কবি ধীমান ব্রহ্মচারীর 'শহর ও কবিয়াল' বইটি (প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ২৩) হাতে পাওয়ামাত্র এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। মাত্র ঊনচল্লিশ শব্দের কবিকৃত মুখবন্ধই বলে দেয় গ্রাম থেকে শহুরেযাপন, সরল থেকে পরিণত দৃষ্টিভঙ্গীর বিবর্তনকথা।
বইটিতে কবিতা সংখ্যা ঊনত্রিশ। 'ঊন'- মানেই '--- সমীপে', এখানেই শেষ নয়, আরো কিছু বাকি, পৌঁছতে হবে আরো---। সবে তো শুরু--- কবির কাছে পাঠকের প্রত্যাশা অনেক---।
বইটির অসাধারণ প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী দেবরাজ জানা।
প্রকাশক: এবং অধ্যায়, কলকাতা।
মুদ্রিত মূল্য: ১৫০.০০
প্রখ্যাত কবি, প্রাবন্ধিক অধ্যাপক মঞ্জুভাষ মিত্র তাঁর প্রিয় ছাত্রের কবিতার এই বইটির স্মরণযোগ্য স্বর্ণপঙক্তির কিছু উল্লেখ করেছেন, উদাত্ত কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে প্রশংসাসূচক কথামালা। পথচলতে আমাদেরই একাকী মনের যে অবিরাম ভাষা সময়ের সাথে সাথে উচ্চারিত হয়, যে অনুভূতি উদ্দীপনা আমাদের শিরায় শিরায় রক্তস্রোতে প্রবাহিত হয়, যে স্মৃতি অস্থিমজ্জায় মিশে থাকে, যে বেদনা অজান্তে আমাদের চোখে জল আনে, যে অনুভব নীরবতার কাছে গচ্ছিত রাখা হয়, পৌষের একঝলক রৌদ্রের মত যে সুখ উঁকি দিয়ে অপসৃত হয়--- সে সবই কাব্য হয়ে ফুটেছে কবির কলমে। কালো ডামাডোল পেরিয়ে আলোকবর্ষ পথ চলতে চলতে চারণগাথা সৃষ্টি করতে প্রয়াসী তিনি।
উনার কবিতার কিছু ভালোলাগা লাইন:
- শহর ও কবিয়াল: হয়তো এইপথেই হেঁটেছিল জীবনানন্দ--- অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি আর নয়তো কোনো কবিয়াল।
- শহরেরা: প্রতিদিন ওঠে বিবেক/ প্রতিদিন হারায় বিবেক/ গতি এখানে দূর্ণিবার...
- অস্তরাগ: দুজনের চোখ দিয়ে/ এখন আর গোধূলি দেখি না
- ১৩ই আষাঢ়, ১৩২১: বাবার প্রেসার নেমে চলে গেল পাহাড়ের নীচের শিকড়ে/ সেখানে একটাই ছোট্ট ঘর। বাবা থাকেন/ চা করে, জনতা জ্বেলে ডিম ভাজা করে......../খোরপোশের টাকাও মা পেয়েছিল যৎসামান্য।/...... আজ সে টাকার গন্ধটুকুও নেই মার হাতে/পরণে রয়েছে বাবার অপছন্দের সাদা থান, যেটা জড়িয়ে মা এখন বাবার ছবির সামনে বসে।
- এক শতাব্দী প্রাচীন পাঁচিল: বিষণ্ণতা খুবলে খুবলে কেউ বলেছিল,/ এখনো জয় হবে সুনিশ্চিত
- অরকুট: ঝোড়ো বাতাসে মাঝে মাঝে কথাগুলো কেটেও যাচ্ছে / কানেকশনের অভাবে
- ইচ্ছা: আমি বলতে চেয়েছিলাম যুদ্ধ শেষ হোক, নয়তো/ অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর দলে নাম লিখিয়ে লিখি একটা করে গান অথবা কবিতা
- আদিম পাপ: ক্লান্ত পায়ে জড়িয়ে ধরেছে ঘুম/ফুটপাথ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে উনুন আঁচে/রাতের আহার শেষে ধোয়া হাতের জল/ গড়িয়ে পড়ে /ম্যানহোলের গর্তে/শহর গহ্বরে লুকিয়ে থাকে/ আদিম পৃথিবীর পাপ।
- খোঁজ: থেকে থেকেই শুধু ভাবছি এভাবেই চোরা গলিটার সন্ধান পাব/অথচ
- বসন্তকালীন বিষুব: নামটিই একটি কবিতা। এক লাইনের কবিতা। সবটাই স্বর্গীয় সুন্দর।সুতরাং লাইনটা থাক--- অন্য কোনো পাঠকের জন্য।
- পচন: পলাশ ছিল আর ছিল ওর বান্ধবী মৌ/ লড়েছিল হয়তো ভালোবাসা পাবার জন্য/ ১৪ রাউন্ড গুলি ঝাঁঝরা করেছিল অস্থি কঙ্কাল.../ লাল-নীল-সবুজ-হলুদ সবাই ছিল
- বিলীন: বিপন্ন সভ্যতায়/দাঁড়িয়ে যেন পাচ্ছি ফিনোমেনার আশ্বাস.../ হয়তো নতুন করে/ প্রগতিবাদের জন্ম দিচ্ছি কোনো হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়ের/ মাথায় চড়ে---
- বারুদ: শুধু স্থবির হয়ে মানছি হট্টগোল [দুর্দান্ত এই লাইনটা--- আর সবটাই শ্লোগান]
- প্রতিবিম্ব: এদিকে এত কিছু/ অথচ ওদিক শুনশান/ বৃষ্টিভেজা শহর শুধু নিজের ছবি দেখে, নিজের বুকের ওপর।
- বসন্ত: গত বসন্ত কেড়ে নিয়েছে ওর সব।/ এ বসন্তের অপেক্ষায় ও পথ চেয়ে।/ নতুনটাকে গায়ে মেখে নিতে চায় ও।
- লুকোচুরি: কোনো সম্পর্ক যদি দুটো নারী পুরুষের শুধু মায়ার ফাঁদেই/ মৃত্যুবরণ করে কালের নিয়মে? তাহলে কিভাবে লেখা হবে ইতিহাস---
- বারুদ-২: হিসেব ছিল সাহসী চোখের,/...../ শহরের কোনো এক কোণে নিঃশব্দে আততায়ী রেখে যেত বারুদ।
- মৃত্যু উপত্যকা: মাত্র ১৬টি শব্দে তিন লাইনে কবিতা, পুরোটাই ভাবায়।
- শহরের এক শীতকালীন রাতে: ২২টি শব্দের কবিতা--- এ শহরের বুকে আছে ইতিহাসের সাদাকালো রং/...../ জীবন এখানে উদ্বাস্তু নামে পরিচিত
- রাজনীতি: বিরাট শহরের ফুটপাথ ধরে হাঁটি আমি,/আমার সাথে আমার অস্তিত্ব,/অন্ধকার সরে যায় সময়ের বাঁকে
- অস্তিত্ব: নিস্তব্ধতারা নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে/ তাদের বেঁচে থাকা...
- রক্তক্ষরণ: এরা সবাই জানে কীভাবে আকাশ ছুঁতে হয়/জানে কীভাবে বুক চিরে মানুষের কলিজা তুলে বার করতে হয়।
- এখন সময়: আমাদের যাত্রা শেষ হয়নি এখনও
- এখানে মানুষ লড়াই করে জীবন দিয়ে: শ্রম চুরি করবে ভেবেছিল যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে/ তারা আজ শ্রমের জাঁতায় পিষে মরছে মুহূর্তের পর মুহূর্ত,
- এক থাকার গান: প্রতিদিন ক্ষয় হতে হতে সমাজের মূর্ততা তুলে রাখি আত্মমগ্নতায়
- অসহিষ্ণু: সময় নিশ্চিন্তে অসহিষ্ণুতার লাইনে কাটে সবার টিকিট।
- এক চিলতে রোদ: এখন আর কেউ কারো খোঁজ নিতে আসে না,/ শুনশান বারান্দায় শুধুমাত্র এক চিলতে রোদ/ আজও উঁকি মেরে যায়।
- নির্বাক: শুধু সময়ের সাথে কথা বলি,
- একটি রাজনৈতিক আচরণ: সভ্যতার লাশ মাড়িয়ে চলছে আমার সত্তা
বইটিতে মুদ্রণভ্রম কিছু আছে, আশা করি পরবর্তী সংস্করণে কবি ও প্রকাশক সেটা দেখবেন।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম