আবুল বাসার রচিত 'মহাজাগতিক প্রথম আলো (বিগ ব্যাং ও পটভূমি বিকিরণের খোঁজে)' বইয়ের রিভিউ - দীপেন ভট্টাচার্য

আবুল বাসার রচিত 'মহাজাগতিক প্রথম আলো (বিগ ব্যাং ও পটভূমি বিকিরণের খোঁজে)' বইয়ের রিভিউ - দীপেন ভট্টাচার্য

আবুল বাসার বিজ্ঞান চিন্তা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। বিজ্ঞানের সাধারণবোধ্য বই লেখেন, ইংরেজী থেকে বহু সাধারণজনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই অনুবাদ করেছেন। এই বইটি - মহাজাগতিক প্রথম আলো (বিগ ব্যাং ও পটভূমি বিকিরণের খোঁজে) - অনুবাদ নয়, এটি তাঁর সৃষ্টি। খুবই সাবলীল ও বিজ্ঞানানুগ তাঁর লেখা। সুপ্রিয় বাসার আমাকে একটা ভূমিকা লিখতে বলেছিলেন, আমি শ্লাঘান্বিত হয়ে একটি ছোট প্রাক-কথন লিখেছি। বইটির রিভিউ হিসেবে সেটাই নিচে তুলে দিলাম। প্রকাশ পেয়েছে প্রথমা থেকে ২০২২-এ। - দীপেন ভট্টাচার্য


আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার উন্মেষের এই কাহিনি আমাদের অনেক কৌতূহল মেটাবে আবার বহু কৌতূহল সৃষ্টি করবে – বিজ্ঞানের পথ এভাবেই রচিত হয়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, বিশেষ করে আধুনিক মহাজাগতিক ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায়, কীভাবে সৃষ্টি হয় সেটি জানার জন্য উৎসুক পাঠক এই বইটি দিয়ে শুরু করতে পারেন।

এই বইটি বলতে গেলে আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার সূত্রপাতের কাহিনি। প্রিয় বিজ্ঞান-লেখক আবুল বাসার মহাবিশ্বের প্রাচীনতম আলোক কণিকার আবিষ্কারের পর্যায়সমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে নিয়ে এসেছেন আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে প্রথম গ্যলাক্সির শনাক্তকরণ, মহাবিশ্বের প্রসারণশীলতা বা অস্থিত চরিত্রের প্রমাণ, বিভিন্ন মৌল পদার্থ সৃষ্টির প্রক্রিয়া এবং সর্বব্যাপী মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ আবিষ্কারের মাধ্যমে বিগ ব্যাং মডেলের প্রমাণ। যে মুন্সীয়ানায় আবুল বাসার এই ইতিহাসকে উপস্থাপনা করেছেন তা শুধু আমাদের জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার বহু অজানা ধাপকে জানতে সাহায্য করবে না, বরং আরো খুঁটিনাটি বৈজ্ঞানিক তথ্য বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রক্রিয়া যে সরলরেখায় চলে না, বরং সেটিকে বহু সঠিক বা বেঠিক অনুকল্পের চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আসতে হয় সেটি তাঁর পরীক্ষিত সাবলীলতায় আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন।

মনে করা হয় মহাবিশ্ব সৃষ্টির কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, এক সেকেন্ডও তখন পার হয়নি, প্রথম ফোটন কণা সৃষ্টি হয়। এই কণাটি মহাবিশ্বে সর্বব্যাপী হিগস ক্ষেত্রের সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে না, তাই এটির ভর হল শূন্য। এই কণাকেই (বা কণাসমূহকে) আবার তরঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা সম্ভব। এই তরঙ্গকে আমরা বলি তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ। এই কণা (বা তরঙ্গ), সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে, আলোর গতিবেগে ভ্রমণ করে এবং তাদের মধ্যে যেগুলির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে তারা আমাদের চোখে আপতিত হয়ে আলোর অনুভূতি সৃষ্টি করে। তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বেশিরভাগ অংশই আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয় এবং সেই অদৃশ্য বর্ণালীর একটি অংশ হল মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য দীর্ঘ বেতার ও অপেক্ষাকৃত নাতিদীর্ঘ অবলোহিত তরঙ্গের মধ্যে অবস্থিত।

মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে বস্তুর ঘনত্ব এতই বেশি ছিল যে, তার মধ্যে ফোটন কণারা ইলেকট্রনের মেঘের মধ্যে আটকে পড়েছিল। ধীরে ধীরে মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে তাপমাত্রা ঠাণ্ডা হয়ে এল, বস্তুর ঘনত্ব কমে এল এবং প্রোটনের কক্ষপথে ইলেকট্রন আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করল হাইড্রোজেন পরমাণুর। প্রথম প্রথম ফোটন কণা সেই পরমাণুগুলিকে আয়নিত করতে গিয়ে, অর্থাৎ ইলেকট্রনকে পরমাণু থেকে উৎক্ষিপ্ত করতে গিয়ে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পরে ফোটনগুলোর শক্তি কমে যাওয়াতে নিউট্রাল হাইড্রোজেন পরমাণুগুলিকে সেগুলি আর আয়নিত করতে সক্ষম হল না এবং সেই পরমাণুগুলোর সঙ্গে ফোটনের আর মিথষ্ক্রিয়া হল না। এই ফোটনগুলো আর ধ্বংস হল না। এর ফলে বিগ ব্যাংএর প্রায় ৩৮০,০০০ বছর পরে ফোটনগুলো বস্তুর ঘন মেঘ থেকে মুক্ত হল, সেই ফোটনই প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পরে আজ আমরা কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি) বা মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ হিসেবে পর্যবেক্ষণ করছি।   সেই সিএমবি ফোটন যখন বিকিরিত হয়েছিল তখন মহাবিশ্বের ব্যাস আজ থেকে প্রায় এক হাজার গুণ ছোট ছিল। এর মধ্যে মহাবিশ্বের ক্রমাগত সম্প্রসারণের ফলে সিএমবি ফোটনের তাপমাত্রা তাদের আদি ৩০০০ কেলভিন (বা প্রায় ৩০০০ সেলসিয়াস) থেকে পরম শূন্যতার মাত্র ২.৭ কেলভিন ওপরে নেমে এসেছে। এর ফলে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যও অবলোহিত বর্ণালীর ১ মাইক্রনের কাছাকাছি থেকে বেড়ে আজ ১ মিলিমিটারের কিছু বেশি হয়েছে। সিএমবি ফোটন হল মহাবিশ্বের আদিমতম ফোটন যা কিনা বস্তুর মেঘ থেকে মুক্ত হবার পরে অবারিতভাবে ভ্রমণ করে, ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পরে, আমাদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিরূপক যন্ত্রে ধরা পড়ছে।

বাংলাভাষায় বিজ্ঞানের প্রাথমিক গবেষণার ওপর জনপ্রিয় বইয়ের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। সেই ঘাটতি পূরণ করতে আবুল বাসারের প্রয়াস নিরলস। তাঁর বিষয় নির্বাচন সূক্ষ্ণ, ভাষার ব্যবহার বোধ্য এবং উপস্থাপনা আকর্ষনীয়। ১৯৬৫ সনে সরাসরি সিএমবি আবিষ্কারের বহু আগে, ১৯৩৮ সনে, আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে সায়ানোজেন অণুর বর্ণালীর পর্যবেক্ষণে জ্যোতির্বিদরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেই অণু কোনো মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া করছে, কিন্তু তাঁরা এর তাৎপর্য ধরতে পারেননি। অর্থাৎ মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ আবিষ্কার ও সেই সাথে বিগ ব্যাং মডেলের প্রমাণের একটি সুযোগ বিজ্ঞানীরা হাতছাড়া করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ধাপসমূহ যে সবসময় পূর্বনির্ধারিত কোনো পথে চলে না সায়ানোজেন বর্ণালীর ইতিহাস তার প্রমাণ। এই গুরুত্বপূর্ণ ‘হাতছাড়া’ হবার কাহিনি এই বইতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে – বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার চরিত্র জানতে আমাদের তা সাহায্য করবে।

একই কথা বলা যায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরের ভারি মৌলিক পদার্থগুলির সৃষ্টির ব্যাপারে, সেগুলো কোথায় কীভাবে সংশ্লেষিত হতে পারে তা নিয়ে যে বৈজ্ঞানিক অনুকল্প, বিতর্ক ও সমাধান সেটিও আবুল বাসার সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার উন্মেষের এই কাহিনি আমাদের অনেক কৌতূহল মেটাবে আবার বহু কৌতূহল সৃষ্টি করবে – বিজ্ঞানের পথ এভাবেই রচিত হয়। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, বিশেষ করে আধুনিক মহাজাগতিক ও জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায়, কীভাবে সৃষ্টি হয় সেটি জানার জন্য উৎসুক পাঠক এই বইটি দিয়ে শুরু করতে পারেন।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ