বইয়ের নামখানা এমনই তাৎপর্য ও রহস্যময়, পাঠককে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে কাছে টানে৷ তারুণ্যের প্রথম উচ্ছ্বাস, প্রথম কবিতার বই। চৌষট্টি ডানায় উড্ডয়নের স্বপ্ন দেখার শুরু হলো প্রিয় মোকলেছুর রহমানের; ‘সব বৃক্ষ মহোদয় হয় না’ বইখানা দিয়ে। প্রথম এ বইতে তিনি সম্ভাবনা দেখিয়েছেন; আলোর বুদবুদ দেখিয়েছেন, নিকট জোনাকির মতো।
আমি পাখি হতে চাই
তুমি শামুক অথবা ব্যাঙ।
ডানা মেলি—
উড়ে-উড়ে
ঘুরে ঘুরে আনন্দ জাগাই। (উল্টো)
মানুষমাত্রই কখনো প্রেমিক কখনো বিদ্রোহী, কখনো স্বার্থপর, কখনো উদার। কখনোবা অবচেতনে হিংসুটে, আহাম্মক। কবিও মানুষ, না কি নামানুষ! কবি কখনো প্রেমের কথা বলেন কখনো বিদ্রোহী। সময়টা এমনই। দিকে দিকে অদৃশ্য আগুন জ্বলছে মগজে-মননে, দেখা যাবে না ছোঁয়াও যাবে না। এ আগুন নেভানোর জন্য নেই কোনো দমকল, নেই আয়োজন। কবি জানেন এই পোড়খাওয়া জীবনের ব্যথা। কেঁদে ওঠে তার মন। এ সমাজ তো এমনই; মতলববাজেরা আগুন লাগিয়ে ফায়ার ব্রিগেডে খবর দিতে ছুটে যায়। এসব ভণ্ড-প্রতারকের থেকে নিজেকে রক্ষাই যে সময়ে বড় চ্যালেঞ্জ, সে সময়ে বসে কবি লিখেন—
আমাদের মাথাগুলো
আমাদের অজান্তে নিলামে ওঠে
খুচরা ও পাইকারি বেচাকেনা হয়।
আমরা মাথা মাথা করে
মাথাপাগল হয়ে যাই– (আমাদের মাথাগুলো)
এমন সমাজ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর প্রত্যয় যেন ‘কাঠঠোকরা’ কবিতায় প্রকাশ পায়—
তোমার হৃদয় খুঁড়ে বাসা বানাতে
পারলে হয়তো
ঝড়ে ভিজতে হতো না আমায়। (কাঠঠোকরা)
এছাড়া উপায় কী? একা কবি, যেন সত্যশিশু এক— হেঁটে যায় বর্শামণ্ডপে। কবির অবস্থা বোঝা যায় ফসল ফলানোর কিছু শব্দে—
গহ্বরে অসংখ্য নৃশংসতা, অকস্মাৎ পড়েছি সেই গর্তে।
কবির কিছু প্রেমানুভূতি সুন্দর, নির্মল। যেমন ‘দেখা হয় বায়ুর ঘ্রাণে’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
আর দেখা হয় না আমাদের
তবু বায়ুর ঘ্রাণে যেন,
দেখা হয়ে যায়।
‘নূপুর’ কবিতায় লিখেছেন—
সারাটি দুপুর
তোমার নুপুর
হৃদযন্ত্রে বাজে!
চোখের তারায়
নিজেকে হারাই
দেহের ভাঁজে ভাঁজে।
প্রেমে ডুবে কবি হারিয়ে যাননি, তিনি সমাজের অর্থনীতির রক্ত মুদ্রাকে দেখেছেন আপন আলোয়—
ক্রমাগত মুদ্রাযন্ত্রে বন্দী হয়ে যাচ্ছি
মুদ্রার মতো।
এক হাত থেকে
অন্য হাতে;
পৌঁছে যাই
ঘুরে-ঘুরে
বিনিময় রোডে
ব্যক্তিত্ব-বিবেক-চিন্তা ও মন। (মুদ্রাযন্ত্র)
সময়ের প্রেষণা কবির হৃদয়ে দাগ কাটে, মুগুঢ়ের মতো আঘাত করে, বেরিয়ে আসে শব্দ, কবিতা… মোকলেছুর রহমান দেখেন করোনা মহামারী, লিখেন—
অন্ধকার গিলেছে
পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অব্দি,
যেন একই সঙ্গীতের ধারাপাত,
মহামারী! অণুজীব! মৃত্যু! (অন্ধকার গিলেছে)
কবি সচেতন, কবি প্রতিবাদী, কবি নিঃশঙ্কচিত্তে লিখেন ধর্মকে ব্যবহার করে ভণ্ডামীর রূপ। উন্মোচন করে দেন কবিতায়। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সেই অমর বাণী ‘ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে’ মনে পড়ে যায় মোকলেছুর রহমানের ‘ডট ডট ডট’ কবিতা পড়তে গিয়ে। মানিক যা লিখেছেন কথাসাহিত্যে, মোকলেছ তা লিখেছেন কবিতায়। কবি মেনে নিতে পারেন না এসব নোংরামী। তাই তার
চোখ ফেটে রক্ত ঝরে,
মগজ গলে তরল!
… ভাবতেই সমস্ত দেহরস টগবগ করে ওঠে
আর বিস্ফোরিত হয়ে যাই!
কবি রাগান্বিত। কবি উত্তেজিত। কবি ক্ষুব্ধ। নবারুণ ভট্টাচার্য যেমন লিখেছিলেন,
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
তেমনই, এতদিন পর, আরেক নবীন কবি মোকলেছুর রহমান লিখলেন,
এ দেশ রক্তের দেশ
এ দেশ মৃত্যুর দেশ
এ দেশ আত্মঘাতি দালালের
মীর জাফরের দেশ
এ দেশ ধর্ষিত দেশ। (বিস্ফোরিত হই)
৫৪টি কবিতা নিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির যথোপযুক্ত প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাজীব দত্ত। ছাপা-বাঁধাই মনোরম। সব মিলিয়ে সুন্দর। যেহেতু প্রথম কবিতার বই, থাকুক দুর্বল কবিতা; ভাষায়, পোশাকে ছন্দপতন; সেসব বলার সময় আসেনি এখনো। কবির জন্য এখন শুধুই শুভকামনা।
**********
বই: সব বৃক্ষ মহোদয় হয় না
কবি: মোকলেছুর রহমান
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
দাম: ১৬০ টাকা
প্রকাশক: ঘাসফুল, ঢাকা
**********
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম