বইটি পাঠকালে, লেখকের এক বিশেষ বিবৃতি আমার মনে বেশ দাগ কেটেছে সেটা তুলে ধরে লেখককে ঘিরে আমার ক্ষুদ্রানুভূতি প্রকাশ করে শুরু করি...
ভালোবাসা যেন মানুষের কেমন এক অচিন আবেগ আর এক বড়ই অদ্ভুত অনুভূতি বিচিত্র এর গতি আর বহুধা এর মাত্রা।
এই বইয়ের লেখকের প্রতি আমার ভালবাসা তার দেয়া এই বিবৃতির মতোই। তিনি আমার পিতৃতুল্য। তার সাথে আমার জাগতিক সম্পর্কের যোগ হয়ত নেই তবে আত্মিক যোগটা বেজায় তীক্ষ্ণ। এই তীক্ষ্ণতা আরো শাণিত হয়েছে তার এই বইটি পড়ার মধ্যে দিয়ে। তাঁকে ভীষণ আপনার করে উপলব্ধি করেছি তাঁর লেখা প্রতিটি লাইন পাঠ করার সময়। তার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুক নামক এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেই। ফেসবুকে প্রথমবারের মতো তার লেখা "মানুষের ধর্ম" প্রবন্ধটি পাঠ করে আমি তার লেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাই। এরপর ধীরে ধীরে তার বিভিন্ন লেখা, প্রবন্ধ, আর কবিতা পড়ে রীতিমতো তাঁর ভক্ত বনে যাই। বিশেষত তার কবিতা পাঠ করতে করতে মনের অজান্তেই তার সাথে আমার প্রাণের এক নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সম্পর্ক একান্তই একজন লেখক/ কবির সাথে তার পাঠকের। তার লেখার যে বিশেষ দিকটি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আকৃষ্ট করেছিল তা হলো বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনার মাধ্যমে সহজ সাবলীল এবং নমনীয় ভাবে কুসংস্কার দূরীকরণের প্রচেষ্টা।
'উল্টো রথে উৎসে ফেরা' বইটিতে তিনি মূলত নিজের জীবন ও জীবনের নানান অভিজ্ঞতার আলোকে বিজ্ঞান, ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, জন্মভূমি ছেড়ে তার প্রবাসজীবন, দেশপ্রেম, ভ্রমণকাহিনীসহ, স্মৃতিকথা সম্বন্ধে লিখেছেন। লেখার প্রতিটি পাঠ থেকে তিনি একটি বিশেষ মেসেজ পাঠককে দিয়েছেন। যার ভিত্তিতে বলা যেতেই পারে এই বইটি একটি সামাজিক এবং আত্ম সচেতনতা মূলক বই।
বই আত্মশুদ্ধির একটি অনন্য উপাদান। অবশ্যই 'সু' বই। যেকোনো 'সু' বই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে আমাদের ভেতরের জ্ঞান প্রদীপ কে প্রজ্জ্বলিত করে এর আলোকময় শিখা দ্বারা। নিজেকে প্রতিনিয়ত সুবিকশিত করতে, আত্ম সত্ত্বাকে পরিশুদ্ধ করতে বই আমাদের একান্ত আদর্শ অনুষঙ্গ। পাঠশেষে আমার অর্জিত স্বল্প জ্ঞান বিবেচনায় "উল্টো রথে উৎসে ফেরা" বইটি সেরকম ই একটি 'সু'বই। এই বইয়ের মধ্যে থাকা ছোটগল্প, স্মৃতিকথন, প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার উপাদান। ভীষণ ব্যক্তিগতভাবে এই বইটি আমার আত্মাকে পরিতৃপ্ত ও পরিশুদ্ধ করেছে বিভিন্নভাবে। আমার মধ্যে সঞ্চার করেছে সুচেতনার। সেই ভালো লাগা, সেই সুচেতনাবোধ আরও অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার তাগিদ থেকেই আমি ছোট করে বইটির আলোচনা করবার প্রয়োজন বোধ করছি।
শুরুতেই লেখক 'ছিন্নস্মৃতি' নামক শিরোনামে চিত্রায়ণ করেছেন মেঘনার কূল ঘেঁষে অবস্থানরত তার প্রাণের অতি প্রিয় চাতলপাড় গ্রামকে। এই গ্রামকে ঘিরে তার শৈশবের মধুর স্মৃতি। বাল্যকালের সেইসব খেলার সাথীদের সাথে খেলাধুলা, আড্ডা, খুনসুটি এত সুন্দরভাবে চিত্রায়ণ করেছেন যা প্রত্যেককে তাদের শৈশবের স্মৃতির আনন্দধারায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সেইসাথে বন্ধু বিয়োগের বেদনায় ভারাক্রান্ত করবে।
মাতৃস্মরণে লেখা 'জয়তু জননী' তে আমরা পাব মাতার প্রতি এক পুত্রের অনাবিল অনুভূতি। মাকে হারিয়ে পাগলপ্রায় এক পুত্রের হাহাকার! মাকে আরেকবার কাছে পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সত্যি বলতে এই পাঠটি পাঠকালে মনের অজান্তেই আমার চোখ সজল হয়ে উঠেছিল। যতদিন বেঁচে থাকব মাতার প্রতি পুত্রের অপার ভালোবাসার এই নৈবেদ্যটি স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
এই বইয়ের অতি আকর্ষণীয় কিছু পাঠের মধ্যে একটি হলো 'আমি ভালোবাসি যারে'। এই ছোট্ট গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের আড়ালে থাকা এক গভীর বেদনার আখ্যান । এই গল্পটি একটি হৃদয়স্পর্শী প্রেমকাহিনীর কথা বলে। যে প্রেম পূর্ণতা পায় না ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কারণে। এই গল্পের প্রধান চরিত্র অরিন্দম রায়চৌধুরী ও নন্দিনী। ১৯৪৭ সালের দিকের দুই কিশোর-কিশোরী বেড়ে উঠছিল সুবর্ণগ্রাম নামক একটি গ্রামে, তখন তারা বুঝতোই না দেশ বিভাগ বা এর পরিণতি সম্পর্কে। তারা আপন আবেগ অনুভূতিতে খুনসুটিতে বড় হচ্ছিল। বড় হতে হতে তারা হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। একে অপরকে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকার; একসাথে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি এই দুই আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ বন্ধুকে আলাদা করে। কৃত্রিম দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অবিবেচক, অপরিণামদর্শী আর অমানবিক নিষ্ঠুর দেশ বিভাগ যে অরিন্দম নন্দিনীর কাহিনীর মতো এমন অসংখ্য বিরহ বেদনার কাহিনীর জন্ম দিয়েছিল মূলত লেখক অরিন্দম-নন্দিনীর গল্পের মাধ্যমে তা সুনিপুণ ও শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন। এখানে বলা বাহুল্য, উক্ত গল্পে লেখকের প্রেম উপস্থাপনের ভাষা, শব্দশৈলী যেকোনো প্রেমময় হৃদয়কে সম্মোহিত করবে।
'তবু অনন্ত জাগে' ছোটগল্পটি এরকমই আরেকটি হৃদয়স্পর্শী প্রেমকাহিনী। এই প্রেমকাহিনীর অন্তরালে লুকিয়ে আছে আমাদের ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন চরম বর্বরতা আর নির্মমতা সেই সাথে দেশপ্রেমের ইতিহাস। এই গল্পটি মূলত একখানা চিঠি; মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর সেই সময়ের স্মৃতি চারণ করে মুক্তিযোদ্ধা অর্ঘ্য যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া তার প্রেমিকা বাঁধনকে লেখা চিঠি। মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর সেই সময়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে যুদ্ধে গিয়ে দীর্ঘদিন পর দেশমাতৃকাকে জয় করে যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে দেখে তার জননীকে হারিয়ে ফেলেছে সে। ধীরে ধীরে সে এও আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় তার ছোট বেলার প্রিয় বন্ধনে আবদ্ধ প্রেমিকা বাঁধন পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার শিকার হয়ে চলে যায় চিরদিনের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের শেষে যোদ্ধাদের এই প্রিয়জন হারানোর বেদনাকে মুখ্য করে এই ছোটগল্পটি রচনা করা হয়েছে। ভীষণ রোমান্টিক এবং হৃদয়স্পর্শী একটি গল্প।
এই বইয়ে আমরা আরও পাব লেখকের জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে লেখকের জীবনের অনেকটা জুড়ে তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছেন সেই গল্প। যে গল্প রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি, রবীন্দ্র-দর্শনের প্রতি তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করবে; রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাবার, গবেষণা করার একটি তাগিদ তৈরি করবে। এছাড়াও এই বইয়ের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো 'মানুষের ধর্ম'। এখানে তিনি ভালো মন্দের মিশেলে বর্তমানকালের সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের আসল ধর্ম কি হওয়া উচিত তা সবিনয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার উল্লেখিত একটি উপমা হুবহু তুলে ধরছি.........
একটি বাগানে হরেক রকমের ফুল থাকে। যেমন- গোলাপ, গন্ধরাজ, হাস্নাহেনা, শিউলি, কামিনী মালতী, জুঁই, করবী এমনই আরো কত কি! তারা সবাই সুন্দর, সবাই মনোহর। এতদসত্ত্বেও তাদের সবারই সৌন্দর্যের স্বরূপে আছে ভিন্নতা। কেউ গোলাপি, কেউ সাদা, কেউ লাল আবার কেউ বা হলুদসহ কত বিচিত্র বর্ণের। তাদের গন্ধের মধ্যেও আবার কত বিচিত্র! আমরা কি পারি এক সৌন্দর্য আর সৌকর্ষের সাথে আরেক ফুলের তুলনা করতে? প্রতিটি ফুলই সে তার বিশেষ সৌন্দর্যে ও বৈশিষ্ট্যে মহিমান্বিত। সবাই ফুল ভালোবাসি। আমাদের এক একজনের কাছে এক এক ফুলের সৌন্দর্যের স্বরূপ আলাদা। আমাদের প্রত্যেকের প্রাকৃতিক গড়নের উপর নির্ভর করে এক এক জনের এক এক ফুলের প্রতি আছে একটু বেশি ভালোবাসা বা একটু বেশি আবিষ্টতা। তেমনি ফুলের প্রতি আবিষ্টতার ভিন্নতার মতই আমাদের গড়ন, আমাদের প্রকৃতি অনুযায়ী আমরা এক একজন এক এক ধর্মের প্রতি একটু বেশি অনুরক্ত বা আবিষ্ট। আর একটা কথা- ফুলের সৌন্দর্য আছে এ কথা যেমন সত্য তেমনি কোন ফুলে কাঁটাও থাকে আবার সব ফুলেই পোকাও থাকতে পারে এটাও তেমনি সত্য। তবে আমরা কি ফুলের সেই কাঁটাকে উপেক্ষা করে, ফুলের মধ্যে আশ্রিত পোকাকে দূরে সরিয়ে রেখে সৌন্দর্যকে, ফুলের সৌরভকে আমাদের জীবনের অঙ্গ করি না? স্থান আর কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন ধর্মের প্রবাহমানতায় সব ধর্মই হয়ত তাদের মহিমাময় সব উপাদানের সাথে কোনোভাবে কিছু পরিমাণে অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদান সংযুক্ত হয়েছে। তবে সেই কিছু পরিমাণ অনাকাঙ্ক্ষিত উপাদানকে ফুলের পোকার মতোই দূরে সরিয়ে রেখে আমরা কি পারি না তাদের সৌন্দর্যটুকু ফুলের মতই আমাদের জীবনে গ্রহণ করতে? দুঃখ শোকে জর্জরিত আর জীবন মৃত্যুর খেলায় আবর্তিত এ মহারহস্যময় জীবনে মানুষ যদি পারে ধর্মের আধ্যাতিক সৌন্দর্যের নির্যাসটুকু গ্রহণ করে তার সাথে বিজ্ঞানের পার্থিব বস্তুগত সত্যকে যুক্ত করে সব মানুষকে এক জ্ঞান করে মানুষ তার অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বের শিখা কে প্রজ্জ্বলিত করতে, তবেই হয়তো সব মানুষের মন থেকেই ঘুচে যাবে এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে ছোট করে দেখার হীন মানসিকতা।
এছাড়াও এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত কিছু উল্লেখযোগ্য পাঠ হলো 'আত্ম জিজ্ঞাসা ও জীবনের অলীক নিয়ম', 'পাথরের গল্প', 'মানব বিবর্তনের রহস্য উদঘাটনে জীবাশ্ম জেনোমিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং ভান্তে পাবো' এবং সকলের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখ্য 'গরুর দুধ কি মানুষের জন্য?' নামক নিবন্ধটি।
সবশেষে এই বলতে চাই, এই বইটি আমার কাছে একটি কমপ্লিট প্যাকেজ মনে হয়েছে। এর মধ্যে আছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনা, আছে আবেগ- অনুভূতি, দুঃখ-বেদনা, আছে শান্তি-আনন্দ, মৃত্যু-বিরহ-দহন এককথায় জীবনবোধ, জীবন দর্শন আর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রেম এবং রোমান্স। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় লেখক অনেক কঠিন বিষয়কে সহজেই সকল স্তরের পাঠকের জন্য বোধগম্য করে রচনা করেছেন বইটি। শুরুতেই বইয়ের অপূর্ব প্রচ্ছদ আর লেখায় লেখকের ভাষা প্রয়োগে প্রাঞ্জলতা যেকোনো নিবিষ্ট পাঠককে আদ্যেপান্ত টেনে নিয়ে যাবে বইয়ের শেষ পাতা অব্দি। অন্তত আমার মতো পাঠককে তো অবশ্যই ই।
জীবন রথে চড়ে জীবনের আনন্দ সুখ দুঃখ নানান আবেগমিশ্রিত সময় পার করে করে আমরা জীবনকে কখনো যাপন কখনো বা উদযাপন করতে করতে জীবনের অনেক দূরে চলে যাই। জীবনের নানান চরাই উতরাই, কঠিন সময় অতিক্রম করতে করতে কখনো থমকে যাই। জীবন থেকে সরে যেতে চাই। জীবন চলার পথে এই থমকে যাওয়া সময়গুলোতে আমরা আমাদের মনের অজান্তেই ফিরে যাই বহুদিন পূর্বের ফেলে আসা জীবনের জীবন্ত সময়গুলোতে। থমকে যাওয়া সময়গুলোতে এই জীবন্ত স্মৃতিই যেন জীবনের সেই উল্টো রথ। সেই উল্টো রথই আবার উৎসে ফেরার অনুপ্রেরণা আমাদের।
**********
উল্টো রথে উৎসে ফেরা
ড. অমল রায়
প্রকাশক: মহাকাল প্রকাশনী।
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ ফাল্গুন ১৪২৯ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৩
প্রচ্ছদ: প্রশান্ত সাহা শান্ত
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২৮৩
মূল্য: ৫৪০ টাকা
ISBN:978-984-97477-2-7
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম