কবি সোহেল হাসান গালিব- এর 'দরজায় আইভিলতা' কাব্যের সংক্ষিপ্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া - সাইফুল ইসলাম

কবি সোহেল হাসান গালিব- এর 'দরজায় আইভিলতা' কাব্যের সংক্ষিপ্ত পাঠপ্রতিক্রিয়া - সাইফুল ইসলাম

আমি মাঝেমধ্যে কোনও বই পড়া শুরু করার আগে চিন্তা করে থাকি বইটিতে কী কী বিষয় থাকতে পারে। প্রাচীন সাহিত্য ও চিন্তাচর্চা থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত আমার যা মাথায় আছে তা থেকেই বইয়ের বিষয় ও আশয় অনুমান করি। এতে করে পড়ার মনোযোগ যেমন কিছুটা বাড়ে তেমনি আমার পূর্ব-চিন্তার সাথে মিলিয়ে নিতেও সহজ হয়। এই বিষয়টা হয়ত অধিকাংশ  আগ্রহী পাঠকের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। বিশেষ করে সাহিত্য পড়তে গেলে আগেকার সাহিত্যের সাথে মিল ও অমিল খোঁজার পাশাপাশি বয়ানের পরিধি ও বর্ণনার ঢঙের নতুনত্বেরও খোঁজ নিতে হয়।

সংযোগের সন্দিগ্ধ মন্ত্র অথবা কী লাভ সমগ্রসত্তায় লীন অথবা বিলীন হওয়ায়?
সোহেল হাসান গালিবের 'দরজায় আইভিলতা' পড়তে গিয়ে দেখলাম রবীন্দ্রনাথের কবিতার বিষয় ও আশয় ভাবনার প্রভাব নেই বললেই চলে। বিশ শতকের ত্রিশের পঞ্চপাণ্ডব সচেতনভাবে রবীন্দ্র-ঢঙ এড়িয়েছেন। এখন তো চলছে একুশ শতকের বিশের দশক। সময়ের সাথে সাথে মানুষের ভাষা, জীবনের যাপন পাল্টানোর পাশাপাশি পাল্টেছে কবিতার রসায়নও। রবীন্দ্রনাথকে অতি সচেতনে খানিকটা এড়ানো গেলেও বাংলা কবিতায় এখন পর্যন্ত জীবনানন্দীয় ঘোর কাটিয়ে উঠা অনেক কবিদের জন্যই কঠিন। এ-সময়ে একজন কবি কবিতা লিখবেন আর তিনি 'কোনও এক বোধ' অথবা 'বিপন্ন বিষ্ময়' দ্বারা তাড়িত হবেন না এটা ভাবা খুব একটা সহজ নয়। যদিও বোধের বিস্তাররীতিতে জীবনানন্দীয় কৌশল ও প্রেম আর রাজনৈতিক বক্তৃতার বহুমুখী ধারাভাষ্যের ষাটের দশককে অতিক্রম করতে বর্তমান কবিদেরকে অনেক সজাগ থাকতে হয়। তা না হলে পুনরাবৃত্তি নির্ঘাৎ। আবার অনেকে পুনরাবৃত্তি এড়াতে তৈরি করেন অকারণ বিশেষণ, চিত্রকল্প ও জনগণমন-বিচ্ছিন্ন দুর্বোধ্যতা।  

কবি গালিব মোটামুটি ভালো করেই উতরাতে পেরেছেন জীবনবাবু ও ষাট-সত্তুরীয় ঘোর। এর প্রমাণও আছে 'দরজায় আইভিলতা' কাব্যে।

গ্রন্থটি আদ্যন্ত পড়লে দেখতে পাওয়া যায় চব্বিশ ঘণ্টার যান্ত্রিক ও নাগরিক জীবনের একটি দিনের সকাল, দুপুর, গোধূলি ও রাত্রির নানা মুহূর্তের অযান্ত্রিক ও শৈল্পিক বিস্তার। বইটি পড়তে পড়তে মনে হয় একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের  সামগ্রিক জীবনানুভূতিকে একটি ঘর, ঘরের মানুষ, ঘরের অন্যান্য প্রাণি, আসবাব ও একটি দিনে ঘরের বাইরের মানুষ, মানুষের কাজ, বহনের যান ও জীবনবিস্তারি প্রকৃতির সাথে সংযোগস্থাপনের নানামুখী তৎপরতার দ্বান্দ্বিক উপস্থাপন এই কাব্যে ঘটেছে আলাপের ঢঙে।

হ্যা আমি আলাপই বলছি। কবিতার এই আলাপি ঢঙ শুনতে শুনতে মনে হয় কবি নিজের বোধ ও বিবেচনা নিজেকেই শোনাচ্ছেন  অথবা তার পাশে একজন সুহৃদকে বসিয়ে নিজের আনন্দ ও দ্বন্দ্বময় কথাগুলো শুনিয়ে চলেছেন। তবে কবিকে শুধু  'ভোরের পাখি' বলা যাবে না। এই গ্রন্থে তিনি সারাদিনেরই এক ভৌতিক পাখি।

সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহৃত শব্দগুলো থেকেই কবি শব্দ বেছে নিয়েছেন কিছু ব্যতিক্রম বাদে। কিন্তু অতি ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দকেই শব্দের বহুলব্যবহৃত অর্থ থেকে মুক্তি দিয়ে কবিতায় জায়গা দিয়েছেন নতুন ভাবে। এ কাজে কবি সজাগ ও দক্ষ।

কাব্যটিতে একটি দিনের ধারাবাহিকতা আছে। শুরুতেই সকালের কথা- প্রথম কয়েকটি কবিতায় সকালের আবহ আছে। তারপর বিস্তার ঘটেছে দুপুর, গোধূলি ও রাত্রির।

প্রথাগত গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে যেমন ঘটনার ধারাবাহিকতা থাকে তেমনি এই বইয়ের একটা কবিতার সাথে আরেকটা কবিতারও আছে। যেমন- 'অহনা', 'ফিসফিস', ও 'অনাসৃষ্টি'কবিতায় আছে রাত, ঘুম ও অবদমিত কামনার কথা, তারপর 'অনুতাপ' কবিতায় চুমু বিষয়ক জটিলতার প্রসঙ্গ, ঠিক এর পরের 'সাদাকালো' কবিতার শুরুতেই সদ্য খুলে রাখা সাদা বা কালো রঙের ব্রা-বিষয়ক হালকা আলাপ শুরু করে পরের পর্বে কবি চলে যান সাদা-কালো রঙ থেকে চলে যাওয়া মূর্ত ও বিমূর্ত জীবনের নানা সংস্কারি-সঙ্কটের রূপ দিতে।

এই কাব্যের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হবে প্রকৃতির নানা উপাদানের আন্তঃযোগাযোগ সক্ষমতা বা অক্ষমতার প্রতি কবির সংশয়ের কথা। এই সংশয় স্বঘোষিত অতীশ বা মহাস্থবির সাধক ছাড়া দুনিয়ার বহু-মানুষেরই থাকে। যেমন 'সরলাঙ্ক' কবিতায়-

পাখিরা কি গান গায়? সে কথা তারাই ভালো জানে


অথবা

যেমন পৃথিবী জানে, সেই একমাত্র ভূমিহীনা।


রডোডেনড্রন কবিতায়-

ফুলের মাতৃভাষা আজও
জানে না কি ফুল?
বোঝে,
কেন রাষ্ট্রভাষা নিয়ে
এত হুলস্থুল?
আবার 'চুমু' কবিতায়-
পাখিরা কি চুমু খায়
এত সরু, কঠিন চঞ্চুতে!
তাদেরও কি সাধ হয়
পালকে আড়াল মন ছুঁতে?
'এমন বৃষ্টির দিনে' কবিতায়-
পাথর কি জানে, বোবা মানে ভাষাহীন নয়!
'গোধূলির ক্লাস' কবিতায়-
তার ঘ্রাণ
কোন ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি-
নারকেলবিথি আজও
কিছু কী জানে?


এমন বহুতর প্রশ্ন এই গ্রন্থে। কবিতা পড়লে বুঝা যায় কবি হয়ত পুরোমাত্রায় যোগী নন, বর্তমান পুঁজিবাদী বাসনকোসনের ঝনঝনে আর বহুবহু অপশনের সমাজে মানুষের জন্য কঠিন প্রকৃতি ও নিজেকে গাও লাগিয়ে অনুভবের। কিন্তু কবি হয়ত জানেন সংযোগের সন্দিগ্ধ মন্ত্র অথবা কী লাভ সমগ্রসত্তায় লীন অথবা বিলীন হওয়ায়? এই দ্বিধার রেশ কাব্যজুড়েই আছে। আছে টুকটাক আলাপি সিদ্ধান্তও-

যেমন 'কাকতালীয়' কবিতায়-

অনেক কিছু না বুঝেই আমরা তবু বেঁচে আছি।


এইসব সংশয় ও দ্বিধা জীবনানন্দের - "তুমি তা জাননা কিছুই, না জানিলে, আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে" পঙক্তিটির কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। এরকম 'তুমি'র ধরন, বরণ ও ছাড়ন কাব্যজুড়ে বারবারই আছে।

বলতে গেলে মেলা কথা বলা যায়। এখানে আর বেশি বলবো না। তবে সাংসারিক বা আড্ডার আলাপের অনেক শব্দ পরপর অথবা কয়েকটি শব্দের পর যুক্ত হয়ে আলাপকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আমি পঙক্তির উদাহরণ না দিয়ে শুধু মিল খাওয়া কিছু শব্দের কথা বলছি। তবে শব্দের এই মিল, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'ইত্যাদি'র উপস্থাপক হানিফ সংকেতের মতো যান্ত্রিক না, শব্দগুলোর সন্নিবেশ 'আইভিলতা'র মতো মায়াবী। শব্দগুলোর তাল দেখতে দেখতে মনে হয় 'আইভিলতা' তার লতা সত্তা থেকে বেরিয়ে ডাগর এক চোখ নিয়ে তার মানবীয় ডালপালা মেলতে শুরু করেছে নগরের দেয়ালে যেমন তেমনি মানুষের খেয়াল ও বেখেয়ালেও।

যেমন- কিনা, ভূমিহীনা, ধাই, কামড়াই, ফুল, হুলুস্থুল, ঠাসা, বাসা, নুয়ে, ফুঁয়ে, ডাম্প, পাম্প।

অলকে অলকনন্দা
পলকে ঝলক দিয়ে
কোথায় লুকালে তুমি
পাতার আড়ালে গিয়ে।


উপরের লাইনগুলো 'অলকানন্দা' কবিতার। কবিতাটি পড়ার সময় আমার সত্যন্দ্রনাথ দত্তের 'ঝর্ণা' কবিতাটির কথা মনে হয়েছে। সে মনে হতেই পারে।

মনে যাই হোক- 'দরজায় আইভিলতা' কাব্যের প্রতিটি কবিতাই আমি যখন পড়েছি তখন আমার ভালো লেগেছে। তবে আমি থ হয়ে যাই নি, মুগ্ধ হয়েও অবশ হই নি- যদি 'ধসে'র কথা বারবার আছে নানান কবিতায়। আমার যেমন থ হয়ে যাওয়া ও মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা অনেক বহুব্যবহৃত ব্যাপার ও বিষয়ে অনেক কমে গিয়েছে তেমনি কবিও হয়ত কাওকে অতি বিষ্ময়ী করতে চান না। সময়টা 'বিদ্রোহী' কবিতার যুগের মতো ঘোর, বিস্ময় ও তাক-লাগানোর নয়। এখন অধিকাংশ পুরুষেরা কেবল মুগ্ধ হয় পর্দার পর্নে, নারীরা স্বর্ণের আর হিরের অলঙ্কারে ও পোশাকে আর নারী-পুরুষ উভয়ের অনেকেই মুগ্ধ কেবল ওয়াজ, তোয়াজ, টাকা, জমি ও ফ্ল্যাটে। কলা ও নান্দনিকতার পাঠ ও তার অনুভবের সবচেয়ে আকাল যাচ্ছে এই গুগোলিয় কালে।

এই যখন অবস্থা তখন হয়ত কিছু বিপন্ন-বিস্ময়ে আক্রান্ত কবি পড়বেন 'দরজায় আইভিলতা'র গালিবকে। অন্যদের পড়া ও অনুভবের মতোন মাল-মশলা এই গ্রন্থসহ একুশ শতকের নিরানব্বই ভাগ কাব্যগ্রন্থেই নেই। তবে স্কুলের বইয়ে পাঠ্য হলে হয়ত গাইড বই থেকে পাওয়া যাবে 'দরজায় আইভিলতা' কাব্য বিষয়ক ব্যবচ্ছেদ ও উদ্দীপকীয় সৃজনশীলতা। এছাড়া এ-কাব্যের উদ্দীপন-ক্ষমতা খুবই কম।

অবশ্য যথার্থ শিল্পের শুধুই উদ্দীপনা তৈরির ঠেকা পড়ে নি। একুশ শতকের বাংলা কবিতার বড় অংশ শুধুই 'শিল্পের জন্যই শিল্প' ধারণা মাথায় রেখে লিখিত- 'দরজায় আইভি লতা'ও যুক্ত হলো জনবিচ্ছিন্ন শিল্পের সেই ঘরনায়।

**********
দরজায় আইভিলতা
সোহেল হাসান গালিব

প্রকাশক- ঐতিহ্য
প্রচ্ছদ- ধ্রুব এষ

প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০২৩
পৃষ্ঠা - ৬৪
মূল্য- ১৮০
ISBN: 9789847769905

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ