অনুপম মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'খ্রিস্ট' সম্পর্কে দেবাশিস দাস

অনুপম মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'খ্রিস্ট' সম্পর্কে দেবাশিস দাস


ধর্ম কি বিদ্রোহসঞ্জাত? এর উত্তর নানাবিধ। তবু এটা বলা যায় যে, ধর্মের উৎপত্তিতে বিদ্রোহের বীজ কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকেই। এই বিদ্রোহকে অতিক্রম করে যাবার প্রক্রিয়ায়, একজন মানুষ, প্রকৃত মানুষ হবার রাস্তা খুঁজে পায়। আর মানুষ হবার পরেই তার খ্রিস্টত্ত্ব কিংবা বৌদ্ধত্ব লাভের পথ,  একটা হিমশীতল সমুদ্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সামনে। তাকে ভেবে নিতে হয়, মানুষ হবার যে আগ্নেয় প্রক্রিয়া দিয়ে সে নিজেকে নিয়ে এসেছে এতটা দূর, এখন বোধি লাভের জন্য তাকে পাড়ি দিতে হবে এক বিশাল মৃত্যুশীতল সমুদ্র। সে কি তৈরী? মানুষ হবার এই আয়োজনে তার সাথে সমমানসিকতার অনেকের অবস্থান হয়তো ছিলো, কিন্তু বোধি লাভের এই মৃত্যুশীতল প্রক্রিয়ায়, তাকে একাই বহন করতে হবে নিজের অবশিষ্ট মৃতদেহকে। এটাই তার শেষ পরীক্ষা কিংবা শেষ বিদ্রোহ? মানুষকে অতিক্রম করে যাবার এক গেরিলা যুদ্ধ। যীশু কী পারলেন? পারলেন কী শাক্যমুনি? অথবা নদের নিমাই?

এই মূল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়াই মানুষের এক চিরন্তন জিজ্ঞাসা। যার ভেতর থেকে মানুষ যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে অনেকটাই মানুষ হয়ে যায়। আর কালেভদ্রে সেই প্রক্রিয়া আর বিদ্রোহকে পেরিয়ে আমাদের সামনে আসেন কোনো খ্রিস্ট কিংবা কৃষ্ণ!

আগরতলা বইমেলা ২০২৩। প্রথম দিনেই 'উবুদশ' থেকে যে সকল বইগুলো নিয়েছিলাম তার মধ্যে অনুপম মুখোপাধ্যায়ের 'খ্রিস্ট' অন্যতম। বইটির প্রচার হয়তো বইটির প্রতি আকর্ষণের অন্যতম একটা কারণ, তবে মূল কারণ ছিলো লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি জানার, যে,  কোন বিষয় থেকে দাঁড়িয়ে তিনি খ্রিস্টকে নিয়ে এই কাজ করলেন।

কে এই খ্রিস্ট? না, কোনো ঈশ্বরীয় চেহারার অধিকারী সুদর্শন সৌম্যকান্তি কেউ নন। বরং এক অপাঙক্তেয় কেউ। যাকে একটা রুটির অভাবে রাতের পর রাত কাটাতে হয়েছে ক্ষুধার মানবিক যন্ত্রনা নিয়ে। ঈশ্বর তো অনেক দূরের কথা, বরং,  শীর্ণ কালো উলঙ্গ কঠিন কঙ্কালসার একটা লোক, যার জীবনের মূল লক্ষ্য বিদ্রোহ! এই বিদ্রোহই তাকে অবিস্মরণীয় রেখেছে মানব ইতিহাসের পাতায়।

মৃত্যু অবশম্ভাবী। কিন্তু একটা শৈল্পিক মৃত্যুবরণ মানুষকে অমরতার দিকে যায়। খ্রিস্ট, কৃষ্ণ, নিমাই, গান্ধী, গুয়েভারা, ভার্জিনিয়া উলফ, এরা প্রত্যেকেই শৈল্পিক মৃত্যুবরণ করেছেন, আর প্রত্যেকের মৃত্যুর প্লট একটাই - 'বিদ্রোহ'। এটাই মানুষের সবচেয়ে বড় সত্য।

উপন্যাসের শুরুতেই লেখক ইশুয়াকে দাঁড় করালেন বধ্য ভূমিতে। তখন তিনি ইশুয়া, খ্রিস্ট নন। তার মৃত্যু দৃশ্য, বধ্যভূমির আয়োজন, সমস্ত উত্তেজনা, সবকিছু নিখুঁত ভাবে ফুঁটে উঠেছে প্রতিটি পাতায়। একটা পুরোনো অভ্যাসকে জাগিয়ে দেওয়ার একটা আধুনিক ট্রেন্ড। অর্থাৎ এই মৃত্যু দৃশ্য কিংবা ইশুয়ার খ্রিস্টত্ত্ব লাভের সেই চেষ্টার বাস্তবায়ন কতদূর, তা জানতে গেলে এগিয়ে যেতে হয় আরো।

উপন্যাস গড়ায়, ইশুয়ার বাল্যকাল। যার তীব্র ইচ্ছা তার বাবার খোঁজ। কে তার প্রকৃত পিতা এই তার অন্বেষণ। মারিয়ার উচ্চারণ, "যিনি সকলের পিতা, তিনিই তোমার পিতা।" তখন ইশুয়ার জিজ্ঞাসা, কিভাবে রোমিয়েদের পিতা আর ইহুদিদের পিতা এক? শোষক আর শোষিতের পিতা কখনোই এক হতে পারেনা। এই আজন্ম জিজ্ঞাসা থাকে পৃথিবীর প্রতিটি নিপীড়িতের।

তাই একটি দেশ কখনোই প্রকৃতপক্ষে সকলের হতে পারেনা। এই সেন্টিমেন্ট যিনি জাগাতে পারেন তিনিই খ্রিস্ট, আর বিপ্লব তার পথ। আর এই বিপ্লবের জন্য দরকার শিক্ষার। ইশুয়ার শিক্ষা দরকার। যোহন তাই তাকে ভারতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

উপন্যাস গড়ায় আরো, যোহনকে পাই আমরা। যে যোহন নিজেকে মশিহা ভাবে, কিন্তু পুরাতন নিয়ম অনুসারে সে বিশ্বাস করে দাঁতের বদলে দাঁত। ইশুয়ার তার সাথে কথা হয়, ইশুয়ার প্রশ্নে সেও অতর্কিত। সেই যোহন ইশুয়াকে যর্দনের জলে অভিসিক্ত করে, তৈরী করে তাকে ভারতে যাবার জন্য।

পাতা উল্টাতে থাকি আরো, মন্ত্রের মতো, ডিটেক্টিভ গল্পের মতো এক অমোঘ আকর্ষণ। ইশুয়ার ভারতের অবস্থান। এই বিশাল দেশে বৈচিত্র, দর্শন আর অতিন্দ্রীয়বাদের এক মিশেল পাওয়া যায়। কিভাবে এক বৃদ্ধ ঋষি তাঁকে টেনে তুলছেন জ্ঞান মার্গের দিকে।

অতঃপর ইশুয়ার প্রত্যাবর্তন। পাতা উল্টে যায় আরো। এবার বধ্যভূমি। ইশুয়াকে নিজের খ্রিস্টত্ত্ব শুধু নয়, প্রমাণ করতে হবে তার শ্রেষ্ঠত্ব, তাকে যোহনের দীর্ঘ ছায়াকে অতিক্রম করে যেতে হবে।

যদি যোহন কে নির্বাসন দেওয়া হয় মসিহা হিসেবে নিজেকে ঘোষণার জন্য? তখন ইশুয়ার দায়িত্ব আরো বাড়বে পথ আরো কঠিন হয়ে যাবে সদ্য মৃত একজন মসিহার উপরে খ্রিষ্ট হিসেবে তার মান্যতা।

অর্থাৎ খ্রিস্টত্বের মধ্যেও কি কোথাও কোন জায়গায় প্রতিযোগিতা রয়েছে? প্রয়াত কবি প্রবুদ্ধসুন্দর লিখেছিলেন,


প্রতিযোগিতা পুঁজিবাদের একটি উদাহরণ।


এই জায়গায় দাঁড়িয়ে লেখক খ্রিস্ট সম্পর্কে যে ধারণা দিতে চাইলেন তাতে মনে হয় এই পৃথিবীতে সমস্ত ভালো কিছুর মধ্যেও কোথাও না কোথাও একটা আত্মপ্রতিষ্ঠার জায়গা রয়ে গেছে। আর এই আত্ম প্রতিষ্ঠার জায়গা থেকে যদি কেউ সরে আসে তবেই হয়তো সে খ্রিস্ট উপাধি পায় তাহলে কি ইশুয়ার অবস্থান কোথায়?? সেও কি আত্মপ্রতিষ্ঠা চায়? নাকি চায় খ্রিস্টত্ত্ব?

এই প্রশ্নের উত্তরে আরো এগিয়ে যায় উপন্যাস। একটা দৃশ্যকল্পকে পাই আমরা। বিষয়টা এমন, 


একটা পিঁপড়ে একটা ছোট্ট শুকনো ডাল কে পেরোবার চেষ্টা করছে বাতাসে এখনো মৃদু হিম। এর মধ্যে যেন একটা যুগ কেটে গেল দূরে কোথাও কিছু ঘোড়সওয়ার সবাইকে পেরিয়ে চলে গেলো দূর।


প্রশ্ন জাগে, এটা কি শুধু নিছক একটি কল্পনা নাকি উপরের কথার সঙ্গে নিচের কথার একটি শৈল্পিক যোগ আছে। অর্থাৎ একটি ছোট্ট পিঁপড়েকেও একটা শুকনো ডাল পার হতেও এক যুগ সময় লাগে। ঠিক সেভাবেই জ্ঞান হলেই প্রজ্ঞাবান হওয়া যায়না। তার জন্য পেরোতে হয় পথ।

সংসার, প্রজ্ঞালাভের তাই একমাত্র ব্যবহারিক সংগ্রাম।

না, সব বলা ঠিক নয়। কিছুটা রহস্য থাকা দরকার। এই রহস্য থেকেই পড়বেন আগামীর পাঠক।

তবু শেষ হয়েও শেষ হয়না খ্রিস্ট। কে এই খ্রিস্ট। এই খ্রিস্ট সেই প্রত্যেকেই যারা বিদ্রোহ করেছেন প্রচলিত প্রথা আর শোষণের বিরুদ্ধে। রুখে দাঁড়িয়েছেন অত্যাচার আর নিপীড়নের সামনে। যারা জীবন বাজি রেখেছেন শুধু মানুষের জন্য।

তাই এই উপন্যাস শুধু, আর্মিথিয়ায় জন্ম নেওয়া ঈশ্বরের পুত্রের নয়, বরং আজ খ্রিস্ট সবাই যারাই কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের জন্য।

এখানেই এই উপন্যাস সার্থক ও বিশ্বজনীন।

শত মতে সংঘাত ঘটুক, শত পুষ্প বিকশিত হোক। সংঘাত ও বিদ্রোহই অস্তিত্ব গঠনের মূল হাতিয়ার।

আর, আমাদের খ্রিস্টও এই বিদ্রোহেরই এক জীবন্ত উদাহরণ।

___________________

উপন্যাস : খ্রিস্ট
লেখক : অনুপম মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক : তবুও প্রয়াস, ভারত
রাজীব দত্ত
৩৭৫রুপী

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ