সিদ্ধার্থ । হেরমান হেস । বুক রিভিউ: অন্তর চন্দ্র

সিদ্ধার্থ । হেরমান হেস । বুক রিভিউ: অন্তর চন্দ্র


লেখক পরিচিতি:


১৮৭৭ সালের ২ জুলাই দক্ষিণ জার্মানির ছোটশহর উইটেম্বার্গের কালভ এ হেরমান হেসের জন্ম ।‌ বাবা জোহান্স হেস। পাদরি ছিলেন। পরে, কালভ পাবলিশিং সার্ভিস -এর পরিচালক। মা নী গুনডার্ট। হেসের নানা হেরম্যান গুনডার্ট সেকালের বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও পণ্ডিত ছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য হেরমান হেস ১৯৪৬ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ, ইন মেমোরিয়ান, নিউ পয়েমস, দি লেমবয়, দি জার্নি টু নুরেম্বার্গ, দি ইন‌ওয়ার্ড ওয়ে ইত্যাদি। ১৯৬২ সালে ৮ আগষ্ট হেস মস্টাগনোলায় পরলোকগমন করেন।


নোবেলজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেস -এর লেখা "সিদ্ধার্থ" উপন্যাসটি একজন মানুষের স্ব চেষ্টায় এগিয়ে চলার প্রেরণা। এখানে গৌতম বুদ্ধ এবং সিদ্ধার্থ ভিন্ন ব্যক্তি। গ্রন্থটি রচিত হয়েছে এক জ্ঞানপিপাসু মানুষের আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে ‌। যে মানুষটি সবসময় জ্ঞানের পিছনে ছুটেছেন। কার‌ও অবলম্বন নিয়ে বাঁচার কথা কখনো ভাবেনি। তিনি পৃথিবীর সবকিছুকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলেন।‌ বুদ্ধের মহানুভবতাকে শ্রদ্ধা  করে, স্ব ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চলতে থাকেন। গণিকার প্রেমে মশগুল হয়ে, ব্যবসা, জুয়া, পাশা, দাবা ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করেন। সন্ন্যাসী থেকে সংসারী এক যুবকের জীবন যুদ্ধের কথা উঠে এসেছে এই গ্রন্থের পাঠে। অহং থেকে ওম্ এ মিশে যাওয়ার তাগাদা উঠে এসেছে। ভালোবাসা মতো ভালোবাসার কথা উঠে এসেছে। ধর্মের বন্ধনে বাঁধা না পড়ে প্রকৃতির কাছে পাঠ নিয়ে হয়ে উঠেছেন জ্ঞানপিপাসু। প্রকৃতিকে গুরু করে যুবককের জীবনের সারাৎসার।


মূলকাহিনী:


এ গ্রন্থের নায়ক সিদ্ধার্থ দেহমনে সন্ন্যাসী। ব্রাহ্মণ পুত্র। ছোটবেলায় বন্ধু গোবিন্দ এবং সিদ্ধার্থ সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য চলে যান। এদিকে পিতার মনে চলে পুত্র হারার অসহ্য যন্ত্রণা।‌ ওম্ বাক্য উচ্চারণ করতে করতে জ্ঞানপিপাসু সিদ্ধার্থ চলতে থাকেন লক্ষ্যের দিকে। নির্বাণ লাভ করতে হবে। সিদ্ধার্থ বুঝতে পারেন, জ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু হল পণ্ডিত ব্যাক্তি এবং পাণ্ডিত্য।

দুই নবীন সন্ন্যাসী শ্রাবন্তী নগরীতে মহাজ্ঞানী গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ লাভ করেন। বন্ধু, গোবিন্দ বুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে শিষ্যত্ব লাভ করেন এবং সেখানেই থেকে যান। কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজ চেষ্টায় এগিয়ে যাওয়া সংকল্প করে। গৌতম বুদ্ধের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করে ছুটে চলেন জ্ঞানলাভের তৃষ্ণায় । সিদ্ধার্থ পরালম্বনকারী হতে চান না। তাঁর মনে চলে অহং থেকে মুক্তি পাওয়ার যন্ত্রণা। গৌতম বুদ্ধের উপদেশ পেতে সবাই যখন বুদ্ধের স্মরণাপন্ন হন। তখন সিদ্ধার্থ খুঁজে বেরার নিজের ভিতরের সিদ্ধার্থকে আত্মা এবং পরমাত্মার মিলনক্ষেত্র।
 
প্রেমের পাঠ নিলেন কমলার কাছে। কমলা গণিকাবৃত্তি করে চলে। কমলার রূপের কাছে সিদ্ধার্থ মূর্ছা গেলেন। ঠোঁটের কাছে ঠোঁট রাখলেন। প্রথম কোন মেয়ের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন, সিদ্ধার্থ।‌ সন্ন্যাসী থেকে সংসারী হয়ে গেলেন। কামস্বামীর কাছে ব্যবসা শিখলেন। যত সব পাপ কার্যে লিপ্ত হতে লাগলেন কিন্তু মনে তখনো গেঁথে আছে সন্ন্যাসের লোলুপ দৃষ্টি। সংসারী না হয়েও সংসারের জ্বালায় দগ্ধ হচ্ছেন, সিদ্ধার্থ। মাছ, মাংস, সুরা সবকিছু খাদ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। দাবা ও পাশা খেলা শিখেছেন। কিন্তু সংসার ছেড়ে হঠাৎ করেই একদিন কমলার উদ্যান থেকে অনেকদূরে নদীর তীরে চলে যান। এদিকে কমলার গর্ভে তাঁর সন্তান। সিদ্ধার্থ কিছুই জানেন না।

বাসুদেব পাটনীর নৌকায় খেয়া দেন সিদ্ধার্থ। এখন সে নতুন বন্ধু খুঁজে পেয়েছে। শহুরে জীবন ত্যাগ করে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। এভাবে অনেকদিন চলে যায়।  গৌতম বুদ্ধ এবার মহাপ্রয়াণের পথে চলেছেন, নির্বাণ লাভ করবেন। শ্রমণরা ছুটে চলছেন, একবার হলেও বুদ্ধের শেষ দেখা দেখবেন। কমলাও বুদ্ধের সাথে দেখা করার জন্য নদীর তীরে আসলেন কিন্তু সর্প দংশনে তার মৃত্যু হয়। সন্তান রেখে যান সিদ্ধার্থের কাছে। শহুরে জীবনে থেকে দুঃখের জীবনে ফিরতে চান না তার সন্তান। একদিন কাউকে না বলে হঠাৎ চলে গেলেন পিতাকে ছেড়ে, সিদ্ধার্থ বুঝতে পারল প্রথম যৌবনে তিনিও তার পিতাকে ছেড়ে সন্ন্যাস ব্রত নিয়েছিলেন।

গোবিন্দের দেখা হলো শেষ জীবনে সিদ্ধার্থের সাথে। গোবিন্দ বুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অনেক শিখছে কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজ প্রচেষ্টায় গোবিন্দের চেয়ে অনেক বেশি শিখেছেন। তাই গোবিন্দ বলেছিল, বুদ্ধদেব শিখিয়েছেন দয়া, ক্ষমা, করুণা ও ধৈর্য্য _ কিন্তু শেখাননি প্রেম।‌ তাই সিদ্ধার্থের কাছে মাথা নত করতে হয়েছিল গোবিন্দকে।


উপসংহার


পুরো গল্পের শেষে মনে হয়েছিল, নিজের জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখলাম। মানুষ যখন স্বার্থের পিছে ছুটছেন। অট্টালিকার পর অট্টালিকা দিচ্ছেন। তখন সিদ্ধার্থের সরল যাপনের কথা মনে পড়ে যায়। সুখ কিংবা দুঃখ আমাদের কিছুই দেয় না বরং এগুলোকে মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে হয়। প্রকৃতির কোলে কান রেখে শুনতে হয় জীবনের সারাৎসার। সিদ্ধার্থ যখন নৌকায় যাত্রি পারাপার করে, তখন আমার মনে হয়, জীবন যুদ্ধের নিয়ত পাঠ নিচ্ছি। সংসারে সং সেজে নয় বরং প্রত্যেকটি বিষয় থেকে শিক্ষা গ্ৰহণের মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। কোথাও কেউ আপন নয় অথচ সকলকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সিদ্ধির পথ খুঁজতে হয়। মনে হয়, পৃথিবীতে আমি কোন ছুটন্ত এক প্রাণী, ছুটে চলি সিদ্ধার্থের মত জীবনের সারাৎসার খুঁজে।


**********
সিদ্ধার্থ
হেরমান হেস

অনুবাদ: জাফর আলম

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ: পৌষ ১৪০৮। জানুয়ারি ২০০২
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য : দুইশত নব্ব‌ই টাকা মাত্র
ISBN - 984-18-0064-X

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ