বইয়ের সাথে সখ্য ভাবটা অনেক আগে থেকেই। বই পড়ার মধ্যে অদ্ভুত এক আনন্দ বিরাজ করে। নিশ্চয়ই, ইতিমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন মহিউদ্দিন মোহাম্মদ -এর "আধুনিক গরু রচনা সমগ্র" বইটি সম্পর্কে। সেই বই সম্পর্কে দুয়েকটি কথা বলব।
বইয়ের অতলান্ত গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা আমার তেমন নেই। একটা বইয়ের প্রতিটি বাক্য ধরে বিশ্লেষণ করতে গেলে বহু কষ্ট সাধনের প্রয়োজন হয়। তার কতটা ধৈর্য্য আমার আছে তা অনুমান করতে পারছি না। বই মানুষের চিন্তাকে একটা চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে জাগ্রত করে এবং সেইসাথে বুদ্ধির বিকাশে নিজেকে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। অনেকে বই পড়াকে কষ্টসাধ্য মনে করে বইয়ের কাছে ঘেঁষতে ভয় পায়। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যখন সে একটি ভালো বইয়ের সন্ধান করে পড়তে বসবে তখন দেখা যাবে তার ভিতরের ধারণাটি একদম পাল্টে গেছে। আমাদের গড়ে ওঠার মতো জাগ্রত শক্তি ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়নি। সদা সর্বদা নানান চাপের মধ্যে দিয়ে বইয়ের প্রতি আস্থা রাখতে বলা হয়েছিল কিন্তু আমরা তা পারিনি। থাক সে কথা, বেশি কথা বাড়ানো ঠিক হবে না। এতে করে পাঠকের মনে অন্যরূপ অনূভুতি কাজ করবে।
"আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র" পড়তে গেলে আগে নিজেকে সমস্ত দিক থেকে আলাদা রাখতে হবে। যেখানে, সত্যের সাথে মিথ্যার ঘোর শত্রুতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস থাকতে হবে। বইয়ের অতলান্ত গভীরে ডুব দিয়ে তার পূর্ণ জ্ঞান আরোহণ করার চেষ্টা করতে হবে। বইয়ের নির্যাস থেকে নিজেকে বাছাই করতে হবে। লক্ষ্য ঠিক রেখে সঠিকভাবে চলার পন্থার অন্বেষণ করতে হবে।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ তাঁর বইয়ে এমন একটি প্রচ্ছদের স্থান দিয়েছে তা দেখলে সাধারণ মানুষের মনে হতে পারে এটা কোনো ভুতুড়ে ব্যাপার। সব্যসাচী মিস্ত্রী কিন্তু সে ধারণা নিয়ে প্রচ্ছদটি গড়ে তোলেননি। এটা কোন লেজওয়ালা গরুর উদাহরণ দেওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়নি; বরং সমাজের, রাষ্ট্রের বিষবাষ্প দূর করার জন্য কিছু গরু নামক দু'পায়ে মানুষের কথা বলা হয়েছে। যারা আমাদের সংস্পর্শে থেকে আমাদের প্রতিনিয়ত লাঠি মেরে যাচ্ছে তাদের নিয়েই রচিত হয়েছে "আধুনিক গরু - রচনা সমগ্র" বইটি। যেখানে সত্য-অসত্য, শিক্ষা, শিক্ষক, বাকস্বাধীনতা, আইন, জনগণ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বইটি মনের খোরাক যোগানোর জন্য যথেষ্ট কাজে আসবে।
আপনার প্রথমেই নজরে পড়বে তার উদ্দেশ্যমূলক লেখক পরিচিতি। এরকম লেখক পরিচিতি আর কোথাও পড়েননি তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি । কোন সাল তারিখের ব্যবহার নেই, নাম কিংবা জায়গার উল্লেখ নেই। শুধুই জ্ঞানগর্ভ কিছু কথার প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ...
যারা বুদ্ধিমান, তারা আগে লেখা নিয়ে ভাববে। তারপর ভাববে লেখককে নিয়ে।
কথাটা মনোযোগ সহকারে পড়লে বোঝা যায় সত্যিই তো তাই। আরও একটা মজার ঘটনা, লেখক পরিচিতির স্থানে লেখকের মায়ের ছবি স্থান পেয়েছে সত্যি তা ভাববার মতো। লেখক তার সমাধান দিয়েছেন, তিনি বলেছেন তিনি তার মাকে বড্ড বেশি ভালবাসেন কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেন না । তাই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি ছবিটি দিয়েছেন। পুরো বইটা জুড়ে আশ্চর্য সব কথা পাবেন না, এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার বলার ভঙ্গিমা সত্যিই অসাধারণ।
তিনটি অধ্যায় বা পর্ব নিয়ে বইটির সূচনা। প্রথম পর্বে একুশটি রচনা, দ্বিতীয় পর্বে দশটি রচনা এবং তৃতীয় পর্বে আঠারোটি সংজ্ঞা রয়েছে।
প্রথম পর্বের শুরুতেই আলোচনা হয়েছে বিত্তশালী ব্যক্তিদের প্রয়োজনের অধিক বস্তুকে ভুঁড়ি বলে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে। যেখানে মানুষ তাঁর স্বার্থের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দেয় যোগান দেওয়ার কাজে। এতে করে একদিকে যেমনটা ক্ষতি হচ্ছে আরেকদিকে তাঁরা হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। বইটির লেখক সুচতুর বুদ্ধির মাধ্যমে ব্যঙ্গাত্বক ভাষায় মানুষের সমস্যাগুলোর সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি সাহসের সাথে বাঙালিকে ব্যাঙের সাথে তুলনা করেছেন কারণ ব্যাঙ কারণে অকারণে অযথাই লাফালাফি করে ঠিক তেমনি বাঙালির স্বভাব ব্যাঙের মতো লাফানো। লেখক যখন দেখলেন মানুষ তাঁর মনুষ্যত্ব বিক্রি করে কিভাবে শেষে অসহায়ের মতো ক্রন্দন করে আর হাহুতাসে মরে। সেই ধারণাকে পাল্টে দেয়ার জন্য মানুষের প্রাণের স্পন্দনে সদা সত্যকে জাগ্রত করার প্রেরণা দিয়ে ভালো - মন্দ বিচার করার সক্ষমতাকে ঢ়ের, গভীরে গিয়ে আবিষ্কার করার প্রেরণা দিয়েছেন। শয়তানের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন...
শয়তান থেকে মুক্তি লাভের জন্য 'আউজু বিল্লাহি মিনাশ শাইতোয়ানির রাজিম' নামে একটি দোয়ার প্রচলন আছে। দোয়াটি মানুষ পড়বে, এরকমই নির্দেশনা ছিল। কিন্তু দেখা গেলো, শয়তানই এখন এ দোয়া বেশি বেশি পড়ছে। এতে আল্লাহ, আমার ধারণা, খুবই বিভ্রান্ত হন। কারণ শয়তানকে শয়তান থেকে মুক্ত করা সহজ কাজ নয় ( আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র, পৃ. ২৬ )।
প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি যারা ক্ষমতাহীন, তাদেরকে প্রভাবশালীরা গ্রাস করে আসছে এর ধারাবাহিকতা এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়ার পন্থা খুঁজতে কেউ আগ্রহী নই। সত্য-মিথ্যার তফাৎ বোঝার ক্ষমতা সবার আছে কিন্তু নিশ্চুপ হয়ে অভিনয় দেখার যে ধৈর্য্য, তা দেখে আর অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। আমরা যখন প্রান্তিক পর্যায়ে এসে যাই, যখন আমাদের কেউই দাম দেয় না তখন আইন, রাষ্ট্র কিছুই আর আমাদের থাকে না। বাকস্বাধীনতা বলে যে কিছু আছে তা সাধারণদের ধারণার অতীত কারণ যেখানে জোর - জুলুম মিথ্যার সংসার, সেখানে সাধারণদের সবসময় হীনমন্যতায় ভুগতে হয়। সমাজের অন্ধকার দূর করার দ্বায়িত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত, তারাই আজ গরু সেজে আমাদের গরু বানাচ্ছেন।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ স্পষ্ট যুক্তি দিয়ে সেসব জঞ্জাল থেকে দূরে থাকার যে প্রক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা আর বলার অবকাশ রাখি না। তিনি একটি জায়গায় বলেছেন...
পৃথিবীতে যে-কম্পিউটার গেমগুলো আছে, তার অধিকাংশই যুদ্ধ ও খুনোখুনির গেম। গেমগুলো শিশু ও কিশোরদের কাছে এতো জনপ্রিয় কেন? এর কারণ সম্ভবত তাদের জিনে লুকিয়ে থাকা খুনি-প্রবৃত্তি ( আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র, পৃ. ৬৩ )।
আমরা শিশুদের এমন করে গড়ে তুলছি যেখানে মোবাইল কিংবা কম্পিউটার হয়ে উঠেছে জীবনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। দেখা যাচ্ছে শিশু জন্মের পর থেকেই মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে শিখাচ্ছি কীভাবে এর সার্বভৌমত্ব প্রকাশ পায়। আর একসময় সেটিই হয়ে উঠেছে জীবনের ঘোরতর শত্রু। নির্বাসিত লেখকদের সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, লেখার জবাব লেখা দিয়েই হওয়া উচিৎ। যে যতোই খারাপ লিখুক না কেন প্রতিটি শব্দের জবাব লেখা দিয়েই হোক। যিনি এই মন্তব্যের বিরোধী তাকে তিনি গোঁড়া বলে অভিহিত করেছেন। এই গোঁড়ারা সমাজে বিষবাষ্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়।
শিক্ষাকে তিনি এমনভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যেখানে কিছু কিছু দেশের শিক্ষা দেশপ্রেমের নাম করে শিশুমস্তিষ্কে খুনোখুনি কথা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মনের প্রবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে। শিক্ষাক্রম তারা এমনভাবে সাজাচ্ছেন যাতে করে তাদের স্বার্থ হাসিল হয়। শিক্ষার মান উজ্জ্বল করার নামে নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে এসে শিশুকে তারা উঁচুতে উঠা থেকে বারবার বিরত থাকতে বলেন। সাধারণ লোকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন ...
কেউ কেউ শিক্ষালাভ করাকে মনে করছেন সামাজিক মর্যাদা লাভের হাতিয়ার। এটি একটি পাগলাটে ভাবনা ও কুসংস্কার। এ ভাবনা যাদের আছে, তাদের চিকিৎসা জরুরী; যদিও এ রোগের চিকিৎসা জানেন এরকম ডাক্তার বাংলাদেশে আছেন বলে মনে হয় না। এ জন্য নিজের চিকিৎসার উদ্যোগ নিজেকেই নিতে হবে। নিজেকেই চাকু চালাতে হবে নিজের টিউমারের গায়ে (আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র , পৃ-১৫৫ )।
কোথাও গেলে মানুষের ক্ষমতার ওজন না করে কেউ থাকতে পারে না। কীভাবে তাকে দাবিয়ে রাখা যাবে তার চেষ্টা সর্বত্রই চলে আসছে। লেখক বলেছেন...
আপনি কি করেন? এ কথাটা জিজ্ঞেস করা মানে লোকটির উদ্দেশ্য ঠিক নয়। এতে করে ক্ষমতার মাপ নেয়া হয়।
এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে থাকে। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ বইয়ের শেষের দিকে এসে জিপিএ ফাইভকে জুতোর ফ্যাক্টরির সাথে এবং পিএইচডি ডিগ্রিকে ছাগলের সাথে তুলনা করেছেন। তার উপযুক্ত জবাব উল্লেখ করে সাধারণ চিন্তা-ভাবনাকে নাড়িয়ে দিয়েছেন। হঠাৎ করেই কথাটা শুনলে কথাটা হাস্যকর ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু যখন কথাটি মনোযোগ সহকারে ভেবে দেখবেন তখন বুঝতে পারবেন এর গভীরতা। তিনি উল্লেখ করে বলেছেন...
LOVE OF WISDOM বা জ্ঞানের প্রতি মোহ। অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, ও পদ-পদবি নয়, যে-ব্যাক্তির জ্ঞানের প্রতি মোহ জন্মেছে, সে-ব্যাক্তিই পিএইচডি! কিন্তু আমি দেখেছি, ছাগলেরাও ইদানিং দলবেঁধে পিএইচডি নিচ্ছে।
প্রতিটি কথা তিনি স্পষ্টভাষায় বলার চেষ্টা করেছেন। তিনি স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সার্টিফিকেট অর্জন করাকে মহাজ্ঞানী বা বুদ্ধিমান মনে করেনি বরং সেসব ডিগ্রিকে প্রতিযোগিতা মূলক সার্টিফিকেট মনে করেছেন। সেটাই একমাত্র জ্ঞান নয়, এর বাইরে একাডেমিক জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। তিনি বলেছেন, স্কুল-কলেজের বা বিশ্ববিদ্যালয় না পড়েও একজন মানুষ মহাজ্ঞানী হতে পারে। তবে এই ডিগ্রিকে তিনি ফেলে দিতে চাননি বরং জীবনের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই নিতে বলছেন।
ধর্ষণের সাথে পোশাকের সম্পর্ক আছে কিনা তার ব্যাখা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন...
'অশ্লীল' ভিডিও বা 'অশালীন পোশাক ' আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই সমাজে ধর্ষণ আছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়েও ধর্ষণ ছিল। ধর্ষণ তখনই ঘটে, যখন অবদমিত কাম বা শখ বা প্রতিহিংসার সাথে, ক্ষমতার হিসেবটি ধর্ষকের অনুকূলে থাকে।
তিনি এখানে ধর্ষণ ও ধর্ষককে ক্ষমতার সাথে তুলনা করেছেন। যখন কেউ ধর্ষিত হয়, পুরুষ কিংবা নারী, তখন ধর্ষক তার ক্ষমতার মাপজোক নিয়ে তবেই ধর্ষণ করেন। তিনি নানা সূত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ধর্ষণের জন্য শুধু পোশাক দায়ী নয়। যদি পোশাক দায়ী হতো তাহলে, নাইজেরিয়ার কোমা সম্প্রদায় পোশাকহীন হয়েও কেন ধর্ষণ নেই, এই কথাটি তিনি টেনে এনেছেন। তিনি মানুষের কাম, ক্ষমতা ও প্রতিহিংসাকে এর জন্য দায়ী করেছেন।
শেষ পর্বে গিয়ে তিনি এমন আঠারোটি সংজ্ঞা স্বল্প কথায় তুলে ধরে মানুষের চিন্তাকে আরেকটু গভীরে যাওয়ার প্রেরণা দিয়ে শেষ করেছেন। যেখানে মানুষের সমস্যাগুলোর সমাধান ও রাষ্ট্র সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে ধারণা দেওয়ার যথাযথ চেষ্টা করেছেন।
**********
আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
প্রচ্ছদ : সব্যসাচী মিস্ত্রী
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২২
প্রকাশক: জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
৩৮/২-ক, বাংলাবাজার, ঢাকা -১১০০
মূল্য : ৪০০ টাকা
ISBN : 978-984-9648-88-8
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম