দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য - মোজাফ্‌ফর হোসেন

দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য - মোজাফ্‌ফর হোসেন

বাংলা সাহিত্যের আলোচনা সমালোচনায় সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ ’ডায়াসপোরা সাহিত্য’। ইংরেজি ভাষায় বিষয়টি নিয়ে একাডেমিক পর্যায়ে পঠন-পাঠন শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও প্রসঙ্গটি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা পর্যন্ত হয়ে গেছে। সাহিত্যের পাশাপাশি ডায়াসপোরা থিয়েটার, চলচ্চিত্র, চিত্রকলাও আলোচ্য হিসেবে স্বীকৃত। তবে সাধারণ্যে ‘ডায়াসপোরা সাহিত্য’ শব্দযুগল এখনও খুব একটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি। এর কারণ মূলত পর্যাপ্ত আলোচনা ও বইপত্রের অভাব। সাহিত্যতত্ত্বের এই আধুনিকতম ধারাটি নিয়ে বাংলাভাষায় আলোচনা শুরু করেন মোজাফ্‌ফর হোসেন। তিনি বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায় ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে কয়েকটি রচনা প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাভাষী পাঠকসমাজে বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ তৈরী হয়। এবার কৌতুহলী পাঠকদের জন্য বইয়ের অভাব দূর করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। রচনা করেন তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ বই ‘দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য’। পরিচিতিমূলক শব্দ হিসেবে লেখা রয়েছে ইতিহাস, তত্ত্ব, সংকটসম্ভাবনা।  আরও তথ্যের জন্য লেখকের ‘ভূমিকা’ থেকে কয়েকটি বাক্য পাঠ করা যেতে পারে।


সম্ভবত এটিই ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় প্রথম গ্রন্থ। … আমি নিজের মত করে ডায়াসপোরা সাহিত্যকে যেভাবে বুঝেছি, সেটি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ফলে সবসময় স্বীকৃত তাত্ত্বিকদের সঙ্গে আমার মতের মিল ঘটেনি।…ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্বের আলোকে একক কোনো লেখককে পাঠ করা বর্তমান গ্রন্থের উদ্দেশ্য নয়।… আমার মূল উদ্দেশ্য, পাঠককে একক কোনো লেখক সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়া নয়, বরং ডায়াসপোরা বিষয়টি এবং এর সঙ্গে ডায়াসপোরা সাহিত্যের পাঠ তুলে ধরা। অর্থাৎ গ্রন্থটি ‘ডায়াসপোরা রিডার’ বা ডায়াসপোরার প্রাথমিক পাঠ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। স্বল্প পরিসরে ডায়াসপোরার সম্ভাব্য অনেক বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।… এখানে ডায়াসপোরা তাত্ত্বিকদের মতামতের সাক্ষাৎ যেমন পাঠক পাবেন, সেই সঙ্গে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির বিষয়টিও তাঁরা জানতে পারবেন।


যে কোন ভাষায় কোন নতুন বিষয়ের প্রথম বই হিসেবে যেসব উপাদান থাকা দরকার তার সবকিছু রয়েছে আলোচ্য বইতে। ইতিহাস দিয়ে শুরু করেছেন। একে একে সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করে দেশ বিদেশের ডায়াসপোরা সাহিত্য আলোচনা করেছেন। বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও কয়েকজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ডায়াসপোরা লেখকের একটি আড্ডার সংযোজনের মাধ্যমে তত্ত্বের দার্শনিক দিককে আরও স্পষ্টতর করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যমে ডায়াসপোরিক সমস্যা, প্রাপ্তি, আনন্দ, হতাশার প্রকাশ ঘটেছে। বইয়ের সূচিপত্রের দিকে তাকালে প্রসঙ্গের ব্যাপকতা অনুধাবন করা যায়।

বইয়ের রচনাগুলোকে কয়েকটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।

  • ইতিহাস পর্ব
  • ডায়াসপোরা সাহিত্য ও তত্ত্ব
  • বাংলাদেশ পর্ব
  • ভারত-পর্ব
  • পাকিস্তান-পর্ব
  • সাক্ষাৎকার পর্ব
  • দক্ষিণ এশিয়ার ৫ তরুণ ডায়াসপোরা লেখকের আড্ডা (অনুবাদ)
  • তথ্যসূত্র


বইয়ের শেষে সংযুক্ত তথ্যসূত্রটি বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। রয়েছে ষোলটি বিষয় সংশ্লিষ্ট বই-পত্রিকার নাম। রয়েছে চব্বিশটি নিবন্ধের উল্লেখ। ফলে উৎসাহী পাঠকের অধিক পঠনতৃষ্ণা সহজে নিবৃত্ত হবে।

ইতিহাস পর্বে যে রচনাগুলো রয়েছে সেগুলোর শিরোনাম হল

  • ক) ডায়াসপোরা কী?
  • খ) ‘ডায়াসপোরা’র বাংলা প্রতিশব্দ কেন ‘অভিবাসী’ বা ‘প্রবাসী’ নয়?
  • গ) শরণার্থী, প্রবাসী, অভিবাসী এবং ডায়াসপোরার মধ্যে পার্থক্য
  • ঘ) দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরার প্রকারভেদ
  • অ) উপনিবেশ-পূর্ব ডায়াসপোরা
  • আ) ঔপনিবেশিক বা মধ্যযুগীয় ডায়াসপোরা
  • ই) উপনিবেশ-উত্তর বা আধুনিক ডায়াসপোরা


প্রথম রচনাতেই লেখক ডায়াসপোরা শব্দের অর্থকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন-


ডায়াসপোরা শব্দটি গ্রিক। `dia’ মানে দূরে, `speirein’ অর্থ ছড়িয়ে পড়া। পৃষ্ঠা- ১৫

‘ডায়াসপোরা’ শব্দটিকে বলা যায় ‘জাতীয়তাবাদ উত্তর কাল’
‘ইতিহাস পর্ব’ থেকে জানা যায় বুৎপত্তিগতভাবে ডায়াসপোরা শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ‘ফসলের বীজের দূরে ছড়িয়ে পড়া’। মানুষের জন্য শব্দটির ব্যবহার প্রথম পাওয়া যায় ২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে অনুবাদরত পণ্ডিতেরা গৃহহীন ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের জন্য ক্রিয়া হিসেবে `diaspeirein’ এবং বিশেষ্য হিসেবে `diaspora’ শব্দ ব্যবহার শুরু করেন। জন্মভূমি থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার ফলে স্মৃতিতাড়িত মানুষের হৃদয়ে যে আধ্যাত্মিক ও মানসিক কষ্টের জন্ম হয়—সেই বিশেষ অনুভূতির জন্য এই শব্দের ব্যবহার স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশান্তরিত মানুষদের জন্য এই শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে শুধু বহিষ্কৃত বা বিতাড়িত নয়, স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হওয়া মানুষদেরও ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে মনে করা হয়।


বইয়ের আলোচিত প্রসঙ্গকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘ডায়াসপোরা সাহিত্য ও তত্ত্ব’ পর্বে। তিনটি প্রবন্ধের মাধ্যমে লেখক ডায়াসপোরা তত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন। তিনি ‘ডায়াসপোরা সাহিত্য কী?’ শিরোনামের আলোচনা শুরু করেছেন প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে। প্রথম বাক্যে লিখেছেন-


ডায়াসপোরা পরিস্থিতিতে বাস করছেন, অর্থাৎ কোনো কারণে নির্বাসনে থেকে বা জীবিকার অন্বেষণে নিজ দেশ ছেড়ে ভিনদেশে বাস করছেন, এমন পরিস্থিতিতে কোনো লেখক যে সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করেন সেটি ডায়াসপোরা সাহিত্য। পৃষ্ঠা- ২৪


পূর্ববর্তী পর্বের উপশিরোনাম ‘অভিবাসী বা Migrant কারা’ অংশে জানা যায় সন্তানের জন্ম অভিবাসী বাবা-মায়ের যে কোন একজনের দেশে বা তৃতীয় কোন দেশে হলে তাকে ডায়াসপোরিক বলা যায়। তিনি প্রবাসী নন আবার অভিবাসীও নন। মাতৃ বা পিতৃভূমিকে সাহিত্যরচনার প্রসঙ্গ করে তুললে, স্মৃতিপ্রবাহে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পেলে সেই রচনা হবে ‘ডায়াসপোরিক সাহিত্য’। আর তিনি হবেন ‘ডায়াসপোরা লেখক’

লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মণিকা আলীর উদাহরণ টেনে লেখক জানান—


উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, মণিকা আলী বাংলাদেশি প্রবাসী বা অভিবাসী লেখক নন। তিনি বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখক। পৃষ্ঠা- ১৮


বিষয় হিসেবে লেখার প্রসঙ্গ এখানে মূখ্য বিবেচ্য। এ বিষয়ের আলোচনা রয়েছে ‘ডায়াসপোরা সাহিত্য কী’ অংশে। একজন ডায়াসপোরা লেখক তার রচনার বিষয় হিসেবে যে কোন উপাদান গ্রহণ করতে পারেন। এই সব বিচিত্র বিষয়ক লেখা ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্বে স্থান পাবে কীনা? মোজাফ্‌ফর হোসেন একটি বেশ যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন।


যদি তিনি অভিবাসী  জীবনের সংকট ও পিতৃ-মাতৃভূমির প্রতি যে নষ্টালজিয়া এবং ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের জন্য হাহাকার কিংবা আগন্তুক হিসেবে নতুন জীবনের কথা উপজীব্য করে কিছু না লেখেন সেটি ডায়াসপোরা সাহিত্য হবে কিনা? এক অর্থে হবে আবার আরেক অর্থে হবে না। পৃ- ২৪

লেখকের আলোচনাতে এই ধাঁধাঁর সূত্র মেলে। জানা যায় ডায়াসপোরা সাহিত্যের অন্যতম দুই প্রকার হল ‘প্রত্যক্ষ ডায়াসপোরা সাহিত্য’‘পরোক্ষ ডায়াসপোরা সাহিত্য’। কারণ ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্ব নির্দিষ্ট কিছু প্রসঙ্গকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। সেগুলো হল—

গৃহত্যাগ করা, নিজ বাসভূমের জন্য স্মৃতিকাতর হয়ে পড়া, নতুন ভূমিতে একাকিত্ব বোধ করা, সমঝোতা করা, নতুনভাবে নিজের আত্মপরিচয় নির্মাণ করা, দুই দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভেতর আটকে পড়া; প্রভৃতি। পৃ- ২৫


সাহিত্যে এইসব বিষয়ের প্রতি মনোযোগ লেখক, সমালোচক উভয়ের জন্যই নতুন। ইতিহাস অংশে জানা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মানুষের অন্তর্বেদনাকে চিহ্নিত করতে ‘ডায়াসপোরা’ শব্দটির ব্যবহার নতুন করে শুরু হয়। বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সামাজিক সংকটের অন্যতম একটি রূপ। অপেক্ষাকৃত আধুনিক মানসিক দ্বন্দ্ব হবার কারণে ‘ডায়াসপোরা’ শব্দটিকে বলা যায় ‘জাতীয়তাবাদ উত্তর (post-nationalism) কাল’

প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে আরও বেশ কিছু নতুন ধারণা, নতুন শব্দবন্ধ। মোজাফ্‌ফর হোসেনের ভাষ্যে জানা যায়, ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যতাত্ত্বিক বিজয় মিশ্র তাঁর ‘দি লিটারেচার অব ইন্ডিয়ান ডায়াসপোরা: থিওরাইজিং দ্য ডায়াসপোরিক ইমাজিনারি’ গ্রন্থে বলেছেন-

সকল ডায়াসপোরা মানুষ অসুখী, তবে প্রত্যেকে তাদের নিজেদের মতো করে অসুখী। ডায়াসপোরা বলতে তাদের বোঝায়, যারা তাদের পাসপোর্টে অন্বয় সাধিত (Non-hyphenated) আত্মপরিচিতি নিয়ে সন্তুষ্ট না। পৃষ্ঠা: ২৮


ইন্দোফিজিয়ান কবি সুদেশ মিশ্র ডায়াসপোরা সাহিত্যের আলাপ প্রসঙ্গে ‘গৃহ’ ধারণাটির বিনির্মাণ করতে বলেন। তিনি ডায়াসপোরা সাহিত্যকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। অবস্থানগত এবং তাত্ত্বিকভাবে। প্রত্যেকটিকে আবার দুটি করে ভাগে বিভক্ত করেছেন।

ভৌগলিক গৃহ আর মানসিক গৃহ দ্বন্দ্বে মানুষ নিরন্তর তাড়িত হতে থাকে। মোজাফ্‌ফর হোসেন লিখেছেন

 ছবির ফ্রেমে বা স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে আত্মপরিচয় নির্মাণ করা যায় না। বরং সেটা আরও বায়বীয় হয়ে ওঠে। তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক রুশ লেখক সভেতলানা বউম যে কারণে বলছেন, ডায়াসপোরা সাহিত্যে হারানো গৃহের প্রতি স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে একজন লেখক তাঁর ক্ষয়িষ্ণু আত্মপরিচয় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। একই কথা নাইপলও বলছেন তাঁর ‘এ ওয়ে ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ উপন্যাসে। পৃষ্ঠা- ৩১


‘কমনওয়েলথ সাহিত্য কি ডায়াসপোরা সাহিত্য?’ শিরোনামের আলোচনায় প্রশ্নটিকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কমনওয়েলথ সাহিত্যের পর্যায়ে কোন জাতীয় লেখাগুলো স্থান পাবে, সে লেখাগুলোকে ডায়াসপোরিক সাহিত্য হতে হলে কী কী উপাদান থাকা অতীব প্রয়োজনীয় সে বিষয়ে লেখক যৌক্তিক মত দিয়েছেন।

বাংলাদেশ পর্বের সূচনাতে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সাহিত্যকে তিনভাগে ভাগ করার কথা বলা হলেও আলোচিত হয়েছে দুইটি ভাগ।

  • ১) বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন ডায়াসপোরা সাহিত্য
  • ও ২) বাংলাদেশি বিদেশী ডায়াসপোরা সাহিত্য


বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন ডায়াসপোরা সাহিত্য ভাগে তিনটি অবস্থান থেকে বাংলাভাষায় ডায়াসপোরা সাহিত্যের খোঁজ করা হয়েছে।

  • ক) দেশভাগোত্তর ডায়াসপোরা সাহিত্য
  • খ) বাংলাদেশে বিহারি ডায়াসপোরা
  • গ) বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা


বাংলাদেশি বিদেশি ডায়াসপোরা সাহিত্য অংশে দুইটি অবস্থানের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে।

  • ক) বাংলা ভাষায় রচিত ডায়াসপোরা সাহিত্য
  • খ) ইংরেজি ভাষায় রচিত ডায়াসপোরা সাহিত্য


‘dia’ মানে দূরে, ‘speirein’ অর্থ ছড়িয়ে পড়া।
সঙ্গত কারণে বাংলাভাষায় এবং বাংলাদেশী বংশদ্ভূত লেখকগণের প্রসঙ্গ হওয়ায় এই অংশের প্রতি বাঙালি পাঠক অধিক আগ্রহী হবে। মোজাফ্‌ফর হোসেন পাঠকদের কৌতুহলকে নিবৃত্ত করার চেষ্টায় ত্রুটি রাখেননি। স্বল্প পরিসরে অসংখ্য বাঙালী লেখকের কথা উল্লেখ করেছেন। দুটি প্রবন্ধে বাংলাদেশে বাসকারী বিহারী ও রোহিঙ্গা লেখকদের প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। এই দুই অংশের আলোচনায় লেখক সংখ্যা বাংলা ভাষার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় রচনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। বাংলাসাহিত্যে দেশভাগের অভিঘাত প্রসঙ্গে মোজাফ্‌ফর হোসেন লিখেছেন-


দেশভাগের ফলে যদি দেশবদলের ঘটনাটি না ঘটত তবে বাংলা সাহিত্যে গৃহহীন হওয়ার অভিঘাত নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতার স্বাদ’, অমরেন্দ্র ঘোষের ‘ভাঙছে শুধু ভাঙছে’, রমেশচন্দ্র সেনের ‘পূর্ব থেকে পশ্চিমে’, নারায়ণ সান্যালের ‘বকুলতলা ক্যাম্প’, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়া পাতার নৌকা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্জুন’ ও ‘পূর্ব-পশ্চিম’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের গড় শ্রীখণ্ড’, জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ এবং বাংলাদেশ থেকে সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা’, হাসান আজিজুল হকের ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নদী কারো নয়’, রাজিয়া খানের ‘বটতলার উপন্যাস’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ক্ষুধা ও আশা’, শওকত আলীর ‘ওয়ারিশ’, রিজিয়া রহমানের ‘নদী নিরবধি’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘দুই নগর’-এর মতো দুর্দান্ত সব উপন্যাসের জন্ম হতো না। পৃষ্ঠা: ৩৫-৩৬


ভারত পর্বে উল্লেখ করেছেন আঠারোজন লেখকের সংক্ষিপ্ত সাহিত্যিক পরিচিতি। এদের মধ্যে রয়েছেন ভি এস নাইপল, সালমান রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, ঝুম্পা লাহিড়ী, কেতরী কুশারী ডাইসন, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, অরুন্ধতী রায় প্রমুখ। নাইপল সম্পর্কে লেখক বলেন-

নাইপল তাঁর ত্রিনিদাদে বেড়ে ওঠার দিনগুলো নিয়ে যেমন গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, তেমনি ভারতীয় প্রেক্ষাপটও চলে এসেছে তাঁর লেখায়। ডাবল ডায়াসপোরার কারণে তাঁর জন্য বিষয়টা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। যে কারণে তিনি লেখালেখিতে উপনিবেশ ও নির্বাসন থেকে বের হতে পারেননি। পৃষ্ঠা: ৮৪


সালমান রূশদী প্রসঙ্গে লেখেন-

রুশদি ঔপনিবেশিক শক্তির দৃশ্যত কেন্দ্রগত ধারণা ভেঙে দিলেন তাঁর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাসে। ইউরোপীয় উপন্যাসের কাঠামো তিনি ভেঙে দিলেন এখানে। চিন্তার জায়গা থেকে আইডেনটিটি পলিটিক্সের বিষয়টি নতুনভাবে দাঁড় করালেন।  পৃষ্ঠা: ৮৬


মোজাফ্‌ফর হোসেন পাকিস্তান পর্বে পনেরো জন লেখকের সাহিত্য আলোচনা করেছেন। শুরু করেন খ্যাতনামা পাকিস্তানি ডায়াসপোরা কবি ও কথাশিল্পী জুলফিকার ঘোষ (Zulfikar ghose) দিয়ে। তিনি লিখেছেন জুলফিকার ঘোষ নিজেকে ‘native alien’ বলে মনে করেন। অর্থাৎ নিজগৃহে বহিরাগত কোন একজন। তিনি আরও লিখেছেন-

জুলফিকার ঘোষের সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা, ফ্যান্টাসি, পরাবাস্তবতা এসব আছে। জুলফিকার ঘোষ অবিভক্ত ভারত থেকে ইংল্যান্ডে চলে যান। এরপর যখন ফিরে আসেন জন্মস্থানে, তখন সেটি আলাদা রাষ্ট্র। তিনি অবিভক্ত ভারতের মানুষ হিসেবে বিভক্ত ভারতবর্ষে নিজের জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে নিজেকে ‘আগন্তুক’ বোধ করতে থাকেন। পৃষ্ঠা: ১০১


ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক, আমেরিকার খ্যাতনামা সাহিত্যসমালোচক সারা সুলেরি সম্পর্কে তিনি লিখেন-

কুরেইশির মতো সুলেরির জন্য ‘গৃহ’ শব্দটার কোনো সরল ব্যাখ্যা নেই। সুলেরিরও মা ব্রিটিশ, বাবা পাকিস্তানি। ফলে দুটি দেশই যেমন তাঁদের নিজেদের; আবার দুটি দেশেই তাঁরা আগন্তুকের মতো। পৃষ্ঠা: ১০২


সূচিপত্রে পাকিস্তান পর্বের পরে বিবিধ বিষয় নিয়ে সাতটি মূল্যবান নিবন্ধ রয়েছে। রচনাগুলির চারিত্র্য তাদের শিরোনামেই স্পষ্ট। ‘তাহমিমা আনাম ও তাঁর ‘গার্মেন্টস’ গল্প ধরে সৃষ্ট বিতর্ক’ প্রবন্ধের উপসংহারে লেখা কয়েকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোজাফ্‌ফর হোসেন লিখেছেন-

… বিদেশে কোনো কিছু প্রশংসিত বলেই যে সেটি মহৎশিল্পের আসনে বসে গেল এই ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বের হতে হবে আমাদেরও। তার চেয়ে বড়ো কথা কারও বিদেশে কোন অর্জনের পেছনে ‘কারণ’ অনুসন্ধান করার আগে আমাদের অভিনন্দন জানাতে শিখতে হবে। পৃষ্ঠা: ১৩৪


‘অজিক চৌধুরী এবং বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সাহিত্য’ রচনায় উপস্থাপিত মন্তব্য যথাযথ।

দেখা যায়, অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ীদের আমরা যেভাবে চিনি বা জানি বাংলাদেশি ডায়াসপোরা লেখকদের আমরা সেভাবে চিনি না। দেশের প্রথমসারির মিডিয়াও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তাঁদের বইয়ের রিভিউ, অনুবাদ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। আমরা তাঁদের জানতে চাই, তাঁদের পড়তে চাই।  পৃষ্ঠা: ১৩৬


ছয়জন ডায়াসপোরিক লেখকের সাক্ষাৎকার রয়েছে ‘সাক্ষাৎকার পর্বে’। লেখকগণ না দেখা পূর্বপুরুষের ভিটে, তার স্মৃতি, গৃহবোধ, অভিজ্ঞতা, নতুন সংস্কৃতির সাথে টানাপোড়েন, অভিযোজন, অঙ্গীভূত হওয়া প্রভৃতি বিষয়ে খোলাখুলিভাবে নিজেদের মতামত দিয়েছেন। তাদের ব্যক্তিগত উপলব্ধির বৈচিত্র পাঠককে চিন্তাকাতর করে তুলবে।
 শামীম আজাদ বলেছেন

চেতনার দিক থেকে আমি ‘স্মৃতিকাতর’ নই, ‘স্মৃতিতাড়িত’ও নই, আমি ‘স্মৃতিচালিত। পৃষ্ঠা: ১৪৮


দিলরুবা জেড. আরা বলেন

… আমার নিজের উপলব্ধির নিরিখে আমার শিকড় নিহিত ছিল বাংলাদেশের ভাষা আর সংস্কৃতির গভীরে। পৃষ্ঠা: ১৫২


ফায়েজা হাসানাত বলেন

আমার কাছে ডায়াসপোরা ধারণাটা আমি নিজে। আছি কিন্তু নাই; চেতনায়, আত্মায়, সত্তায় বাঙালি আছি-- কিন্তু বাংলাদেশে নাই। বাংলাদেশ আমার সমস্ত অস্তিত্বে আছে, কিন্তু আমি বাংলাদেশে নাই। পৃষ্ঠা- ১৫৪


দক্ষিণ এশিয়ার ৫ তরুণ ডায়াসপোরা লেখকের আড্ডা অংশে পাঁচ জন তরুণ লেখকের পারস্পরিক আলোচারিতা থেকে ডায়াসপোরা ধারণাকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ মেলে। নতুন প্রজন্মের ডায়াসপোরা সাহিত্যিকগণ নিজেদের অভিজ্ঞতা, মানসিকতা পরস্পরের সাথে বিনিময় করেছেন। তৃতীয় প্রজন্মের মানুষ হিসেবে ঝাপসা হয়ে যাওয়া অতীত স্মৃতি কীভাবে ছায়ার মত অনুগামী হয় তার কার্যকারণ উঠে আসে প্রত্যেকের কথায়। নিজেদের ডায়াসপোরা জীবন নিয়ে কাতরতা ও প্রত্যাশার কথাও উঠে আসে কারও কারও আলাপে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বইয়ের শেষের তথ্যপঞ্জীটি বেশ লোভনীয়। ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে আরও  বেশি পড়তে ইচ্ছুক পাঠক বইয়ের এই তালিকাটি ধরে অগ্রসর হতে পারবেন। সংযোজিত প্রবন্ধগুলো থেকে জানতে পারবেন বিভিন্ন জনের দৃষ্টিতে ডায়াসপোরার স্বরূপ। একটি পিডিএফ ফাইলের লিংক দেয়া হয়েছে। সক্রিয় পাঠক ডাউনলোড করে নিয়ে অবসরে পড়ে নিতে পারবেন।

তিনি প্রবাসী নন আবার অভিবাসীও নন। মাতৃ বা পিতৃভূমিকে সাহিত্যরচনার প্রসঙ্গ করে তুললে, স্মৃতিপ্রবাহে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পেলে সেই রচনা হবে ‘ডায়াসপোরিক সাহিত্য’।
আসলে বলতে হবে ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে বাংলাভাষায় আলোচনার শুরু হল এই বই দিয়ে। মোজাফ্‌ফর হোসেন দায়িত্ব নিয়ে নিজের ভাবনা প্রকাশ করেছেন। বাংলাভাষায় ডায়াসপোরা তত্ত্ব নিয়ে আর কোন বই আছে কীনা তা লেখককেরও জানা নেই। তবে আলোচ্য বইটিতে ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্ব, সংজ্ঞা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে এর প্রভাব এবং উপস্থাপন সহজভাষায় বর্ণিত হয়েছে। স্বল্প পরিসরে, সংক্ষেপে, সহজভাষায় সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে প্রসঙ্গের বিশ্লেষণ সহজসাধ্য কাজ নয়।  মোজাফ্‌ফর হোসেন এক্ষেত্রে সফল। নতুন পাঠক, যিনি ‘ডায়াসপোরা’ শব্দটির সাথেও পরিচিত নন, তিনি বইয়ের পাঠ শেষে বিষয়টিকে চিনতে পারবেন, বুঝতে পারবেন, মনের মধ্যে একটি রূপ আবছাভাবে হলেও অবয়ব পাবে।

বইয়ের বাঁধাই, ছাপা, কাগজের মান, প্রচ্ছদের নান্দনিকতা নিয়ে বাক্যব্যয় বাহুল্যমাত্র। সাহিত্যধারার নতুন এই প্রসঙ্গ নিয়ে কৌতুহলী পাঠক নিজ উদ্যোগে মোজাফ্‌ফর হোসেনের এই বই খুঁজে নেবে, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।


**********
দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরা সাহিত্য
ইতিহাস, তত্ত্ব, সংকট ও সম্ভাবনা
মোজাফ্‌ফর হোসেন


প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশকাল: প্রথম: ২০১৯, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ২০২১
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. ঢাকা
পৃষ্ঠা: ১৭৬
মূল্য: ৩২৫ টাকা
ISBN: 978-984-94352-0-4

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ