ফারহানা রহমান এর কাব্য 'লুকিয়ে রেখেছি গোপন হাহাকার' - আহসান হাবিব

ফারহানা রহমান এর কাব্য 'লুকিয়ে রেখেছি গোপন  হাহাকার' - আহসান হাবীব

 
আজ সারাদিন একটি কাব্যগ্রন্থ পড়লাম। বিগত দিনের মতই আবার উপলব্ধি করলাম পৃথিবীতে যত কবি, ততরকম কবিতা। একই সময়ে লিখছেন, একই সময়ের সব অভিঘাতের মুখোমুখি হয়েও এক একজন মানুষ এক এক রকম ভাবে সেসব অনুভব করছেন এবং নিজের ভাষায় বাঙময় করছেন। কিন্তু দেখেছি আমরা যখন কোন কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করি, প্রায়ই দেখি তুলনা করে বসি। বিশেষত সেই কবির সংগে যিনি বা যারা ইতোমধ্যে জনমানসে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। ফলে প্রত্যেক কবির যে আলাদা স্বর, তা শনাক্ত না করে গুলিয়ে ফেলি।

আজ ফারহানা রহমানের কাব্যগ্রন্থ ‘লুকিয়ে রেখেছি গোপন  হাহাকার’ পাঠ করে একজন ভিন্ন স্বরের কবিকে আবিস্কার করলাম। জীবন তাকে যা কিছু উপহার দিয়েছে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন সময়ে, সেসব তিনি নিজের মত করে প্রকাশ করেছেন কবিতায়। সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ পাঠ করে মনে হল কবি একটি নিজস্ব কথন ভঙ্গিমা অর্জন করেছেন। প্রতিটি কবিতায় তার এই ভঙ্গিটি ধরা পড়ে যা অন্য কোন কবির সংগে মেলে না।

কোথায় তিনি অনন্য ?

ঐ যে বললাম তার বলবার ভঙ্গিমাটি অন্যের চেয়ে আলাদা। তার স্বর নীচু, শান্ত এবং প্রায় দ্রোহহীন। আর সবচাইতে যে বৈশিষ্ট্যটি বিশিষ্ট হয়ে ফুটে আছে তা হল তার সব বক্তব্যই ব্যক্তিগত। সমষ্টির হয়ে তিনি কিছু বলছেন না। ব্যক্তির যা কিছু তা তিনি কবিতায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্য ব্যক্তির কাছে যা কখনো সার্বজনীন হয়ে উঠছে আবার কখনো উঠছে না। কিন্তু তাতে কবিতার অনুভবটি অউপলব্ধ থাকছে না। পাঠকের মগজে সেটিও একটি অনুরণন তুলছে।

যদিও কাব্যগ্রন্থের নাম ‘লুকিয়ে রেখেছি গোপন  হাহাকার’ কিন্তু কোন হাহাকারই আসলে গোপন থাকেনি। প্রকাশ হয়ে পড়েছে আর আমরা সেই হাহাকারের মধ্যে গিয়ে পড়েছি। কবির প্রায় সব হাহাকার তার প্রিয় একজন পুরুষের জন্য যে পুরুষ তাকে বেদনায় ভাসিয়েছে, আকাংখাগুলি নিয়ে খেলেছে। কবি দুঃখ পেয়েছেন কিন্তু সেই দুঃখে বিদ্রোহী হয়ে উঠেননি। শান্ত স্বরে নিজের বেদনার কথা বলে গেছেন। ‘আত্মসমর্পণ’ এই গ্রন্থের প্রথম কবিতা, সেখানে তিনি বলছেন-

তোমার জন্য এই যে
চিবুকের হাড়ে লুকিয়ে রেখেছি গোপন হাহাকার


তাকে বলছেন বটে কিন্তু কোন অভিযোগ করছেন না, প্রাপ্ত বেদনা বুকে নিয়ে আবার তিনি ফিরে যেতে চাইছেন জীবনের কাছে, এই জীবন হচ্ছে এমন এক জলধি যা সবকিছুকে ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন। শেষ লাইন-

নাভির শেষ সীমানায় ফিরে যাওয়ার পথে
আমাকেও সাথে নিও জীবন


‘খোঁজ’ কবিতায় তাই তিনি আবার জোর দিয়ে বলছেন-

আবারও যদি ডাকো নক্ষত্রের নিবিড় সিথানে
জেনো আত্মহননের আগে খুঁজে নেবো নিজেকেই


কবির হৃদয় কতটা বিক্ষত হলে এমন একটি বিনাশী পথ খুঁজে নিতে শপথ করায়। এমন হয়, প্রেম মানুষকে এমন বেদনাদীর্ণ করে। তাকে দ্রোহী করে তোলে। কেউ এই দ্রোহকে প্রকাশ করে তীব্র স্বরে কিন্তু আগেই বলেছি ফারহানা রহমান সে পথে হাঁটেননি, হেঁটেছেন ঋজু অথচ কোমল পথে।

তার স্বর নীচু, শান্ত এবং প্রায় দ্রোহহীন
৫৫ টি কবিতায় সাজানো এই গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি কবিতায় আমরা একজন পুরুষ প্রেমিক পাই। এই প্রেমিকের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন মুখের ওপারে মুখোশের ছবি। এই মুখোশে লেখা আছে নানা রঙ, নানা ছলনা। এইসব তিনি লিখে রাখেন তার নিজস্ব নোটবুকে। কিছুই ভুলেন না। কিছুই যে ভুলেন না তার প্রমাণ একটি সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ লেখা হয়ে যায় এই একটি বিষয়কে প্রধান করে। সবখানেই তার স্বর শান্ত, কিন্তু মাঝে একবার স্বর উঁচু করেন, ডাক দেন আন্দোলনের। একটা মেয়ে যখন বেদনায় ডুবে যাচ্ছে মোমের মত, মরে হিম হয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি স্বর উঁচু করেন, বলেন-

তবে হোক প্রতিবাদ
ছড়িয়ে পড়ুক দিকে দিকে তোমার ধিক্কার
হোক তবে আবার, আবার আন্দোলন


ঐ একবারই, এর পরে আর এমন ডাক দিতে দেখি না। নারী পুরুষের সম্পর্ককে কবি একসময় ‘অসুখ’ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তিনি বলছেন এটা তারা দুজনেই জানতেন। জানতেন অথচ এই যে জড়িয়ে পড়া এটাই জীবনের প্যারাডক্স। সম্পর্কের ভেতর অহরহ খেলা করে সন্দেহ, অবিশ্বাস। এই সন্দেহ কিংবা অবিশ্বাস কিন্তু আপতিক নয়, সমাজ ব্যবস্থায়ই এটি উপহার দেয়, বিশেষত পুঁজিবাদী সমাজে সম্পর্কের প্রধান উপাদানই হল সন্দেহ আর অবিশ্বাস, তাই একদিন সেটা ভেঙে পড়ে। এই ভেঙে পড়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী। তাই পুরুষের কণ্ঠে আমরা প্রায় শুনিনা যে ভালবাসার সম্পর্ক একটি অসুখ, এই অসুখ মুলত পুরুষজাত। ‘অসুখ’ কবিতার শেষ কয়েক লাইন এমন-

হৃদয় এখন এক পিপাসার কারাগার
তাই শুধু সন্দেহের বীজ...
এখন আমরা জেনে গেছি
ভালোবাসা এক ভীষণ অসুখ


ফারহানা রহমান কোন কোন কবিতায় দারুণ ইমেজ তৈরি করেন। ‘উদাসী রোদ্দুর’, ‘ঘুম নিভিয়ে দিচ্ছি’, ‘কয়েক কাপ কফিতে ভেজানো এই অবশ বিকেল’ কিংবা ‘চিলের মত নীল’! দেখতেই পাচ্ছি সবকটি ইমেজ হৃদয়ে বেদনা জাগায়। কবি যে তার প্রিয় মানুষের কাছ থেকে কত গভীরতম দুঃখ লাভ করেছেন, তার সবটুকু ব্যক্তিগত কুঠরিতে গোপন রাখতে চাইছেন। এই ব্যক্তিগত গোপন গভীর দুঃখের অনুবাদই হচ্ছে ‘লুকিয়ে রেখেছি গোপন হাহাকার’। ‘পানকৌড়ি’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করছি-

কয়েক কাপ কফিতে ভেজানো এই অবস বিকেল
রবিঠাকুর!
তোমার সুরের লহরে ভেসে যাচ্ছে
ইনসমনিয়াক মাঝরাতে যেমন ভর করে ঝিঁঝিঁপোকাদের কুহকী মিছিল
তেমন সাঁঝভাঙা আকাংখার স্রোতে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি
একটি ব্যক্তিগত পানকৌড়ি


একটি ডানাহত পাখির গল্প যেন যে পাখি জলের স্রোতে ভাসতে পারে শুধু, তাকে কবি উড়িয়ে দিতে চাইছেন, কেননা এই পাখি যে ব্যক্তিগত পাখি। ‘পাথর সময়’ কবিতায় তিনি সম্পর্ককে আবার অন্য এক রূপে বর্ণনা করছেন, বলছেন- ‘ঠোঁটের উত্তাপ ফুরিয়ে গেলে/ সময় এক কর্কশ পাথর বই কিছু নয়’ । সবকিছু যেন একটা বিন্দুতে এসে মিলেছে যার ফল আর কিছু নয়- শূন্যতা।

সম্পর্কের এই নানা মুখিন কাটাছেঁড়া কিন্তু শেষ অবধি ব্যক্তিগত থাকে না, প্রতিটি ব্যক্তির হয়ে সামস্টিক হয়ে ওঠে যখন তিনি বলেন-

বিশ্বাস নিয়ে খেলতে চাও?
কি ভাবছ,
যখন চাইবে দুপায়ে দলিয়ে চলে যাবে...

জেনেছি মিথ্যাতে উষ্ণতা আছে, আছে অক্ষমতা
অথচ সেই মাধ্যাকর্ষণের জোরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়িতে বোকাট্টা
লুসিফার! এই প্রণয়ের প্রহেলিকা ! এই আঁজলা আঁজলা ভরা পাপ...
আর কত?
এবার একটু ক্লান্ত হও, হও ক্ষান্ত!


এই বোধ সব মানুষকে ছুঁয়ে যায়। কেননা আমরা সবাই একই সম্পর্কের সুতায় গাঁথা থাকি। আমাদের সব গোপন হাহাকারগুলি চিনে উঠতে পারি যার কাব্যিক অনুবাদ আমরা পেয়ে যাই ফারহানা রহমানের কবিতার বই ‘লুকিয়ে রেখেছি গোপন  হাহাকার’ এ।

শেষ কবিতাটি উদ্ধৃত করে শেষ করছি ‘লুকিয়ে রেখেছি গোপন  হাহাকার’ কাব্যগ্রন্থের পাঠ প্রতিক্রিয়া। কবিতার নাম ‘শেষ তপস্যায়’

তাকিয়ে থাকার দীর্ঘ প্রতীক্ষার কালে
পাতা ঝরে নির্বাণের প্রগাঢ় আঁধারে
নীরব ঘাটের ধারে শেষ তপস্যায়
প্রাপ্তির মায়ায় কভু ভালোবাসা আনে
এতো যে গভীর জল
উদাস নয়নে ঘোর
তবু ঘুরে ঘুরে কথা কয় অনুভূতি!



ফারহানা রহমানের কবিতার বই ‘লুকিয়ে রেখেছি গোপন  হাহাকার’ পাঠকের অনুভূতিকেও নাড়িয়ে দিয়ে যায়, সেগুলি নতুন হয়ে ওঠে, অধিকতর শিক্ষিত করে তোলার কাজটি গোপনে করে চলে।

**********
লুকিয়ে রেখেছি গোপন  হাহাকার
ফারহানা রহমান

প্রকাশক: অনুপ্রাণন
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ