'চন্দ্রা-মণি' একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। কল্পকাহিনির মাধ্যমে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির একটি আংশিক চিত্র এই উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। মহারাণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, মুজাহিদিনদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সহজ-সরল মুসলমানদের ভোগান্তি, শিয়া-সুন্নি গোত্রের মতপার্থক্য, ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সুবিধা ভোগ, সুবিধাবঞ্চিত মুসলমানদের করুণ কাহিনি, ব্রিটিশ হিন্দুপ্রীতি ও শিখদের অবস্থান সহ কিছু আংশিক সত্য এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। বিরাজ করছে চরম রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা। সেসময় উত্তরবঙ্গের এক দারিদ্র্য-পীড়িত তিস্তা বিধৌত গ্রামে আগমন ঘটে সৈয়দ ওমর শেখের। তিনি গ্রামবাসীকে দীনের কথা বলতেন, ধর্ম-কর্মের ব্যপারে বয়ান দিতেন। গ্রামবাসীও সরল মনে গ্রহণ করেছিলো ওমর শেখকে। তাকে একনজর দেখার জন্য মানুষের ভীর জমত। গ্রামবাসীর সারল্য এবং আতিথিয়েতায় মুগ্ধ হয়ে তিনিও এ গ্রামেই ঘাঁটি গারেন। ওমর মূলত একজন মুজাহিদিন। বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরীন প্রদেশসমূহ থেকে জিহাদি বসতিতে মানুষ ও টাকাপয়সা সংগ্রহের জন্য দায়িত্ব পালনের জন্য এ অজপাড়াগাঁয়ে তার পদার্পণ। যা গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে একেবারে লুকানো ছিলো। গ্রামের ছোটছোট ছেলে-মেয়েদের দীনি-এলেম শিক্ষার জন্য গ্রামবাসী খড়ের ছাউনি করে দেয়। আর ওমরের খাবারের দায়িত্ব নেন রহমান মোল্লা। সেই সুবাদে মোল্লা পরিবারের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওমরের৷ এবং মোল্লা সাহেবের একমাত্র মেয়ে জোৎস্নার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ মোল্লা সাহেব এবং তার স্ত্রী ওমরের সাথে জোৎস্নার বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। একদিকে জোৎস্নার প্রেম এবং সংসারের মায়া অন্যদিকে একজন ব্রিটিশ বিরোধী সক্রিয় কর্মী হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালন থেকে দুরে থাকা। এ উভয়ের দ্বন্দ প্রায়শই ভেতরে ভেতরে কুড়ে খেত ওমরকে। ওমর যে নিজ দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করেনি তেমনটা নয়। কিন্তু গ্রামবাসীর ধর্মীয় অনুভূতির কাছে বারবার হেরে গেছে। মোল্লাসাহেব সন্দেহ প্রবণ হয়ে ওঠেন। কিন্তু মেয়ের দিকে তাকিয়ে চেপে যান। ভাগ্যান্বেষণে ওমর ওই গ্রামে আসেন, তাতে কি দোষ ওমরের! মোল্লা সাহেব ভাবেন, "কত পাখি আকাশে ওড়ে। রোজ রোজ কত চিল পৃথিবীকে দেখার জন্য আকাশে উড়ে, তাতে পৃথিবীর আকাশ নষ্ট হয়?" মুসলমানদের ওপর ব্রিটিশ শাসনের নির্মমতা তিনি নিজেও জানেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করলেও সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজাহিনদের তিনি সমর্থন করতেন না।
এরই মাঝে মোল্লা সাহেবের মেয়ে জোৎস্না অর্থাৎ ওমরের স্ত্রী গর্ভবতী হন। সকলের মতো ওমর খুশি হলেও তার ভেতরে শংকা বিরাজ করতো। কারণ তিনি বড় হয়েছেন ইমাম সাহেব (সৈয়দ আহমদ) -এর কাছে। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুজাহিদিন ছাউনির একজন সৈনিক। কিন্তু দায়িত্ব পালন না করে তিনি সংসার ধর্মে যুক্ত হয়েছে। এর জন্য যে তাকে কি শাস্তি ভোগ করতে হবে তা আন্দাজ করতেই পারেন। শঙ্কা দুরে রেখে তিনি জোৎস্নার সাথে প্রেম বিনিময়ে এবং খুনসুটিতে মেতে থাকার চেষ্টা করতেন। হঠাৎ গ্রামে দু-জন আগন্তুককে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। এরা যে মোজাহিদিন ছাওনির লোক, এনাদের যে ইমাম সাহেব (সৈয়দ আহমদ) পাঠিয়েছেন তা বুঝতে পারে ওমর। সে আরো বুঝতে পারে তাকে ক্যাম্পে ফিরতেই হবে। সে কথায় কথায় জোৎস্নাকে তার মনবাসনা ব্যক্ত করে। তাদের অনাগত সন্তান মেয়ে হলে নাম রাখতে বলে চন্দ্রা আর ছেলে হলে মণি। একদিন সত্যি সত্যি ওমর নিখোঁজ হয়ে যায়। পুরো পরিবার ভেঙে পরে। মোল্লা সাহেব মেয়েকে শান্তনা দেন, "দুঃখে, শোকে, তাপেও মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়। থেমে গেলে কিছু হবে না। জীবনের কলরোলই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। দুঃখের মাঝেই সুখ, সুখ-দুঃখের মাঝেই জীবন।" সময় তার নিয়মে অতিবাহিত হয়। যথাসময়ে জোৎস্না দুটি জমজ কন্যা সন্তান প্রসব করেন। যাদের নাম রাখা হয় চন্দ্রা এবং মণি।
চন্দ্রা এবং মণি বড় হতে থাকেন। আর শুরু থেকেই নানাসময়ে নানা বিষয়ে গ্রামবাসীর রোসানল মোকাবিলা করতে হয় মোল্লা পরিবারকে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে জামাইকে খুঁজতে তিস্তায় এক পালতোলা নৌকায় অজানা গন্তব্য পাটনার উদ্দেশ্যে রওনা করে নিখোঁজ হন রহমান মোল্লা। পুরুষহীন পরিবারে অভাব আর নিত্যদিনের চাহিদার যোগান দিতে মাঠে কাজ শুরু করেন জোৎস্নার মা। স্বামীর ফিরে না আসায়, রোগে-শোকে তিনিও একদিন পারি জমান না ফেরার দেশে। দুই মেয়েকে নিয়ে অবিভাবকহীন জোৎস্না চালিয়ে যান জীবন সংগ্রাম। প্রতিনিয়ত তাকে সহ্য করতে হয় গ্রামবাসীর কটুক্তি। মেয়েদেরও হয়রানির স্বীকার হতে হয়। গ্রামের ইমাম সাহেবের ছেলে খৈয়াম একা পেয়ে একদিন চন্দ্রাকে শারীরিক নির্যাতন করে। লোকলজ্জা এবং সামাজিক নির্যাতনের ভয়ে যা গোপন রাখে জোৎস্নার পরিবার। তৎকালীন সমাজে টিকে থাকার লড়াইয়ের কাছে এ অন্যায়ের বিচার চাওয়া মানে নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারা। এমনিতেই নানা কারণে বারংবার তাদের একঘরে করে রাখার চেষ্টা করে গ্রামবাসী।
ইতোমধ্যে ইংরেজরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে সাধারণ মানুষকে নীলচাষে বাধ্য করে। তাদের গ্রামে মনার্ক নামে এক ইংরেজ বণিক কুঠি স্থাপন করেন। সকলকে নীলচাষে বাঁধ্য করেন। ঘটনাচক্রে চন্দ্রার মনার্ক সাহেবের কুঠিতে কাজের সুযোগ হয়। তাদের পুরো পরিবার চন্দ্রার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল হয়। ঘনঘন যাতায়াতে মনার্ক সাহেবের সাথে চন্দ্রার অবৈধ সম্পর্ক গরে ওঠে। দু-বোন জমজ এবং অত্যন্ত সুন্দরী হলেও দুজনের চালচলন এবং আচরণে বিস্তর ফারাক ছিলো। মণি ধর্মীয় অনুশাসনে বিশ্বাসী ছিলো। অন্যদিকে গ্রামবাসী চন্দ্রাকে নিয়ে সমালোচনা করতো, খ্রীস্টান ব্যবসায়ীর বাসায় কাজ করার জন্য তাকে তিরস্কার করতো। চন্দ্রার বেপরোয়া চলাফেরা, উগ্রতা ও নগ্নতাকে মণি ঘৃণা করত। প্রায়শই দুবোনের মাঝে ঝগড়াঝাঁটি হতো। গ্রামবাসী তাদের উত্ত্যক্ত করতো। মনার্ক সাহেবের সাথে চন্দ্রার অবৈধ সম্পর্কের জেরে একদিন গ্রামবাসি কুঠিতে আক্রমন চালায় এবং মনার্ক সাহেবকে হত্যা করে। একইদিনে সামাজিক অবহেলা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনার জন্য চন্দ্রা-মণিসহ তার মা রাতের অন্ধকারে নিখোঁজ হয়। তাদের বসতবাড়ি এখনো চন্দ্রা-মণির জমি নামে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। গ্রামের মানুষ ইংরেজ বণিক মনার্ক সাহেবের নাম উচ্চারণ করত "মনার"। এরই থেকে পরবর্তীতে গ্রামের নাম হয় "মনার কুঠি"।
উপন্যাসটির লেখক শাহাজাদা বসুনিয়ার জন্ম এই মনার কুঠি গ্রামে। উপন্যাসের আদলে কল্পকাহিনির মাধ্যমে তিনি উপস্থাপন করেছেন অষ্টাদশ শতাব্দীর অজনা ইতিহাস। যেখানে একই সাথে উঠে এসেছে লেখকের নিজ গ্রাম নামকরণের ইতিহাস। শাহাজাদা বসুনিয়ার পিতা হায়দার বসুনিয়াও একজন নিভৃতচারী লেখক। যাকে এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে। পিতার মতো তারও সৃষ্ট সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হলো শব্দ ও বাক্যের সাবলীলতা। অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ এবং তিস্তা বিধৌত অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে উপন্যাসটি পাঠককে চমৎকার ধারণা দেয়।
+_+_+_+_+_+
বই: চন্দ্রা-মণি (উপন্যাস)
লেখক: শাহাজাদা বসুনিয়া
প্রকাশক: প্রকৌ. মেহেদী হাসান (বাংলাপ্রকাশ, ঢাকা, বাংলাদেশ)
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০.০০৳
পৃষ্ঠা: ১৪৪
ISBN: 978-984-429-296-3
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম