'বিন্দু' : শান্ত স্বভাবের ক্ষুরধার লিটল ম্যাগাজিন ~ অনুপ মুখোপাধ্যায়

'বিন্দু' পত্রিকা - শান্ত স্বভাবের ক্ষুরধার লিটল ম্যাগাজিন ~ অনুপ মুখোপাধ্যায়

 ‌
বাংলাদেশের লিটলম্যাগের সাথে খুব বেশি পরিচয় আমার নেই। তবে একেবারে নেই একথা বলা যায় না। আমার পূর্বপুরুষ বাংলাদেশী হবার কারণে পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে উঠেও বাংলাদেশের প্রতি আজন্ম টান অনুভর করি। এই টানের কারণে সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের লিটলম্যাগ ও বই সংগ্রহ করি। একারনে বাংলাদেশের কিছু কিছু লিটলম্যাগের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে। এভাবেই বিন্দু নামে এক অসামান্য লিটলম্যাগের সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। সন ২০১৮। ফেসবুক নিউজফিড ভরে উঠলো একটি প্রতিবাদেঃ বাংলাদেশের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় লিটলম্যাগ বিন্দুর স্টল ভেঙ্গে দিয়েছে বাংলা একাডেমি। আমি চমকে উঠি খবরটি জানার পর। এমনও সত্যিকার প্রতিবাদী প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটলম্যাগ বাংলাদেশে আছে এ আমার জানার মধ্যে ছিল না। আমি খুবই কৌতুহলী হয়ে এদেশে অনেককে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ সদুত্তর দিতে পারল না। অর্থাৎ বিন্দুর কোন কপি এদেশে আসে না বলেই ধারণা করলাম। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিন্দুর অনলাইন সংস্করণ (www.bindumag.com) ও পিডিএফ কপি পড়ার সুযোগ হয়েছে। এরপর সর্বশেষ একটি হার্ডকপি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে পড়ার সুযোগ হল। মার্চ ২০২২ এ প্রকাশিত লিটলম্যাগটির ২৫তম সংখ্যা। আমি অত্যাশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম লিটলম্যাগটি ২০০৬ সাল থেকে নীরবে নিভৃতে প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ আপামর বাংলার লিটলম্যাগকর্মীরা এই লিটলম্যাগটির প্রতি যে প্রতিদান দিয়েছে তা কেবল এভাবেই বলা যায়, কন্সপিরেসি অব সাইলেন্স। কিন্তু এত কন্সপিরেসিও এর সম্পাদক সাম্য রাইয়ানকে দমাতে পারেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিন্দুর এ সংখ্যার পাতায় পাতায়। প্রথমেই বিন্দুস্বর (সম্পাদকীয় বক্তব্য) এর উল্লেখ করা উচিৎ। সম্পাদক লিখেছেন,

সাধুর শক্তি সততায়, কবির শক্তি কবিতায়। আরাধনার মতো সেই শক্তির বিকাশ ঘটাতে হয়। লেখাই লেখকের প্রধানতম একটিভিজম। লেখকজীবনের প্রধান কথা। আর সেই লেখাই আমাদের প্রধান আরাধ্য।
শিল্পক্ষেত্রে আমরা কর্পোরেট, ক্ষমতা (power) এর প্রভাবমুক্ত। দুর্বৃত্ত পুঁজির করাল গ্রাস থেকে, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত। কোনোরূপ চিন্তার দাসত্ব আমরা করি না। আমরা আমাদের মতো। আমাদের সাহিত্য— সে তো আমাদের মতোই, বুক টান টান সাহিত্য।


সম্পাদকীয় বক্তব্যে সম্পাদকের প্রজ্ঞা ও রেডিক্যাল মনোভঙ্গি ফুটে উঠেছে। বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যের ক্রিটিকের ক্রাইসিস প্রসঙ্গ করে সম্পাদক লিখেছেন,

সমকালীন বাঙলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা/সমালোচনা নেই বললেই চলে। সেই পরিবেশও নেই। অধিকাংশ লেখক আজ সমালোচনার সামনে দাঁড়াবার সাহস হারিয়েছেন; আর সমালোচক ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও লাভ-লোকসানের কাছে জিম্মি হয়েছেন। এই দুর্ভাগা অবস্থা থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে আসা যায়, ততোই মঙ্গল, সাহিত্যের।



শুধু তাই নয়। বিন্দুস্বর শেষ হচ্ছে চমকে ওঠা একটি বাক্য দিয়ে,

 

লিটল ম্যাগাজিন লেখককে নিয়ন্ত্রণ করে না, ধারণ করে।

 

এই একটি বাক্যই লিটল ম্যাগাজিনের টোট্যাল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, প্রতিবাদী চরিত্র বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। এটি হয়ে উঠা উচিৎ সমগ্র লিটল ম্যাগাজিনের মূল স্বর।

বিন্দুস্বর পাঠ করে আমি প্রস্তুত হলাম পুরো সংখ্যাটি পাঠ করতে। বিন্দুস্বরে ফুটে উঠেছে পত্রিকাটির মেজাজ। লিটলম্যাগটির সূচি শুরু হয়েছে পুনঃপাঠ বিভাগে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ছোটোগল্প ও রমানাথ রায়ের শাস্ত্রবিরোধী গল্প দিয়ে। এই বিভাগটি বর্তমান সময়ে খুব প্রয়োজন। নতুন পাঠককে রত্নভাণ্ডারের সাথে পরিচিত করানোর প্রয়োজনে। এরপর অভিজিৎ বসুর অনুবাদে নীলি চেরকোভস্কির সাক্ষাৎকার। চার্লস বুকৌস্কি যতটা পপুলার, তার বন্ধু কবি নীলি চেরকোভস্কি তা নন। কিন্তু তাঁর অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা থাকলেও আণ্ডাররেটেড একজন রাইটার তিনি। চার্লস বুকৌস্কির জীবনী লিখেছিলেন তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার পড়ে পারা বিশেষ আনন্দিত করেছে আমাকে। এছাড়া আরো বেশ কিছু অনুবাদ ছাপা হয়েছে এ সংখ্যায়। সাখাওয়াত টিপুর অনুবাদ করেছেন ওতো রেনে কাস্তেইয়োর কবিতা, মাহীন হক অনুবাদ করেছেন জাক প্রেভার ও পিয়ের রেভার্দির কবিতা, আদিবা নুসরাত অনুবাদ করেছেন জিভোর্গ এমিনের কবিতা। আমার বিশেষ ভাল লেগেছে সুশান্ত বর্মণের অনুবাদে আন্তন চেখভের অন্যরকম ছয়টি গল্প। আন্তন চেখভ আমার প্রিয় লেখক হওয়ায় তাঁর অনেক রচনাই আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো পাঠ করি। কিন্তু এই গল্পগুচ্ছ আগে পড়া হয়নি। কীভাবে এগুলো আড়ালে পড়ে গেছে এইই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছিলাম। এই গল্পের ফর্ম তার অপরাপর গল্পের মতো নয়, একদমই আলাদা ফর্মের। এরপর আছে প্রবন্ধ। প্রবন্ধ বিভাগে ‘গণমানুষের কবি’ ও ‘জনের প্রিয় যে জন’ শিরোনামে দুইটি প্রবন্ধ লিখেছেন আহমেদ মওদুদ, সদ্যপ্রয়াত প্রণম্য শঙ্খ ঘোষের কবিতার আলোচনা লিখেছেন চঞ্চল নাঈম, ‘কবিতায় নিরীক্ষা’ ও ‘কাব্য ভাবনা ~ (বিজ্ঞানমনস্ক কবি/ …)’ শিরোনামে দুইটি ছোট গদ্য লিখেছেন বাদল ধারা, শিল্প ও শিল্পীর আড়াল প্রসঙ্গে ‘সে এক আমার আড়াল’ শিরোনামে প্রবন্ধ লিখেছেন সব্যসাচী মজুমদার, আরেক প্রণম্য কবি কালীকৃষ্ণ গুহ'র কবিতার দীর্ঘ আলোচনা লিখেছেন ঋতো আহমেদ।

এরপর আছে বাংলাদেশ ও ভারতের নয়জন গল্পকারের গল্প। গল্প বিভাগের শুরুতে ‘ভিনিয়েট’ শিরোনামে ছোটোগল্প লিখেছেন মলয় রায়চৌধুরী, ‘চা-পিপাসা’ ও ‘যাদুকরী সোমরস’ শিরোনামে দুইটি ছোটোগল্প লিখেছেন নাভিল মানদার, এই গল্পদুটোকে ছোটোগল্প বলব নাকি কাব্যগল্প বলবো আমি নিশ্চিত না। ‘আমার ককটার চামড়া কিন্তু ছিলায়া দিতে হবে’ শিরোনামের পরাবাস্তব ছোটোগল্পটিতে একটি মোরগের আত্মকথা লিখেছেন অসীম নন্দন। একটি বৃক্ষের প্রতি গাঁয়ের এক বধূর প্রেমকাহিনী ফুটে উঠেছে জুলকারনাইন স্বপ্নের ‘গহীনের প্রেম’ গল্পে। বর্তমান সময়ের বৃক্ষনিধন কর্মকান্ডের প্রতিবাদ হিসেবে গল্পটি উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে ১৯৭৩ সালে ভারতের ‘চিপকো আন্দোলন’ এর কথা মনে পড়ে গেল ছোটোগল্পটি পাঠ করে। কেননা সেদিন নারীরা গাছ জড়িয়ে ধরে গাছ বাঁচিয়েছিলো, এই গল্পেও গাছের প্রতি অন্যরকম প্রেম ফুটে উঠেছে। ‘অলকানন্দা একটি বাড়ি’ শিরোনামে আরেকটি কাব্যগল্প লিখেছেন শাহ মাইদুল ইসলাম। করোনাকালীন সময়ে মানুষের একাকীত্ব, নির্মম নিঃসঙ্গতার নির্মম চিত্র ফুটে উঠেছে উপল বড়ুয়ার ‘চিকিৎসা’ ছোটোগল্পে। আমাদের বাসগৃহে দৃষ্টির অন্তরালে পড়ে থাকা পতঙ্গদের নিয়ে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মায়া’ ১ ও ২ শিরোনামে দুইটি ছোটোগল্প লিখেছেন অমিতা চক্রবর্ত্তী, ‘যাত্রানাস্তি’ শিরোনামে ছোটোগল্প লিখেছেন প্রমিথ রায়হান আর সবশেষে ছোটো ছোটো চারটি গল্প লিখেছেন রাজীব দত্ত। রাজীব দত্তকে আমি প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে চিনতাম, তিনি যে গল্পও লিখেন তা প্রথম জানলাম।

এরপর উল্লেখ করতে হয় মুক্তগদ্যের কথা। মুক্তগদ্য লিখেছেন মাহফুজুর রহমান লিংকন, সোমনাথ বেনিয়া, হোসাইন মাইকেল ও হিম ঋতব্রত। সবশেষে উল্লেখ করছি লিটলম্যাগের অনিবার্য বিভাগ কবিতার কথা। দুই বাংলার নতুন-পুরনো মিলিয়ে সুনির্বাচিত উনিশজন কবির কবিতা ছাপা হয়েছে এ সংখ্যায়। লিপিবদ্ধ কবিগণ হলেন ফেরদৌস লিপি, শামীম সৈকত, আরণ্যক টিটো, সাম্য রাইয়ান, সৈয়দ সাখাওয়াৎ, নাভিল মানদার, সাকিব শাকিল, তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়, তানজিন তামান্না, উদয়ন রাজীব, শিশির আজম, নুসরাত জাহান, সৌরভ দত্ত, শানু চৌধুরী, নাজমুস সাকিব রহমান, শুভ্র সরখেল, মনজুর কাদের, মোকলেছুর রহমান ও আশুতোষ বিশ্বাস। বিন্দুর কবিতা বিভাগটির বিশেষত্ব হলো এখানে দুই/একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে প্রত্যেক কবির একগুচ্ছ করে কবিতা ছাপা হয়েছে। এমনকি কারো পনের/কুড়ি/পঁচিশটি কবিতাও ছাপা হয়েছে।

সম্পূর্ণরূপে বিজ্ঞাপনহীন এ সংখ্যাটি সমাপ্ত হয়েছে রাশেদুন্নবী সবুজের কবিতার পাণ্ডুলিপি ‘আরো দূরের হেমন্তে’ প্রকাশ করে। লিটলম্যাগে পাণ্ডুলিপি প্রকাশ পুরনো বিষয় হলেও এটি আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষিত করে। রাশেদুন্নবী সবুজের কবিতা ইতোপূর্বে পাঠ করা হয়নি। তার কয়েকটি কবিতা অন্যরকম ভাল লাগলো, যেমন নামকবিতাটি, ক্ষুধার কোন ঘ্রাণ নেই, কিচ্ছু না, পাগলী, আমাদের বেজন্মা সময় ইত্যাদি। আর কিছু কবিতায় বিশেষ আলোর বিচ্ছ্যুরণ হিসেবে উজ্বল পংক্তিমালা রয়েছে। আরেকটু যত্ন নিলে কবি অনেকদূর যেতে পারবেন। খুবই সম্ভাবনাময় কবি রাশেদুন্নবী সবুজ।

বিন্দু নামের এই লিটল ম্যাগাজিনটি তার অভ্যন্তরে এত ম্যাগাজিন ধারণ করেছে তা বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই। লিটলম্যাগটির অধিকাংশ রচনাই ভবিষ্যতের লেখা। যার কারনে খুব সামান্য পাঠকই বিন্দুর ভাগ্যে জুটবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতের বিপুল পাঠক বিন্দু খুঁজে পড়বেন। পড়তেই হবে।


প্রকাশনা বিষয়ক তথ্য:

 
বিন্দু পত্রিকা
বর্ষ ১৬ । সংখ্যা ২৫ । মার্চ ২০২২
সম্পাদক: সাম্য রাইয়ান, প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
ফোন: 01783116260
বিনিময়: ১০০ টাকা
কুড়িগ্রাম, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ