প্রীতির 'জন্ম ও যোনির' ইতিহাস বইটা বেশ কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত পড়লাম, খুব অনাকর্ষণীয় এবং সহজ একটা বই। এরকম বই শেষ পর্যন্ত পড়তে আমার কষ্ট হয়, অবশ্য একই কারণেই জোর করে হলেও দ্রুত শেষও করা যায়।
আমার ভালো লাগে এমন বই পড়তে যা আমার বুদ্ধিমত্তাকে, বোধকে এবং জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে; আমার মস্তিষ্কের 'পেশীগুলোর' শক্তি যার সাথে পাল্লা দিতে না পেরে ভেঙ্গে যেতে যেতে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে; যে বইয়ের সবটা এক পড়ায় বুঝতে পারি না এবং দ্বিতীয়বার না পড়তে পারলে আক্ষেপ থেকে যায়; যে বই শেষ হয়ে গেলে বিষন্নতায় ভুগি কারণ এই সমাপ্তি আমাকে একটা নতুন আবিষ্কৃত জগত থেকে ঠেলে বাস্তবে ফেরত পাঠিয়ে দেয়; অথবা যে বইয়ের কাব্যের মতো ছন্দময় ভাষা নৌকায় বসে নদীর বুকে দোল খাওয়ার অনুভূতি দেয়, নতুন কোনো অভিনব ভাবনার উদ্রেকে আমাকে চমকিত করে, অথবা মনের গভীরের অপরিচিত কোনো অনুভূতির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমাকে বিস্মিত করে দেয়।
প্রীতির বইটাতে এরকম কিছু পাইনি। এই বই দ্বিতীয় বার পড়ার, সংগ্রহে রাখার বা কাউকে পড়তে উৎসাহিত করার কোনো কারণ নেই।
তবে অবশ্যই স্বীকার করব সমাজ এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে কিছু সর্বজনবিদিত সত্য তুলে ধরেছেন তিনি যেসব সত্য হর হামেশা পত্রিকায় অথবা ফেসবুকের স্ট্যাটাসে পড়ি আমরা। পাঁচশো, এক হাজার অথবা পনেরোশো শব্দের লেখায় জানা কথা আবার পড়তে মন্দ লাগে না, কিন্তু প্রায় দুশো পাতা জুড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা পড়তে গেলে ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে, বিশেষ করে যদি বলার কৌশলে সেরকম দক্ষতা না থাকে।
এতোক্ষণ যা বললাম তা কোনো আপত্তির বিষয় হতে পারে না। প্রীতি যেসব নামকরা লোকজনের সাথে শোবার কথা লিখেছেন তাদের দুইজনের সাথে বাস্তবে আমার পরিচয় আছে, একজনের সাথে ফেসবুকে। তাদের সম্পর্কে প্রীতি যা লিখেছেন তা সত্যি হয়ে থাকলে এতেও আপত্তির কিছু নেই। কাউকে আমি চিনলেই তারা ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে যাবেন এমন নয়। বাংলাদেশের চেনাজানা সব নারীবাদীদের ধুয়ে দিয়েছেন প্রীতি, এক্ষেত্রেও আপত্তি করার মতো একটাই বিষয় হতে পারে যে এই লন্ড্রির তালিকায় আমার নামটা নেই। হতে পারে আমি যথেষ্ট নারীবাদী নই, অথবা প্রীতির বিরুদ্ধে আমি যথেষ্ট খারাপ কিছু করিনি। প্রীতি নিজের যৌন জীবন নিয়ে খোলামেলা লিখেছেন, এতেও আপত্তির কিছু থাকতেই পারে না।
আমার চোখে এই বইয়ের সবচেয়ে আপত্তিকর দিকটা হচ্ছে- যা ইতিমধ্যে অনেকেই লিখেছেন - breach of confidentiality. বিশেষ করে অনুপস্থিত, অনবহিত, nonparticipant third party সম্পর্কিত একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যের ক্ষেত্রে যা সেই ব্যক্তি নিজে তাকে বলেনি।
প্রীতি নাকি অনুরোধ করেছেন একটা মাত্র ভাইরাল পাতার উপর ভিত্তি করে বইটির বিচার না করতে। আসলেই এরকম পাতার সংখ্যা খুবই কম। ওই একমণ দুধে কয়েক ফোঁটা লেবুর রসের মতো। তবে এই বইয়ের বেশিরভাগ পাতা নির্দোষ হলেও ঠিক দুধের মতো নয়, হলে ছানার মিষ্টি বানানো যেত হয়তো বা।
আমার আরেকটি আপত্তি হচ্ছে প্রীতির পুরুষের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করার ব্যাপারটি। তার হাই প্রোফাইল সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে পুরুষটি সবসময় দোষী এবং তিনিই সবসময় যথাযোগ্য আচরণ করেছেন - এটাকে তিনি আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেননি।
পুরুষতন্ত্রের আজন্ম শিকার একজন নারী হিসেবে আমি সবসময় নারীর পাশে দাঁড়িয়েছি। নারী হিসেবে প্রীতির সংগ্রামের গল্প আমার মন ভেজাতে পারেনি, কারণ তিনি প্রচুর সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন যা বেশিরভাগ নারী কেন, পুরুষও পায় না। অবশ্যই তাকে যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সেটা অন্যায়। আমার কিছু পুরুষ বন্ধুকেও লেখালেখির কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছে, অথবা সুযোগ সন্ধান ও লাভে ব্যর্থ হয়ে দেশেই গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে। এরকম অভিজ্ঞতা আর কারো না হোক। প্রীতির বইটি কি এরকম পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? বইটির সেরকম কালজয়ী শক্তি আছে বলে আমার মনে হয়নি।
বইটি পড়তে বা না পড়তে কাউকে পরামর্শ দেব না। আমি পড়েছি বলে পস্তাই না। ঘন্টা চারেক ব্যয় হলেও কৌতূহল দমন তো হলো।
বইটি পুরোটা পড়ার পরও আমার আগের বক্তব্যই বহাল থাকলো--
"স্বেচ্ছায় যার সাথে বিছানায় যাব তাকে আমি 'লোলুপ' ডাকতে পারি না। শুতে শুতে সে যদি তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সাথে অতীতে শোবার কথা গল্প করে, সেই গল্পের গোপনীয়তা ফাঁস করতে পারি না। এসব করে অর্জিত প্রচারকে ভুলেও জনপ্রিয়তা ভাবতে পারি না।"
প্রকাশের খবর: জন্ম ও যোনির ইতিহাস - জান্নাতুন নাঈম প্রীতি
================
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম