতন্যের শিষ্য গোস্বামীরা বৃন্দাবনে বসে সংস্কৃত ভাষায় শত শত বই লেখেন। সেসব বই কিংবা তাঁদের প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন বা ধর্মতত্ত্বের প্রভাব বাংলার চৈতন্যভক্তদের উপর খুব একটা পড়েনি। ব্রজের কৃষ্ণ বাংলার ভক্তদের কাছে এসেছিলেন কৃষ্ণচৈতন্য হয়ে। তাঁর ভাব ‘ব্রজেরও অকৈবত’, মানে ব্রজের চেয়েও অকৃত্রিম। কারণ তিনি জীবন্ত দেহ নিয়েই হাজির ছিলেন ভক্তদের মাঝে। তাদের কাছে তিনি কেবল কৃষ্ণ নন, রাধা-কৃষ্ণের যুগল রূপ ছিলেন তিনি। চৈতন্যের শিষ্য স্বরূপ দামোদর তাঁর একটি কড়চায় প্রথমবারের মতো এই যুগলাবতার তত্ত্ব দেন, পরে রঘুনাথ দাস লেখেন তাঁর স্তবাবলীতে। দুজনেই পূরীতে দীর্ঘকাল চৈতন্যের সান্নিধ্যে ছিলেন। তাঁরা শ্রীচৈতন্যের মধ্যে রাধাভাব দেখতে পান। রাধাভাব সাধনার এই গূঢ়তত্ত্ব শিষ্য পরম্পরায় পল্লবিত হতে থাকে। চৈতন্যের তিরোভাবের পর বাংলার বৈষ্ণব কমিউনিটি উপলব্ধি করতে থাকে বৃন্দাবন লীলা একবারের জন্য ঘটেনি। এটা নিরন্তর ঘটে চলেছে। নবীন গোরা চৈতন্যের ভেতর দিয়ে যে লীলার প্রকাশ ঘটেছে, সেটাই শেষ নয়। বৃন্দাবন যেমন নিত্য, তার লীলাও তেমনই নিত্য। সবাই সেই লীলার অংশীদার, প্রত্যেকের দেহে আছে নিত্যবৃন্দাবন বা সহজপুর/গুপ্তচন্দ্রপুর, যেখানে আছেন এক রসিক কর্তা, যার আছে অনন্ত রূপ ও প্রকাশ। যুগল সাধনা, মাধুর্য ভজন এবং রাগাত্মিকা প্রেমের ভেতর দিয়ে সেই রসিক কর্তাকে উপলব্ধি করা যাবে। কেবল উপলব্ধি নয়, এই প্রেম বা রূপ-রসের সাধনা সাধকের প্রাকৃত দেহকে অপ্রাকৃত করে তুলবে। সাধক কেবল চিনির স্বাদ নেবেন না, নিজেই চিনি হয়ে উঠবেন। নিজের স্বরূপে যে সহজ কর্তা আছেন তাকে রূপে প্রতিষ্ঠিত করবেন। কাজেই বৈষ্ণব সহজিয়া দর্শন নিজের ভেতরকার অনন্ত সম্ভাবনা আবিষ্কারের দর্শন।
বাংলার চৈতন্যভক্তরা ষোড়শ সপ্তদশ শতক জুড়ে সহজ মতের বেশকিছু বই লিখেছেন বাংলায়। এক্ষেত্রে কৃষ্ণদাস কবিরাজের শিষ্য মুকুন্দ দাস এবং তাঁর শিষ্য মথুর দাস ও যুগলেন্দ্র দাস, রসিক দাস এবং অকিঞ্চন দাসের নাম উল্লেখ করা যায়। ষোড়শ শতকের শেষদিকে উদ্ভূত হয়ে বৈষ্ণব সহজিয়া আন্দোলনটির বিকাশ ঘটে উনিশ শতক পর্যন্ত। বাংলা ছাড়াও বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম অঞ্চলে ছড়িয়েছে এই আন্দোলন।
==*==
বাংলার সুফিয়ানা ও সহজিয়ানা
প্রকাশক: বাতিঘর, ঢাকা
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম