ফরিদ ছিফাতুুল্লাহ লিখিত 'বহুগামী রাস্তার মিমিক্রি' কাব্যের আলোচনা - আহসান হাবিব

ফরিদ ছিফাতুুল্লাহ লিখিত 'বহুগামী রাস্তার মিমিক্রি' বইয়ের আলোচনা - আহসান হাবিব


 


আমি কোলেরিজের সেই কথাটা মানি, কেউ কখনো বড় কবি হতে পারেন না যদি না তিনি একইসঙ্গে একজন শক্তিমান দার্শনিক হন। তাঁর কথাটা ছিল এমন: -

No man was ever yet a great poet without being at same time a profound philosopher

কবিকে কেন দার্শনিক হতে হয়? তাহলে জানতে হয় দর্শন কি? আমার বিবেচনায় দর্শন হচ্ছে কোন ঘটনাকে বিশেষভাবে দেখা। আমাদের চারপাশে যত ঘটনা দেখি, সেসব সাধারণ চোখে দেখা। আমরা শুধু তার বহিরঙ্গ দেখি, সেই দেখায় তার সত্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। কিন্তু একজন দার্শনিক যখন তাকে দেখেন তখন তার বহিঃস্থ এবং অন্তঃপট সবই দেখেন। শুধু দেখেন না, তার একটা সত্যরূপ তুলে ধরেন। হেগেল যখন বলেন যার অস্তিত্ব আছে, তার বিলয় আছে। তিনি বিলয় অর্থে শেষ নয়, রূপান্তর বুঝিয়েছেন। একটা সামন্ত সমাজ চিরদিনই অস্তিত্বমান নয়, তা একদিন রূপান্তর ঘটবে পুঁজিবাদে, আবার পুঁজিবাদ রূপান্তরিত হবে কমিউনিজমে। এই যে একটা ব্যবস্থার বদলে যাওয়া- এই সত্য তিনি কোথায় পেয়েছেন? সাধারণ মানুষ এসব দেখতে পায় না। একজন দার্শনিক যখন ইতিহাসের দিকে তাকান এবং সামাজিক বিবর্তন লক্ষ্য করেন, তখন তার সামনে এই সত্য ধরা দেয়।

কবিকে কেন দার্শনিক হতে হবে? কারণ কবিও তার দেখায় এমন একটি সত্য প্রকাশ করেন, যা সাধারণের চিন্তার বাইরে। জীবনানন্দ যখন তার 'বোধ' কবিতায় বলেন যে লোকটার মাথায় কি এক ভূত চাপলো যে তার মরিবার সাধ হলো! কারণ তার পাশে সবই ছিল- স্ত্রী ছিল, সন্তান ছিল, অভাবও ছিল না, তাহলে তার এই মরিবার সাধ কেন হলো? এই কেন'র উত্তর আমরা সাধারণভাবে পাই না যতক্ষণ না মানুষের মনস্তত্ত্বকে বুঝতে পারছি। মানুষের আত্মঘাতী হওয়ার পেছনে যে জটিল গুঢ়ৈষা ক্রিয়াশীল থাকে যাকে ব্যাখ্যা করা সহজ নয়, জীবনানন্দ সেই মানসিক সত্যের দিকে ইঙ্গিত করছেন। তবে একজন দার্শনিক যে পদ্ধতিতে সত্য প্রকাশ করেন, কবির পথ ভিন্ন। তিনি সত্যকে দার্শনিকতায় রূপান্তর করেন। দর্শন এবং দার্শনিকতা দুটো ভিন্ন বিষয়। একটি নিরেট সত্য যার পেছনে কাজ করে বিধিবদ্ধ পদ্ধতি, কবি সেই পথ অনুসরণ করেন না, তিনি নির্ভর করেন প্রথমত তার ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর, তারপর তাতে তিনি আরোপ করেন তার প্রজ্ঞা, কল্পনাপ্রতিভা এবং ইতিহাসবোধ। কবির সত্য তাই বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে নয়, অনুভব করতে হয় হৃদয়ানুভূতি দিয়ে। ফুলের সত্য প্রকাশ তার সুবাসে, রঙে, এটা বস্তুগত কিন্তু কবির সত্য বস্তুসত্যের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না, তিনি তাতে এমনকিছু আরোপ করেন যা আমাদের সত্য বলে মেনে নেয়। ফুলে গন্ধ নেই- কথাটা বস্তুগতভাবে অসত্য কিন্তু কবির অনুভব সত্য যা তার মানসিক অবস্থাকে বিবৃত করে।



কথাগুলি মনে এলো একটি কবিতাগ্রন্থ পাঠের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। গ্রন্থের নাম 'বহুগামী রাস্তার মিমিক্রি', কবি ফরিদ ছিফাতুুল্লাহ

আমি এই গ্রন্থের ভেতরে প্রবেশ করবো না, শুধু তার নামকরণেই সীমাবদ্ধ থাকবো। কেননা কাবগ্রন্থের নামকরণই একটা দার্শনিক প্রপঞ্চের দিকে ইঙ্গিত করছে। একজন কবি যখন শিরোনামেই দার্শনিকতাকে ইঙ্গিতময় করে তুলতে পারেন, তখন তার কাব্যশক্তি এবং চিন্তা সম্পর্কে কোন সংশয় কাজ করে না।

বহুগামী শব্দটি আমাদের খুব চেনা। এর অর্থের ব্যঞ্জনা আমাদের জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তা আমাদের জৈবিক সত্তা এবং সামাজিক সত্তার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে।

ব্যক্তি বা প্রাণীর বহুগামিতা ছাপিয়ে কবি যখন রাস্তার বহুগামিতার দিকে ইঙ্গিত করেন, আমরা প্রথমে হতচকিত হই, আমাদের ভেতর বহুগামী সত্তা দুলে উঠে, রাস্তা আমাদের দুদণ্ড শান্তি দিতে এগিয়ে আসে। আমরা রাস্তার বহুগামিতা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি।

তখন আমারা অচিরেই এই সত্যে উপনীত হই যে সত্যিই তো রাস্তা তো বহুগামিই! একটা রাস্তা কি শুধু কি নিজে নিজে কোথাও শেষ হয়? হয় না, সে আর একটা রাস্তার দিকে হেঁটে যায় এবং মিশে যায়। ঠিক যেন নদীর মত। পৃথিবীতে কত পথ, কত নদী। এই যে কবি রাস্তার বহুগামিতা নিয়ে আমাদের একটা সত্যের দিকে নিয়ে গেলেন, এটাই দার্শনিকতা।

একটা রাস্তা কিভাবে বহুগামি হয়ে ওঠে, তার কাব্যিক প্রকাশ আছে তার 'রাস্তা' নামের কবিতাটিতে। আমি সে আলোচনায় পরে যেতে পারি। এখন আমি আর যে শব্দের প্রতি আলো ফেলতে চাই, তা হলো 'মিমিক্রি' এই শব্দটির প্রতি।

আমরা কমবেশি বুঝি মিমিক্রি কাকে বলে। আসলে এই মিমিক্রির প্রকাশ প্রকৃতি এবং প্রাণীর নানা কাজে জড়িয়ে আছে। আমরা হরহামেশাই মিমিক্রি করতে থাকি। এটা আমাদের একদিকে যেমন ডিফেন্স বা নিজেকে আড়াল করে রক্ষা করার কৌশল, অন্যদিকে এর মধ্য দিয়ে আমরা নির্মল আনন্দ উদযাপন করি। এটাও আমাদের ভেতরের নানা যন্ত্রণাকে লাঘব করে। আমরা যদি মিমিক্রির এইসব সাধারণ বিষয়গুণ ছেড়ে এর ভেতরের মনস্তত্ত্বে প্রবেশ করি যা কবি ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন তা এক অনালোকিত দার্শনিক চিন্তাকে সামনে এনে দাঁড় করায়। আর তা হলো রাস্তার মত আমাদের চিন্তার বহুগামিতা। আমরা ব্যক্তি হিসেবে সমাজকে কি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চাই, সামাজিক সম্পর্ককে কিভাবে দেখতে চাই, তা কি মনোগামি নাকি একইসাথে বহুগামি অথবা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বদলে বদলে ধারণ করি? তিনি রাস্তার বহুবিধ ভূমিকার কথা তার রাস্তা কবিতায় বলেছেন। তখন আমাদের জীবন এবং রাস্তা একই রেখায় এসে দাঁড়ায়। কারণ রাস্তাও নিজেকে বদলায়, রাস্তাও মানুষের মতই কথা বলে ওঠে কিংবা দেখিয়ে দেয় বহুগামিতা। এই বহুগামিতা মানুষের ক্ষেত্রে দার্শনিক সত্তারূপে হাজির হয়। আমাদের ভেতর এক দার্শনিক বোধ জেগে ওঠে। আমরা প্রতিদিন রাস্তায় হাঁটি, দেখি, কিন্তু এই দেখা সাধারণ দেখা, বিশেষ দেখা নয়। কবি যখন তার দেখা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেন, আমরা হতচকিত হই, এক অনাস্বাদিত সত্যের দেখা পাই, তখন আমাদের ভেতর যে আনন্দের বোধ জন্ম লয়, তা বস্তুর সত্য ছাপিয়ে অধরা চিন্তার সত্য অনুভূত হয়, আমরা কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।



রাস্তা হাঁটে পথিক যদি হাঁটে
বহুগামী মনে হলেও রাস্তা এবং পথিক
উভয়েই মনোগ্যামি


এই হলো 'রাস্তা' শিরোনামের প্রথম কবিতা। রাস্তা কি হাঁটে? কেউ কি কখনো দেখেছে? দেখেনি, কিন্তু কবি দেখেছেন, তার অবলোকন সাধারণ নয়, বিশেষ।
কবিকে কেন দার্শনিক হতে হবে? কারণ কবিও তার দেখায় এমন একটি সত্য প্রকাশ করেন, যা সাধারণের চিন্তার বাইরে
তিনি রাস্তা এবং মানুষকে একইসঙ্গে গতিশীল হিসেবে দেখছেন। রাস্তা দাঁড়ায় যদি পথিক দাঁড়ায়, পথিক হাঁটলেই রাস্তাও তার সংগে সংগে হাঁটে। তখন সময় এবং স্থান মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়ে। আর আমরা তো জানি পৃথিবীর কোনকিছুই স্থির নয়, গতিশীল। কিন্তু এই গতিশীলতা আমরা দেখি না, কবি দেখতে পান এবং দেখান। কবির আগে বিজ্ঞানীও দেখেন, কিন্তু তার দেখা কবির মত নয়, যেমন নয় দার্শনিকের মত। কবি, বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক যখন দেখেন, তখন বস্তু তার রূপেই থাকে কিন্তু তাদের প্রকাশভঙ্গী হয়ে পড়ে আলাদা, বস্তুর সত্যরূপেও দেখা দেয় ভিন্নতা। কিন্তু কোন সত্যকেই কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিকের সত্য আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে কিন্তু কবি আমাদের চিত্তের অনুভবকে এমনভাবে প্রসারিত করেন যে তা আমাদের সংগী হয়ে থাকে আমরণ। কবির সত্য তাই বড় সত্য।

আবার বহুগামি এবং মনোগ্যামির যে নিত্য দ্বন্দ্ব আমাদের চেতনায় ক্রিয়াশীল, রাস্তা এবং পথিকের বহুগামিতাকে কবি এক ঝটকায় মনোগ্যামিতে রূপান্তরিত করেন, তখন দ্বন্দ্বটা আরো রক্তাক্ত হয়ে ওঠে এবং একইসাথে অবচেতনে জমে থাকা কলুষ নির্গমনের পথ খুঁজে পায়।

রাস্তা আসলে সুপ্তপ্রাণ শুকনো নদী


এক লাইনের একটি সম্পূর্ণ কবিতা। কেন? কারণ এই লাইনের ভেতর দিয়ে নদী বা জলাধার এবং রাস্তার জলহীনতার বস্তুগত দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। দ্বন্দ্ব মিটেছে বটে কিন্তু নতুন দ্বন্দ্বকে হাজিরও করেছে। রাস্তা কি কখনো জলমগ্ন নদী হয়ে উঠতে পারে?

কে জানে, হয়তো পারে, কিংবা পারে না।

রাস্তারও অসুখ করে। দেহ ক্ষত বিক্ষত হয়।
আবার সেরেও ওঠে


এই  লাইন দুটিতে হঠাৎ রাস্তা প্রাণময় হয়ে ওঠে। তখন আমরা নতুন করে রাস্তার দিকে তাকাই, দেখি সত্যি তো রাস্তারও অসুখ হয়। তখন আমাদের রাষ্ট্রের দিকে চোখ পড়ে, উন্নয়ন নামের এক সভ্যতার চাকার কথা মনে পড়ে। আমাদের অসুস্থ দেহযন্ত্রের মত রাস্তার অসুখও সারে, যখন সেসব মেরামত হয়। তখন দেহটিকেও একটা যন্ত্রই মনে হয়।

রাস্তা বিষয়ে এই যে বিবিধ অবলোকন, তা সাধারণ নয়, বিশেষ অবলোকন। অথচ এই অবলোকনে তিনি আশ্রয় করেছেন কেবল ইন্দ্রিয়ানুভূতির। এই অনুভূতিকে তিনি এমন এক ভাবনায় পর্যবসিত করেন যে তা রূপান্তরিত হয় দার্শনিকতায় যা একটি কবিতাকে কবিতা হয়ে ওঠার সত্তা দান করে।



ফরিদ ছিফাতুুল্লাহ'র সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থে এমন দার্শনিকতা ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কবিতায়। আমি বলবো না তার কাব্য ভাষা কোন অনন্যতায় ভাস্বর, বরং বলবো বিষয় কিংবা ভাব যখন সত্য হয়ে ওঠে, তখন কাব্যভাষা গৌন হয়ে পড়ে।  

নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও রাস্তা গন্তব্যে পৌছায়


এই কবিতায় ভাষা বা বলবার ঢঙে নতুনত্ব নেই, কিন্তু বক্তব্যের নতুনত্বে তা ছাপিয়ে আমাদের অনুভবকে দখল করে বসে, আমরা এক দার্শনিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ি।

ফরিদ ছিফাতুুল্লাহ বিরচিত 'বহুগামী রাস্তার মিমিক্রি' কাব্য পাঠের এই হলো আমার প্রাপ্তি।


************
বহুগামী রাস্তার মিমিক্রি
ফরিদ ছিফাতুুল্লাহ


প্রকাশনা সংস্থা: জাগতিক
প্রচ্ছদ: মিজান স্বপন
নামলিপি: রিঙকু অনিমিখ
প্রকাশক: রহিম রানা
প্রকাশনী: জাগতিক প্রকাশনী, ঢাকা
মূল্য: ২৫০ টাকা
পাওয়া যাচ্ছে লিটলম্যাগ চত্বরের পাশে ৭২ নম্বর স্টলে জাগতিক প্রকাশনে।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ