আমরা যারা হাংরিদের কয়েক প্রজন্ম পরে এসেছি, তাদের কাছে এই আন্দোলনের স্পষ্ট ছবি গড়ে ওঠেনি, যেমন কল্লোল যুগের একটা ছবি মোটামুটি গড়ে দিয়ে গেছেন অচিন্ত্য সেনগুপ্ত। তার কারণ কল্লোল নিয়ে তেমন আলোচনা আর হয় না, কেবল কল্লোলের গল্পকার ও কবিদের, সকলের নয়, কয়েকজনের রচনার আলোচনা হয়। কল্লোল যুগের একটি প্রধান বৈশিষ্ট ছিল রবীন্দ্র বিরোধিতা। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবপ্রেমী সাহিত্যের বৃত্ত থেকে দূরে সরে গিয়ে কল্লোলের আধুনিক সাহিত্যের বাঁকবদলকে সাধারণ পাঠকরা খুব সহজে মেনে নেয়নি সেই সময়ে। হাংরিরা কিন্তু রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন না; তাঁদের কবিতায় পড়ি সদর স্ট্রিটে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একতারা নিয়ে নাচছেন ।
জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও অশ্লীলতা আবিষ্কার করেছিলেন অধ্যাপকরা; যাঁদের সমালোচনা করে জীবনানন্দ ‘সমারূঢ়’ কবিতাটি লেখেন। আমি মলয় রায়চৌধুরীর এই বইটি প্রকাশ করছি সেই ধরনের আলোচকদের জন্য যাঁদের নিয়ে জীবনানন্দ ‘সমারূঢ়’ কবিতাটি লিখেছিলেন। আমি বিভিন্ন আলোচকের বক্তব্য এখানে প্রস্তুত করছি যাতে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে একটি নিরপেক্ষ বীক্ষণ সম্ভব হয়। এই মুখবন্ধ রচনার সময়ে দেখছি হাংরিদের নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, এখনও লেখা হচ্ছে।
কল্লোলের বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগে মামলা হয়েছিল কিন্তু তাকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না যেমন হাংরিদের রচনায় অশ্লীলতার মামলা নিয়ে আলোচনা হয়। কল্লোল গোষ্ঠী আধুনিকতার নামে যথেচ্ছাচারিতা ও অশ্লীলতার প্রশ্রয় দিচ্ছে অভিযোগ এনে ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে ভিন্ন বলয় গড়ে তোলেন মোহিতলাল মজুমদার, সজনীকান্ত দাস ও নীরদ চৌধুরী। কল্লোলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল সেই একই অভিযোগ শোনা যায় হাংরিদের বিরুদ্ধে, যেমন, পাশ্চাত্য সাহিত্যকে অনুকরণ করে সাহিত্য রচনা করা এবং আধুনিকতার নামে যথেচ্ছাচারিতা ও অশ্লীলতার প্রশ্রয় দেয়া ইত্যাদি। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি হাংরি আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন, তাঁর ‘ঘাম’ গল্পটিকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘অশ্লীল’। স্বাভাবিক যে হাংরিদেরও তারাশঙ্কর বলেছেন অশ্লীল।
ঠিক যেমন কল্লোল যুগ বলতে বাঙলা সাহিত্যের একটি ক্রান্তি লগ্নকে বোঝায়, যখন বাঙলা কবিতা ও কথাসাহিত্যে আধুনিকতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল, তেমনই এক ক্রান্তি লগ্ন বোঝায় হাংরি আন্দোলন, কেননা ষাটের দশকে হাংরিদের গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে বোঝা গেল সমস্ত ব্যাপারটা কী সাংঘাতিক ভিকটোরিয়ান ছিল। আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি আগেকার প্রজন্ম। হাংরিদের একটা উক্তি পড়েছিলাম যে, "আধুনিকতা এক ধ্রুপদী জোচ্চোর"। এর মানে আজ বুঝতে পারি। এ হল ইউরোপিয় এনলাইটেনমেন্ট প্রসূত আধুনিকতা - যা শাসকপ্রভুদের কলোনিমনন তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। যাতে প্রভুদের শিখিয়ে দেয়া গাইডলাইনের বাইরে কেউ কিছু না ভাবে। হাংরিরা বাংলা ভাষায় লেখালিখির মধ্য দিয়ে ব্যাপারটায় একটা জোর ধাক্কা দেন। তাতেই হৈ হৈ ব্যাপার। যে-উপকরণ, যে-দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে হাংরিরা সাহিত্যে এসেছিলেন, সেই ঋদ্ধতা কম সাহিত্যিক-গোষ্ঠীর থাকে। কবিতা ক্যাম্পাস পত্রিকায় প্রকাশিত, অলোক বিশ্বাসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “হাংরির পরে আরও আন্দোলন হলো, কোনোটাই হাংরির কৌলিন্য পায়নি।”
বাংলা আকাদেমি পত্রিকা নভেম্বর ১৯৯৭ সংখ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান বিমলকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন,
এক আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে দেখা দিয়েছিল, চারিদিকে মাতন লাগিয়ে। আজকের ভারতীয় সাহিত্য ‘দলিত আন্দোলনের’ পুরোগামী তাঁরা। তারা নিম্নবর্গের মানুষের সাহিত্যের ‘কন্টেন্ট’ ও ‘ফর্ম’ নিয়ে কিছু করার কথা ভেবেছিল।
জিজ্ঞাসা পত্রিকার কার্তিক-পৌষ সংখ্যায় শিবনারায়ণ রায় লিখেছিলেন,
কোনও সমাজ যখন নানা কারণ সমাবেশে স্হবির ও উদ্ভাবনাহীন হয়ে পড়ে তখন সেখানে প্রাণ ও গতির সঞ্চার বিভিন্ন উপায়ে ঘটতে পারে। এটি অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে বহিরাগত শক্তির আঘাতে; কখনও কখনও অভ্যন্তরীন বিরোধ এবং তজ্জাত অত্যয়ের ফলে। কখনও বা কিছু সংখ্যক সচেতন আদর্শবাদী উদ্যোগী স্ত্রী-পুরুষের একনিষ্ঠ প্রয়াসে সেই সমাজের সংবিষ্ট ও ভোগবৃত্ত দশা থেকে উদ্ধার ঘটে। হয়তো সামাজিক উজ্জীবনের জন্য উদ্যোগী কয়েকজনের উদ্যম ও অধ্যবসায়ই যথেষ্ট নয়। তবু তাঁদের কাছে সমাজের ঋণ গভীর; তাঁদের জীবন পরবর্তী প্রজন্মের প্রেরণার উৎস। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে আর এই ধরণের পত্রিকা অথবা সাহিত্য আন্দোলন বড় একটা চোখে পড়ে না। সাহিত্যজগতে ব্যাবসয়ী প্রতিষ্ঠানের ( দেশ ও আনন্দবাজার গোষ্ঠী ) বিবর্ধমান একচেটিয়া কারবার, কমিউনিস্টদের প্রচারসর্বস্ব উচ্চরোল, ক্ষীণসামর্থ্য লেখকদের নিজের নিজের স্বল্পস্হায়ী কাগজ বার করবার অতিপ্রজ প্রচেষ্টা — সব মিলিয়ে সাহিত্যিক আন্দোলনের ঐতিহ্য দ্রুত ক্ষীণ হয়ে আসে। যে অর্থে ‘সবুজপত্র’ বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি পর্বকে এনে তাকে প্রকট করে তুলেছিল, যে অর্থে ত্রিশের দশক বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যের বিপ্লবকাল, সেই অর্থে গত তিরিশ চল্লিশ বছরে পশ্চিমবাংলায় বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় কিছু ঘটেনি। সুরচিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, এমনকি উপন্যাসও স্বল্পসংখ্যায় লেখা হয়েছে বটে। কিন্তু কোনও প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন আন্দোলন বা নতুন দিগদর্শীর সন্ধান মেলে না। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সঙ্গে কিছু সমর্থ তরুণ যুক্ত ছিলেন ; তাঁদের ভিতরে কয়েকজন পরবর্তীকালে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন; কিন্তু ‘কৃত্তিবাসের’ চরিত্রে আন্দোলন গড়ে তোলবার অথবা নতুন দিক খুলে দেবার আভিমুখ্য ও শক্তি আদৌ ছিল না। ‘সবুজপত্র’, ‘কবিতা’, ‘পরিচয়’, বা ‘পূর্বাশা’ জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে .কৃত্তিবাসের’ নাম যুক্ত করা নিতান্তই অসঙ্গত। ওই পত্রিকার প্রধান লেখকদের মধ্যে কয়েকজন পরে আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজকাল ইত্যাদি ব্যাবসায়িক পত্রিকার আশ্রয় নিয়ে বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন । ষাটের এবং সত্তরের দশকে আমি বেশিটা সময় ভারতবর্ষের বাইরে ছিলাম। বন্ধুদের কাছ থেকে এবং পত্রপত্রিকার সূত্রে জানতে পারি যে, অন্তত পশ্চিমবাংলাতেও শিক্ষিত তরুণ-তরুণী মহলে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বার্লিন, বার্কলি এবং জাকর্তায় যে যুবাবিস্ফোরণ আমি দেখেছি, কলকাতার ছাত্র-ছাত্রীদের অস্হির আলোড়নের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা আমার জানা নেই। রাজনীতির ক্ষেত্রে এই বিক্ষোভ রূপ নেয় নকশাল আন্দোলনে — বিপ্লবী বুলির আড়ালে ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতাদের সুবিধাবাদী ক্রিয়াকলাপ তাদের কিছুসংখ্যক তরুণ—আদর্শবাদী অনুগামীদের মনে যে বিরূপতা জাগিয়ে তুলেছিল নকশাল আন্দোলনে আকার খোঁজে। তাদের মধ্যে একটি ছিল হাংরি আন্দোলন। এটি সম্পর্কে কিছু সংবাদ বিদেশি পত্র-পত্রিকায় পড়ি; কিছু খবর পাই আমার মারাঠি ও গুজরাটি বন্ধুদের কাছে। হাংরিরা তাঁদের ক্ষোভ আক্রোশ ব্যর্থতা ও আত্মাভিমানকে উচ্চণ্ডভাবে প্রকাশ করে রফাশ্রয়ী, ভণ্ড, জীর্ণ, বাঙালি বাবুসমাজকে উচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন।
যুগশঙ্খ সংবাদপত্রের সহসম্পাদক বাসব রায় লিখেছেন,
মলয়, বাসুদেব, ফালগুনী, শৈলেশ্বর, সুবো, সুবিমল, দেবী, অবনী, প্রদীপ প্রমুখ তখন আমাদের ঘরের ছেলে। তাঁদের লেখা যেখান থেকে হোক সংগ্রহ করে পড়ছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। এই আবহে আমি বড় হয়েছি। আর তাই মূলধারার সাহিত্যের প্রতি কখনো আগ্রহ বোধ করিনি। ১৪-১৫ বছরের মধ্যেই আমি পড়ে নিয়েছি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বা ‘চর্মরোগ’। এবং সেখান থেকেই এই প্রতীতী সম্ভবত জন্মে যায় যে সাহিত্য বলতে এসবই, বাস্তবতা-জীবন-অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর ছাড়া সাহিত্য হয় না। যে কোনো আন্দোলনের একটা প্রকরণ আছে। আছে একটা স্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনকে যত দমিয়ে রাখা হয় ততই আন্দোলনের অন্তঃশক্তি বাড়ে। আর সেটা হাংরি মুভমেন্টের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। আজও যখন কেউ ‘ছোটলোক’-এর সংস্কৃতি তুলে আনেন কবিতায়-গদ্যে, আমরা বলি বাঃ তুই তো হাংরিদের মতো লিখছিস।
বিজনেস স্ট্যাণ্ডার্ড পত্রিকায় ২১ জানুয়ারি, ২০১৩ তারিখে নয়নিমা বসু লিখেছেন,
পশ্চিমবাংলার দেশভাগোত্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন কালখণ্ড। এক নতুন প্রতিবাদী সাহিত্যের জন্ম দিয়েছিল নভেম্বর ১৯৬১ সালে, আভাঁগার্দ সাহিত্য আন্দোলন হাংরি জেনারেশন। সেই আন্দোলন সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং বাবু বঙ্গ-সমাজের কটু সমালোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের প্রথাবাহিত মৌল তর্কবিন্দুগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। সেই সময়ে কলকাতা, যাকে তখন বলা হতো ক্যালকাটা, অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। দেশভাগের সর্বনাশা কারণে উৎখাত মানুষদের ভয়াবহ স্রোত বদলে দিচ্ছিল কলকাতা শহর ও তার আশেপাশের শহরতলি অঞ্চলকে। দেশভাগের আগে থেকেই আতঙ্কিত মানুষেরা। পশ্চিমবাংলায় আসা আরম্ভ করেছিল এবং তা ষাটের দশকে এবং তার পরেও বহুকাল বজায় ছিল। ১৯৫৯ পর্যন্ত বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে গিয়েছিল, এমনকি ভিটে ছাড়ার সময়ে খুন হয়েছিল। যুবসমাজের একটা অংশ এই সর্বনাশকে সহ্য করতে অপারগ ছিল। তাদের মনে হয়েছিল যে ভারতের কংগ্রেস পার্টির নেতারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা পরিণত হয়েছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে। নিজেদের ক্রোধকে প্রকাশ করার জন্য কয়েকজন তরুণ আরম্ভ করলেন হাংরি আন্দোলন, যা হাংরি জেনারেশন নামে খ্যাত। হাংরি আন্দোলনের আগে আর কোনো এরকম সামাজিক-রাজনৈতিক সাহিত্য আন্দোলন হয়নি।
**********
হাংরি যুগ
মলয় রায়চৌধুরী
প্রচ্ছদ: সুপ্রসন্ন কুন্ডু
প্রকাশ: ২৫ শে বৈশাখ ১৪৩০
প্রকাশনা: এবং অধ্যায়, কলকাতা, ভারত।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম