লেখক পরিচিতি:
পূর্বাশ্রমের নাম নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় পরে সন্ন্যাস জীবনে তার নাম হয়, শ্রীমৎ স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী পরমহংসদেব। তিনি পিতা- ভুবনমোহন চট্টপাধ্যায় ও মাতা- মানিক সুন্দরীর ঘর আলো করে ১৮ আগস্ট, ১৮৮০ সালে নদীয়া জেলার তখনকার সাবডিভিশন কুতুবপুর নামক ছোট গ্রামে (বর্তমান বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলায়) এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুর নামেও পরিচিত। চৈতন্য মহাপ্রভুও এই একই জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নিগমানন্দ ছিলেন ভারতের একজন সদগুরু ও সাধু। তিনি ছিলেন পূর্ব ভারতে সুপরিচিত একজন হিন্দু যোগী ও আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি লেখক ও একজন হিন্দু দার্শনিকও ছিলেন এবং তন্ত্র ও যোগের একজন উৎকৃষ্ট আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে তাকে দেখা হতো। তিনি সে সময় ‘আর্য দর্পণ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা এখনও চলমান। তাঁর রচিত গ্রন্থ : তরণীসেন বধ , সুধাংশুবালা, চারুবালা, মর্মগাঁথা, জ্ঞানীগুরু, যোগীগুরু, তান্ত্রিকগুরু, প্রেমিকগুরু, ব্রহ্মচর্য সাধন, বেদান্ত বিবেক ইত্যাদি।
নিগমানন্দ তার জীবনের শেষ চৌদ্দ বছর উড়িষ্যার পুরীতে অতিবাহিত করেন। তিনি ১৯৩৫ সালের ২৯শে নভেম্বর কলকাতায় দেহ রক্ষা করেন।
মূল প্রসঙ্গ:
নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের বয়স যখন সবেমাত্র উনিশ তখন তিনি বাংলা ১৩০৬ সালে ‘সুধাংশুবালা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত করেন। তিনি বলেছেন "আমার বয়স এই পুস্তকের পরিচ্ছেদের সমান।" পরিচ্ছদ আছে ঊনিশটি তাই ধরে নেওয়া যায় তার বয়স উনিশ বছর। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে কাব্যকথার মধ্যে দিয়ে। সুধাংশুবালা ও কমল চরিত্রের অপূর্ব প্রেমের আখ্যান ফুটে উঠেছে। যেখানে লেখক তাঁর কল্পনা শক্তির প্রয়োগ করে, নিজের জীবনের কিছু কাহিনীকে টেনে এনে অতিমাত্রায় কল্পনার জগতে লেখক সত্ত্বাকে বহুমাত্রিক রূপে প্রকাশিত করেছেন। প্রেমের জন্য যে, প্রেমিক ও প্রেমিকার হৃদয় কতটা আবেগে আপ্লুত হয়, তা এই উপন্যাসটি উপস্থাপন করছেন। লেখক স্বীকার করেন, তিনি এই ভাব মুখে বলে বা লিখে প্রকাশ করতে অক্ষম, তবুও তিনি প্রেমের ভিতকে একটা মাত্রায় এনে অব্যক্ত কথার স্পন্দন পাঠক সমাজে প্রকাশ করেছেন। তিনি উপন্যাসটিতে শুধু প্রেমিক ও প্রেমিকার প্রণয়ের অনুভূতি কথায় বলেননি। সমাজের গোঁড়া এবং কালকুট বিষবাষ্প দূর করার জন্য সাহসের সাথে স্পষ্টবাদী কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। আজ থেকে ১২৫ বছর আগে একদম নবীন বয়সে এসব কথা লিখে গিয়েছেন , ভাবতে অবাক লাগে, যখন একটা উপন্যাস ১২৫ বছর পর এসেও কিছু মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়। অন্ধকার থেকে আলোর পথ প্রদর্শন করে। দেখা যাচ্ছে তিনি, পাঁঠাবলি প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, তথাকথিত বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, সমাজতন্ত্র থেকে দূরে গিয়ে গণিকার প্রেমের উপাখ্যান উপস্থাপন করছেন, ভালোবাসাকে একটা পবিত্র রেখায় আবদ্ধ করেছেন, যেখানে স্বপ্নের সাথে বাস্তবের আবাস। সমাজের উঁচু-নিচু এই ভাবকে দূর করে মানুষের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দিতে বলেছেন। তিনি ঘোষণা করলেন... “আমরা নীচ, তোমরা উচ্চ, তা স্বীকার করি। কিন্তু এই পৃথিবীতে যে সকল বস্তুতেই ইশ্বরের ঘনীভূত অস্তিত্ব দেখে, সে কাহারও ঘৃণা করতে পারে না।” মানুষের মতো মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। যে সমাজ কঠোর এবং স্বার্থান্বেষী, সে সমাজে মানবতার ভাবকে বিসর্জন দিতে হয়। কিন্তু যদি আমরা এই লুব্ধ সমাজ থেকে বের হয়ে বিশ্বকে দেখার চেষ্টা না করি তবে মানব জীবনের সফলতা কোথায়?
তিনি সতী এবং অসতীর পরিণাম তুলে ধরে শিক্ষা দিলেন। সত্য আর অসত্যের ঘোর পরিণাম সম্পর্কে পথ দেখালেন। ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রশংসা করলেন এবং শেষে শ্মশানের মতো চিরশান্তির স্থান নির্ধারণ করে, সব যন্ত্রণার লাঘব টেনে উপন্যাসের পরিধি এবং জীবনের জয়গান সেই ভষ্মের মধ্যে লীন করে দিলেন। ‘সুধাংশুবালা’ উপন্যাস হৃদয়ের মধ্যে একটা তুফান তুলে ভেঙে চুরমার করে, নতুন এক জগতের আবিষ্কার করে। যেখানে ভালোবাসার পরশমণি জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে!
লেখক মহাশয় পাঠক ও পাঠিকার উদ্দেশ্যে শেষে কয়েকটা কথা বলছেন পুরোটা তুলে না ধরে পারলাম না...
“পাঠকগণ! এতক্ষণ আপনাদের জ্বালাতন করিয়া, এইবার বিদায় গ্রহণ করিলেম। ‘পাঠক’ ‘পাঠক’ করে আপনাদের কান ঝালাপালা করিয়াছি, এখন শয়ন করিয়া আপন আপন প্রণয়িনীর সহিত আমার “বাতুলতা" আন্দোলন করুন, তাহা হইলেই সকল পরিশ্রম সার্থক হইবে।”
“ পাঠিকাগণ! আপনারাও আঙ্গুল মটকে দুই একটি তাম্বুল সুবাসিত গালিকা _পুষ্প প্রদান করুন, আমি বহুমানে মস্তক অবনত করিয়া গ্রহন করিব। আপনাদের পবিত্র মুখে এই পাপাত্মার নাম উচ্চারিত হইবে, ইহা অপেক্ষা আমার সৌভাগ্যের বিষয় কি আছে? বাস্তবিক বলছি নারীর গালাগালি অনেকদিন শুনি নাই।”
⭐ “আমার কথাটি ফুরালো নটে গাছটি মুড়াল।” ⭐
মতামত:
উপন্যাসটিতে কিছু কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বারবার বলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি। মনে হয়েছিল লেখক যখন বিকাশের জায়গাটি ঠিকমতো গড়ে তুলতে গিয়ে হতভম্ব হয়েছিলেন ঠিক সেই সময়টা করে এরকম হয়েছে। তবে পুরোটা উপন্যাস জুড়ে এরকম ছিল না। বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রয়োজনের অধিক বলা হয়েছে। তবে লেখকের নবীন কমল হাতের এই সৃষ্টি পাঠক সমাজে যে ভিন্ন একটি মাত্রা যোগ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার লেখায় সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ছাপ পাওয়া যায়। যাবেই না বা কেন, আত্মিয়তার সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে থেকেই তাঁর সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা। সেই সময় বইটি জাতীয় গ্রন্থাগারে স্থান পায়। বাংলা ১৩০৫ সালে উপন্যাসটি রচনা করেন। সাহিত্য সম্রাট কয়েক বছর আগে গত হয়েছেন। সেই সময়ে নবীন লেখক নিজেকে লেখার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করার সূত্র রচনা করেন। আর আমাদের পাঠক সমাজে সাহিত্যের ঢেউ তুলে যান।
**********
গ্রন্থ: সুধাংশুবালা
লেখক: নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ: ১৩০৬ বাংলা
দ্বিতীয় মুদ্রণ : ১৩৯২ বাংলা
তৃতীয় মুদ্রণ : ১৪২৩ বাংলা
প্রকাশক: শ্রীমৎ স্বামী দিব্যানন্দ সরস্বতী, আসাম বঙ্গীয় সারস্বত মঠ, কোকিলামুখ, যোরহাট, আসাম ।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম