গদ্য ছন্দের বাহন গদ্য। সমালোচকের মতে, পদ্যের চেয়ে গদ্য অনেক বেশি স্বাধীন, বৈচিত্রময় ও স্বেচ্ছা বিচরণকারী। গদ্য ছন্দের পর্ব ও পক্তি কোনোটাতেই পদ্যের মতো ছন্দের নিয়ন্ত্রণ নেই। গদ্যের পর্বগুলো যতির দ্বারা নির্দিষ্ট হয় না। এতে আবেগের হ্রাস বৃদ্ধি অনুযায়ী ভাবের প্রয়োজনে এক একটি পর্ব সৃষ্টি হয় এবং ছেদ পড়ে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে গদ্য কবিতার পর্বগুলো ছেদের দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। গদ্য ছন্দের ধ্বনি অনিয়ন্ত্রিত এরপরও গদ্য কবিতা পড়ায় কানের একটা তৃপ্তি হয় ৷ গদ্য কবিতার একটা ধ্বনি সৌন্দর্য আছে। সেখানে স্বাধীনতা মানে বিশৃঙ্খলা নয় বরং আরো সুসামঞ্জস্য। গদ্য কবিতায় অতি নিয়ন্ত্রিত ছন্দের বাঁধনে বাঁধা নয় । যেন নিঃশব্দে, অদৃশ্যভাবে ছন্দের অস্পষ্ট ঝংকার খেলা করে সেখানে। পদ্য ছন্দ উৎপাদন করে যতি। গদ্য ছন্দ উৎপাদন করে ছেদ। শের দ্বারা বিভক্ত হয় বলে গদ্য-ছন্দের বাক্যাংশে পর্বের মতো কোনো নির্দিষ্ট মাপ থাকে না। বিভিন্ন আলোচকের প্রথাগত এই কথাগুলির ভূমিকা এই কারণেই যে প্রচলিত একটি মত আছে ছন্দ সিদ্ধ হওয়া কঠিন বলেই সহজ পথ ধরে নিয়ে গদ্য কবিতার দিকে ঝুঁকে যান কবি যশোপ্রার্থীরা ।
কিন্তু ‘আজরখ নগর’-এর কবি শীলা বিশ্বাস তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে গদ্য ছন্দকে অব্যর্থ ও নিখুঁতভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। পদ্যের মিল ও ছন্দ সচেতন ভাবেই পরিহার করেছেন কবি। অন্দরমহল অর্থাৎ সূচিপত্রে আমরা পাচ্ছি মোট সাতান্নটি কবিতা। সূচনাতেই কাব্যগ্রন্থের অভিমুখ নির্দিষ্ট হয়ে যায়।
ব্যক্তিগত শোক লিখতে পারি না
.... বিপ্লব আর সন্ন্যাসের কথাও লিখতে পারি না
কলমের উপর ভোগের পাহাড় চেপে বসে
নিজেকে লিখতে চাইলে
কলমের নিবে শুধু বিষ নেমে আসে
পাতা ভরে ওঠে
মন্থন হয় (মন্থন)
কবির নিজস্ব স্বরে সমাজ রাজনীতি নিয়ে প্রত্যক্ষ ব্যঙ্গবিদ্রূপ নেই। কিন্তু মেধাবী কলম তার প্রতিবেশ থেকে বিচ্যুত হতে পারে না। “বিদুরের খুদ নাকি কুবেরের ক্যাপুচিনো তর্কে মেতেছি”, “হাত ক্রমশ লম্বা হতে হতে সুতলি হয়ে যাচ্ছে আর অনায়াসে ছুঁয়ে ফেলছি হরপ্পা ও হলিউড”। “একটা জন্ম আরেকটা জন্মের ভিতরে কবি ফুঁ দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে পারেন, শৈশব থেকে আমৃত্যু কসমেটিক অস্ত্রে” মুখ বদলে নেওয়া আর “বন কেটে বনেটে বিসমিল্লাহ” এঁকে নেওয়া জীবনের প্রতিটি বৈপরীত্য তাঁর চোখে পড়ে। শুঁড়িপথ বিটুমিনে ঢেকে যায়, খালি জলসত্র দেখে অসহায় ভাবে মনে পড়ে একদা ইরাবতীর জলধারা।
দৈনন্দিন জীবনকথা অনায়াস ও যথাযথ ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়।
পর্দার আড়াল থেকে স্পষ্ট দেখলাম নখ কাটা হয়ে গেলে বাবার গায়ে কাঁথা টেনে মা উড়ে যাচ্ছেন। ছাপোষা পরিবারে মা-বাবা এর বেশি ভালোবাসাবাসি প্রকাশ করেন না। (মা ও বাবা)
কবি মেয়ের রচিত কবিতায় পুরুষ শরীরের ইমেজারির বদলে “নারী শরীর দেখি, স্তনের মতো ফুটে আছে ম্যাগনোলিয়া।” স্বর্ণালী বিশ্বাসের কবিতার মতো এখানেও দেখি কবিদের শেষ আশ্রয় “গাছে গাছে গীতবিতান”, গীতবিতানের পাতা খুলে আনন্দধ্বনিগুলিতে কান পাতি (দিব্য পথ)— দুই কবির কবিতা পাঠেই দেখি রবীন্দ্রনাথ আমাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছেন।
একেবারে শেষের ট্রেকার্স হাট শিরোনামে টানা গদ্যে চোদ্দটি একই ভাব বহনকারী ভ্রমণ সংক্রান্ত কবিতা আছে । অরণ্যের কাছে, প্রকৃতির কাছে সমর্পণ ও নিজেকে খুঁজে যাওয়ার কথা রেখে গেছেন।
নিবিড় অরণ্যে যে আমিটি হারিয়ে যায় তাকে পরের বার খুঁজে দেয় রাতকানা পাখি। হৃদয়ের সমস্ত দাগ যার চেনা। যা ঠোঁট খুঁটে খুঁটে খায় অরণ্যভোগ।
মেঘের মায়ায় সমর্পণ মুঠো আকাঙ্ক্ষা ও আয়েসের। তন্দ্রার ভেতর মেঘেদের জলকেলি
প্রকৃতির কাছে অনিবার্যভাবেই মানুষ আগলহীন। তুমি ফাঁদে পড়ে গেছ অরূপের ফাঁদ ....
তবু আকর্ষণ এই সুইসাইড পয়েন্ট। প্রেম আসে। দূরে যায়। মৃত্যু এগিয়ে আসে। হাতছানি দেয়।
এই ভ্রমণ কাহিনি থাকে প্রকৃতির মাঝে আত্মবিস্মৃতির, সমর্পণের এবং একই সঙ্গে পুনরুত্থানের।
কবিতার বইয়ের নামে প্রথমেই পাঠকের কৌতূহল তৈরি হবে। আজরখ একটি বিশেষ ধরনের ছাপা যা শাড়ি বা আমরা সচরাচর কাপড়েই দেখি। আজরক বা আজরখ শব্দটি কাপড়ে ছাপার এমন এক কলা বৈশিষ্ট্য যা পাকিস্তানের সিন্দ থেকে গুজরাটের কছের আজরখপুর জেলায় বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে।
যে কাপড়ের উপর আজরখ নামে বিশেষ ছাপচিত্র তৈরি করা হয় সেটি ধোয়া থেকে শুকোনো, ছাপা এবং আবার ধোয়া এসব মিলিয়ে প্রায় ষোলোটি ধাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। পাকিস্তানের ন্যাশনাল মিউজিয়ামে মহেঞ্জোদাড়োর যে পুরোহিত রাজার বিখ্যাত ভাস্কর্য দেখা যায় তার কাঁধের কাপড়টি ও গায়ের কাপড়ে ছোট ছোট বৃত্তাকার দাগে আজরখ ছাপ লক্ষ করা যায়। এইভাবে পৃথিবীর বহু প্রাচীন সভ্যতায় এই ধরনের ছাপচিত্র দেখা যায়। সিন্ধিদের কাছে আজরখ শ্রদ্ধা, গর্ব ও গৌরবের প্রতীক। তাঁরা তাদের অতিথিদের পরম শ্রদ্ধায় আজরখ দিয়ে বরণ করেন। সিন্ধি পুরুষেরা তাদের ঐতিহ্যময় পোশাকে, কোমরবন্ধ ও পাগড়িতে এই প্রাচীন চিত্রকলা সংবলিত কাপড় ব্যবহার করেন। সাধারণত আড়াই থেকে তিন মিটার লম্বা হয়। এই কাপড় লাল রং ও নীল ইদানীং ইন্ডিগো নামে সুবিখ্যাত। প্রধান রং বলা যেতে পারে। আর্কিটেক্চারের নানা জ্যামিতির চিহ্ন আজরখে যুক্ত হয়েছে।
আমরা দেখি কবি শীলা বিশ্বাস লিখছেন,
আজরখ নগরের বালিকার হাওয়ায় ওড়া ইন্ডিগো ঘাগরা। (আজরখ নগর)
অর্থাৎ এই ছাপাই কাপড় আজরখ কিছুটা হলেও তার কবিতা বইয়ের নামকরণে ছায়া ফেলেছে। অজরখের প্রাচীনত্ব, গর্ব, ঐতিহ্য যেভাবে এক জনগোষ্ঠীর মর্যাদার অনুসারী। এই কাব্যগ্রন্থে হয়তো তেমন ভাবেই তিনি বহমান প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে হালফিলের, ইদানীং এর নবীন ফ্যাশন ক্রেজ আজরখ ইন্ডিগোর সেই একই রকম চাহিদার কথা বোঝাতে চেয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে মান একই রকম রেখে বর্তমানেও নিজেকে প্রাসঙ্গিক রেখেছে আজরখ। তাই হয়তো কবি লিখছেন
লাহোর-মুলতানে রেলপথ থেকে ইঁট তুলে হরপ্পা সভ্যতা পুনর্নির্মাণ করছি। সময়কে ওয়ার্প করে উল্টেপাল্টে দেখে দিচ্ছি বিবর্তন।
কবির কল্পনার আজরখ নগরে তাই অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ মিলেমিশে গেছে এবং সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।
পরিশেষে আলোচকের একান্তই ব্যক্তিগত কিছু ভাবনার কথা জানাতে ইচ্ছে করে । অতি সমৃদ্ধ বাংলা ভাষায় এত সমার্থক শব্দ থাকলেও রেসিপি প্রস্থেটিক ইলিউশন, পাঞ্চ সিক্রেট, হিডেন জেন্ডার, পারমুটেশন কম্বিনেশন, অ্যানটমি ইত্যাদি শব্দের বিকল্প ব্যবহারে কবিতার অলংকার বাড়ত বই কমত না ।
**********
আজরখ নগর
শীলা বিশ্বাস
প্রচ্ছদ : অর্পণ
প্রকাশনী: বার্ণিক প্রকাশন, বর্ধমান, ভারত
প্রকাশকাল: ২০২২
মূল্য: ১৩৫/-
পৃষ্ঠা: ৬৪
ISBN: 978-93-92315-35-0
------------------------
প্রথম প্রকাশ: বই নিয়ে কথা বলার কাগজ 'বইকথা', কলকাতা, ভারত, এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যায় মুদ্রিত
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম