সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত 'চাঁদের অমাবস্যা' প্রসঙ্গে মরিয়ম মেরিনা

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত 'চাঁদের অমাবস্যা' প্রসঙ্গে মরিয়ম মেরিনা



শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্না স্নাত রাতের একটি ভয়ংকর কাহিনী দিয়েই শুরু হয় "চাঁদের অমাবস্যা" উপন্যাসের সূচনা। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যুবক মাস্টার (আরেফ আলী), বছর দুই থেকে সে বড়বাড়িতে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকছে। এছাড়াও স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষক সে। বড়বাড়িতে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে দুবেলা পড়াতে হয় বাচ্চাদের।

শারীরিক প্রয়োজনে তাকে গভীর রাতে বাঁশ বাগানে যেতে হয়। আর সেখানেই সে আলো-আঁধারের মধ্যে দেখে এক যুবতীর মৃতদেহ। সে কতক্ষণ ধরে এই লাশ দেখেছিল সে কথা যুবক মাস্টার নিজেও জানে না। সে নিদারুণ ভয়ে বিকৃত মস্তিষ্কের মত দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটাছুটি করে। তারপর সে দেখতে পায় যুবতীর খুনিকে।

উপন্যাসটি দুইটি প্রধান চরিত্রদ্বারা কেন্দ্রীভুত। প্রধান চরিত্র আরেফ আলী (যুবক মাস্টার) ছাড়াও কাদের অন্যতম চরিত্র। বড়বাড়ির বড়কর্তা মনে করেন কাদের দরবেশ। তার চালচলন স্বাভাবিক তিনি মনে করেন না।

উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পারি যুবক মাস্টার এবং কাদেরের দেখা বাঁশ বাগানে আকস্মিক ভাবে। তাদেরকে এত রাতে বাহিরে দেখে যুবকের সন্দেহ হয়। তারপর শুরু হয় লেখক এর কলমে যুবক মাস্টারের ভাবনা। মাস্টারের দৈনিন্দন জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। উলটপালট হয়ে যায় তার প্রতিদিনের নিয়ম।  আর এই ভাবনা নিয়েই আগাতে থাকে উপন্যাস।

যুবক মাস্টার জানতে পারে যুবতীর খুনি কাদের। বড়সাহেবকে কীভাবে বলবে মাস্টার সে কথা, তার প্রতিক্রিয়া কি হবে, ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সঠিক বিচার হবে কিনা, আদৌ কি সবাই তার কথা বিশ্বাস করবে নাকি সত্য বলার পর নিজের বিপদ সে নিজেই ডেকে আনবে? এরকম নানান ভাবনার পর মাস্টার সাহেব একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। সে বড় সাহেবের কাছে যায় কিন্তু তাকে সবটা বলতে পারেনা। পরিশেষে থানার পুলিশকে জানিয়ে নিজের মনকে শান্ত করে।কিন্তু ফলাফল শূন্য। পুলিশ তাকে উন্মাদ-পাগল বলে। পুলিশ যুবক মাস্টারের দিকে আঙ্গুল তুলে তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে।

কিন্তু আদৌ কি সুবিচার হবে? কাদেরের মন যেমন অচেনা অজানা যুবতীর জন্য হাহাকার করে, তেমনি আমাদেরও মন আকুল হয় সেই যুবতীর কথা ভেবে।  

নিজস্ব ভাবনা

সৈয়দ অলিউল্লাহ "চাঁদের অমাবস্যা" বইটি পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক। প্রধান চরিত্র যুবক মাস্টার নিজের সাথে বসবাস করে। বাঁশবাগানে কাদেরের সঙ্গে তার হঠাৎ দেখা হলে উপন্যাসের অগ্রগতি শুরু। চেতনা প্রবাহ রীতিতে রচিত এই উপন্যাসে ঘটনা পরপর ঘটতে থাকে। মাস্টার সাহেবকে আমরা ভীতু প্রকৃতির বলতে পারি। তার সত্য বলার সৎ সাহসের বড়ই অভাব। সে কল্পনা আর বাস্তবতাকে এক করে ফেলে। আবার কখনো তাকে নিজস্ব স্বার্থ অর্থাৎ স্বার্থচিন্তা  করতেও দেখা যায়। সত্য প্রকাশের পর তার উপার্জনের পথ বন্ধ, তার বিধবা মা বোনের দায়িত্ব, তার থাকা-খাওয়া সব বন্ধের আশঙ্কা থেকে যায়। অবশ্য দরিদ্র মাস্টারের দারিদ্রতার কারণে এমন চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক।

অপরদিকে আরেক প্রধান চরিত্র কাদের। তাকে গ্রামবাসী দরবেশ মনে করে। যদিও মাস্টার সাহেব তাতে একমত নয়। যথেষ্ট সন্দেহ তার আছে। কাদের চরিত্রটি উপন্যাসে ব্যক্তি মতামত প্রকাশ কম করলেও তার কার্যক্রমকে ঘিরেই পুরো উপন্যাসটি। সে সুচতুর ব্যক্তি, তাকে হেনস্তা করা সহজ ছিল না, তার বড় বড় লোকের সঙ্গে ওঠাবসা। তাই সে অপরাধী হয়েও পার পেয়ে যায়।

দাদাসাহেব অর্থাৎ বড় বাড়ির বড়কর্তা। তিনি ধর্মে বিশ্বাসী এবং কঠিন নিয়মে তিনি তার ধর্ম পালন করেন। কাদের সম্পর্কে তার ছোট ভাই এবং তাদের বয়সের ব্যবধান ৩০। যুবক মাস্টার কাদেরের কৃতকর্ম বড় সাহেবের কাছে প্রকাশ করতে গিয়েও পারেনি। বড় সাহেবের মান -ইজ্জত, পারিবারিক গৌরব, অহংকার, ধুলিস্যাৎ হওয়ার ভয়ে। অতপর যুবক মাস্টার আইনের আশ্রয় নিলে যুবতী ন্যায় বিচার পায় না, এখানেই উপন্যাসের বড় ব্যর্থতা।

ভাষা শৈলী

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অসাধারণ এই উপন্যাসটিতে তার ভাষার দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। তার দখলে এত এত সুন্দর এবং এত বেশি মাধুর্যময় ভাষা যে তার ভাণ্ডারে উপস্থিত- তা উপন্যাস না পড়লে বোঝা যেত না। তার উপমার ভঙ্গিমা, তার ব্যবহৃত শব্দের অলংকার উপন্যাসটিকে বৈচিত্রপূর্ণ করেছে। এ উপন্যাস রচনাকালে তিনি বিদেশের মাটিতে ছিলেন কিন্তু এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এদেশের মাটির গন্ধ, নদী, মাঠ-ঘাট সবই যেন তার চোখে উপস্থিত।  

নামকরণের সার্থকতা

উপন্যাসটির নামের সার্থকতা বলতে গেলে শতভাগ হয়েছে।
উপন্যাসের শুরুতেই আলো আঁধারের একটা খেলা চলে। জোসনা রাতের বিদঘুটে রকম অন্ধকার বলয়ে এক যুবতীর অকাল মৃত্যু এবং আরেফ আলীর সত্য উন্মোচন। অমাবস্যা কাটিয়ে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ার মত একটা ব্যাপার যেন। যদিও অভিনব, তবে শৈল্পিক।

বইয়ের সূচনায় বেশ তথ্যবহুল আগ্রোহোদ্দীপক একটি ভূমিকা লিখেছেন অধ্যাপক ডক্টর জাহিদুল হাসান। কালো-সাদা মিশিয়ে যেন বইয়ের প্রচ্ছদটিকে চাঁদ রাতের অমাবস্যাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রচ্ছদ শিল্পী সজীব খান। বইটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯৬৪। আর 'শিক্ষা প্রচার' প্রকাশনী থেকে পুনরায় প্রকাশিত হয় আগষ্ট ২০১৮ তে। বইটির মলাট মূল্য দুইশত টাকা।



**********
চাঁদের অমাবস্যা
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ
 
প্রকাশনী: শিক্ষা প্রচার, ঢাকা।
প্রকাশকাল: আগস্ট ২০১৮
মূল্য: দুইশত টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ