আমার তখন নিজেকে আরব্য রজনীর বাদশাহ্ বলে মনে হতো, যখন সে প্রতিবার বিছানায় উদ্দাম সঙ্গম শেষে আমাকে একটা করে গল্প বলতো। অদ্ভুত সব সর্বগ্রাসী গল্প ছিল তার ঝুলিতে। যার বেশিরভাগই পরের দিনের জন্য অসমাপ্ত রেখে যেত। আরব বাদশাহর মতো পরদিন সকালে কল্লা নেয়া হবে, এমন তো কোন বিষয় ছিল না। তবু সে অর্ধেক গল্পের এক অতৃপ্তি রেখে চলে যেত প্রতিবার। আমার সাথে কখনোই পুরো রাত কাটায়নি সে, একবারও না। আমার কেন জানি মনে হতো, গল্প বলাটা আসলে মূখ্য ছিল না, সে চাইতো আরো খানিকটা সময় কাটাতে। আদিম সুখের অনুভূতিটা আরো কিছুক্ষণ বয়ে নেয়ার জন্য নিজের অবসন্ন দেহটা আমার নিস্তেজতায় মেলে দিতে। কিংবা, হয়তো আমার গৃহবন্দি জীবনে সঙ্গ দিতে আসা সময়টা আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে চাইতো সে।
তাঁর কোন নাম ছিলনা। কোনদিন নিজের নাম বলেনি সে আমাকে। আসলে আমি জানতেও চাইনি। মনে আছে, একেবারে প্রথমদিন সে চলে যাবার পর আমার লুকিয়ে রাখা ছোট্ট নীল ডায়রিতে তাঁর কথা লিখতে বসে হোঁচট খাই। নাম তো জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কী নাম তার? তখনই আরব্য রজনীর শেহেরজাদের কথা মনে হয়। কোথাও কি মিল ছিল তাদের দুজনের? ডায়রিতে লিখি, আজ শেহেরজান এসেছিল। এরপর থেকে তাকে এই নামেই ডেকেছি, কখনও শুধু শেহের, কখনও আবার শেহের বানু। ওই ডায়রিতে বন্দি জীবনের দিনগুলির কথা লিখতাম, ছোট ছোট করে অনেকটা সাংকেতিক ভাষায়, যাতে অনাকাঙ্খিত পাঠকের জন্য পড়াটা কঠিন হয়।
আমি জানতাম না শেহের এর গল্পগুলি সত্যি ছিল নাকি বানানো। কিংবা হয়তো সত্য আর মিথ্যায় মেশানো ছিল। কিন্তু তা বোঝার কোন উপায় ছিল না আমার। কিন্তু তাঁর গল্পবলার ধরণে সেগুলি সত্য, মিথ্যা আর অলীক কল্পনার মিশেলে এক রহস্যময় নেশা ছড়াতো যেন। আমি এক মনে তাঁর গল্প শুনে যেতাম কেবল, কোন প্রশ্ন না করেই। আমার মনে হতো, গল্প তো গল্পই, সেটা সত্যি হোক বা বানানো, আমার তাতে কি এসে যায়। আসলে শেহেরের গল্প বলার ধরণটাই ছিল অন্যরকম। ঘটনা যাই হোক না কেন, বলবার কারণে সেটা অন্যরকম একটা রূপ পেত সবসময়। গলার স্বরটা অন্যরকম শোনাতো তখন। কিভাবে যেন শ্রোতার সব মনোযোগ টেনে ধরার জাদু ছিল তার হাতে, সম্মোহিতের মতো আমি তার গল্পের অলীক সমাপ্তির পিছনে ছুটতাম। ভাবনার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে শেষেমেষ পৌঁছতাম তারই ঠিক করা ঠিকানায়। গল্পের শেষে বিমোহিত হয়ে আমি যেন শূন্যে ভাসতাম কতক্ষণ। কিছুক্ষণের জন্য হলেও জীবনের ওই কঠিন সময়টার কথা ভুলে যেতাম আমি। অনেকটা যেন ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা মুছে ফেলার মতো করে আমার সব যন্ত্রণা মুছে যেত কিছু সময়ের জন্য। সেই সময়টাতে আসলে আর বেশি চাওয়ার আর কিছু ছিল না আমার।
শেহেরের বয়স তখন ছিল পঁয়ত্রিশ প্রায়, তার মানে আমার থেকে অন্ততঃ বছর চারেকের বড়। স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলেময়ে আর স্বামী নিয়ে একটা গোছানো সংসারও ছিল। আমার ওই বন্দিখানা থেকে তাঁর বাড়ি অন্ততঃ মিনিট বিশেকের পথ, এমনটাই বলেছিল সে আমাকে। যদিও সেই বিশ মিনিটের পথটা কত দূর, সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা যেমন ছিল না, জানার কোন উপায়ও ছিল না। কালো বাহিনীর হাতে বন্দি হবার পর থেকে এই অচেনা জায়গায় গৃহবন্দি আমি। নিজের ব্যাপারে এইটুকুই মুখ খুলেছিল শেহের, আমার কাছে কিংবা এতোটুকুই বলার অনুমতি ছিল তার। এর বেশি কিছু সে বলেনি, আমিও জানতে চাইনি। সেটা সত্যি না মিথ্যা তা নিয়েও আমার আসলে কোন মাথা ব্যথা ছিল না। এমনকি তাঁর নাম নিয়েও ছিল না কোন আগ্রহ।
আর তাই আমি তাকে শেহেরজান কিংবা শেহের বানু বলেই ডাকতাম, যদিও আরব্য রজনীর হাজার রাতের সেই রানী শেহেরজাদের সাথে গড়নে কোন মিলই ছিল না। মাঝবয়েসী নারীদের মতো শরীরে মেদ জমতে শুরু করেছিল, চোখের কোলে কালি। সবসময় আজব ধরণের পোশাক পরত সে, সেগুলোকে খুব আধুনিক কিছু বলা যায় না। যদিও একেবারেই অনাকর্ষণীয় ছিল না, তবু সব মিলিয়ে খুব একটা নজরে পড়ার মতো নয়। যার ফলে রাস্তায় পথচারী কিংবা যানবাহনের সহযাত্রীরা তাকে আলাদা ভাবে খেয়াল করার কথা না। হয়তো এই কারণেই এ ধরণের একটা কাজে শেহেরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ধারণা করা যায়, বছর দশেক আগের শেহেরের ছবিটা এরকম ছিল না। অল্পবয়সী ঝলমলে শেহের হয়তো কতজনের ভাবনায় ঘুরপাক খেয়েছে। জীবনের কোন এক জটিল সমীকরণে সময়ের পর্দা ঢেকে দিয়েছে সেই অতীতটাকে।
শেহের আমার কাছে আসত সপ্তাহে দুই দিন। কিন্তু সেটা নির্দিষ্ট করা ছিল না। তবে এটা নিশ্চিত, সে কখনও ছুটির দিনে আসত না। হয়তো এই দিনটা পরিবারের সাথে কাটাতো। আমি যদিও আগে থেকে জানতে পারতাম না তার আসার সময়, তবু এটা একটা ছকে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। দরোজায় তালা খোলার শব্দ পেয়ে আমি বুঝতাম সে এসেছে। আগের দিনের বলে দেয়া দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে আসত আমার জন্য। সেগুলি রান্নাঘরে কিংবা ফ্রিজে গুছিয়ে রাখত। তারপর পরের দিনে কী কী আনতে হবে, সেগুলো একটা কাগজে লিখে নিতো। এই সময়টা খুবই পরিপাটি নিজের কাজগুলি সেরে ফেলত, বাড়তি কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইতো না।
রান্নাঘরের কাজ শেষ হলেই সোজা শোবার ঘরে চলে আসত, অনেকটা কাজেরই একটা অংশ হিসাবে। এরপর দ্রুত জামা-কাপড় খুলে নিরবে উঠে আসত বিছানায়। আমরা মিলিত হতাম, একে অন্যে বিলীন হতাম। এই সময় কোন একটা শব্দ করত না যদিও, তবু অলিখিত নিয়মের মতো করে শেহের তার সবটুকু দিয়ে ষোলআনা সুখ নিশ্চিত করতে চাইতো। যেন এমনটা করার জন্য তাকে আগে থেকে কেউ বলে দিয়েছে। এমনকি পিরিয়ড চলার সময়গুলিতেও যে দক্ষতায় সঙ্গ দিতো, তাকে আমার ভীষণ পেশাদার মনে হতো তখন।
যৌনসুখের শেষে আমরা বিছানায় শুয়ে থাকতাম কতক্ষণ। ঠিক এই সময়টাতেই সে কথা বলত, আর আমি চুপচাপ শুনে যেতাম। নানারকম প্রশ্নও করত সে তখন। ঘড়ির কাটা সাড়ে চারটায় পৌঁছলেই বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়ত শেহের। অদ্ভুতভাবে, ঠিক তখনই, যখন তার গল্পটা একটা ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে মাত্র। দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে যেত সে বাড়ি ফেরার জন্য। সদর দরোজায় বাইরে থেকে তালা লাগানোর শব্দ পেতাম।
আমি বন্ধ জানালার ধুলোয় ধুসর হয়ে যাওয়া কাঁচের এপাশ থেকে ওর চলে যাওয়া দেখতাম। তারপর বন্দিঘরে আবার নেমে আসত কবরখানার নীরবতা। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে আমি শেহেরের রেখে যাওয়া রাতের খাবার বের করে খেতাম। তারপর এককাপ কফি খেতে খেতে টিভি দেখতাম, একটা মাত্র চ্যানেল দেখা যেত সেখানে। তারপর হাতের কাছে থাকা অল্প কয়েকটি বই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যেতাম এক সময়। আসলে ওই গৃহবন্দি জীবনে এর বেশি কিছু করারও ছিল না আমার। না কথা বলার কোন মানুষ, না টেলিফোন, না কম্পিউটার, না ইন্টারনেট। এমনকি খবরের কাগজও দেয়া হতো না আমাকে। কোন কিছু বলার কিংবা না বলা কারণে, আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল ওই বাড়িটাতে, যেখান থেকে বের হবার বা পালিয়ে যাবারও কোন উপায় ছিল না আমার। জানালা দিয়ে দেখতাম কালো বাহিনীর গাড়িগুলি টহল দিচ্ছে ক্রমাগত। শেহের-এর আসাটা বন্ধ হয়ে গেলে, আমি হতাম সম্পূর্ন জনবিচ্ছিন্ন। মাঝে মাঝে আমি ভাবতাম, শেহের না আসলে কি হবে? হয়তো আমি আরো বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তাম। কিন্তু আসলে নিঃসঙ্গতাকে আমি যতটা না ভয় পেতাম, তার চেয়ে বেশি ছিল, বিছানায় শেহেরের গল্প শুনতে না পাবার শঙ্কা। আরো ঠিকঠাক বললে, অসমাপ্ত গল্পের বাকিটার তৃষ্ণা। .............
************
শেহেরজানের অসমাপ্ত গল্প
মূল: হারুকি মুরাকামি
ভাষান্তর: আসাদুল লতিফ
প্রচ্ছদ: মো. সাদিতউজজামান
চলন্তিকা প্রকাশনী
একুশে বইমেলা স্টল নং ২০৩-২০৪
মূল্য ২০০ টাকা (ছাড়ের পর)
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম