প্রত্যেক বড় শহরের নিজস্ব একটা আত্মা আছে, লেখকেরা তার রহস্যের মর্মে প্রবেশ করেন দুরূহ সাধনায়। শহরের আত্মাকে তাঁর নিজের মধ্যে গ্রহণ করেন, প্রেমিক যেমন করে প্রিয়ার জীবনকে অধিকার করে।
(কলকাতা, হঠাৎ আলোর ঝলকানি, বুদ্ধদেব বসু)
বাবার প্রেশার নেমে চলে গেল পাহাড়ের নিচের শিকড়ে সেখানে একটাই ছোট্ট ঘর।
বাবা থাকেন চা করে জনতা জ্বেলে, ডিম ভাজা করে।
মা আসত বাবার সাথে দেখা করতে সঙ্গে আসত বেলা মাসি,
দুজনেরই স্কুল ছুটি হতো ওই একই সময়ে, বাবার তৎপরতা দেখে ওরা কোনদিন বাবাকে কাজে আর হাত দিতে দিত না। বলতো তুমি হেসেল থেকে বেরিয়ে এসো, ও ঘরে যাও বেলা আছে।
আমি চা নিয়ে যাচ্ছি
এই কবিতার নাম ১৩ই আষাঢ় ১৩২১। এই কবিতাটার কাছে আমাকে বারবার ফিরে আসতে হয়, এই কারণে যেন এর প্রতিটি অক্ষরে কি এক রহস্য অজানা ভয় এবং অনিবার্যতা ঘনিয়ে এসেছে, একটা গল্পের বা উপন্যাসের আভাস যেন দেয় এই কবিতাটি, যেখানে অনেক ইঙ্গিতধর্মিতা আছে এবং সেই ইঙ্গিত এর মধ্যে দিয়ে কবি এক জটিল সম্পর্কের ইশারা দিয়েছেন যেখানে হয়তো বাবা, মা, বেলামাসি, এক উকিল বন্ধু - সবাই বিভিন্ন স্তরে এবং বিভিন্ন সময়ে, না- সরল এক সম্পর্কে বুননে দাঁড়িয়ে আছে। এখন খেয়াল করছি কবিতাটির নাম ১৩ই আষাঢ় ১৩২১। আমার মনে হয় এই তারিখটিতে কিছু গোলমাল আছে। এটা হয়তো ১৪২১ হবে কারণ এই ১৪৩১ এ দাঁড়িয়ে এটা নিশ্চয়ই ১১০ বছর আগের কোন ঘটনা বলছে না। আমার মনে হচ্ছে যে এটা দশ বছর আগের কোন ঘটনা। অদ্ভুত ভাবে মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস শুরু হচ্ছে যে আজ ৭ আষাঢ়, অবিনাশ ঘোষালের জন্মদিন। সেই অবিনাশ ঘোষাল জে কিনা মধুসূদন এবং কুমুর সন্তান, যে সন্তান আসার একেবারেই প্রত্যাশা কুমুর ছিল না বরং এই দাম্পত্য থেকে সে যখন বেরিয়ে আসবে ভেবেছিল তখন সেই সন্তান এসে তাকে এই তিক্ত, অসম এবং অমর্যাদাপূর্ণ সম্পর্কে তাকে আটকে দিল সেই হচ্ছে। এখানেও একটা পিতৃতন্ত্রের জয় এবং আবার সেই দাম্পত্যের মধ্যে ঢুকতে হলো । তো এই ১৩ই আষাঢ় শব্দটি যেন সেই একটা বেদনা এবং প্রেম এবং প্রেমহীনতা এবং প্রেম দিতে না পারার নিরুপায়তা কোথায় যেন কাজ করছে কবিতার কবি ধীমান ব্রহ্মচারীর কবিতার মধ্যে। সে একেবারেই শূন্য দশকের কবি এবং তার কবিতার মধ্যে জটিল বাক্য বিন্যাস, অকারণে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের, অপশব্দ ব্যবহারের কোন চিহ্ন নেই। সে খুব সহজ বাক্য ব্যবহার করে এবং তার এই যে কবিতার বই শহর ও কবিয়াল এর মধ্যে সে একটি শহরকে দেখায়, সেই শহর আমি জানি না শুধুই শহর, না কি এক নগর তার নাগরিক চতুরালিসহ। আমার মনে পড়ে যায় বুদ্ধদেব বসুকে, যিনি আক্রান্ত একজন নাগরিক কবি ছিলেন এবং তাঁর যে কবিতার উচ্চারণ ছিল, সেই কবিতার কাছে হয়তো কোথাও ধীমানের অজান্তে ঋণ থেকে গেছে। কারণ বুদ্ধদেব বসু যাই লিখে থাকুন তা ছিল আদ্যন্ত মধ্যে নগরকেন্দ্রিক। আমরা জানি যে তাঁর প্রিয় কবি ক্লেদজ কুসুমের কবি বোদলেয়ার যিনি ঘুরে ঘুরে রাতের প্যারিসকে দেখতেন এবং সেই দেখার ফলে কবিতায় উঠে আসতো নগরের যাবতীয় বিষ ও মধু, পাপ ও মায়া।
তার কবিতার বইয়ের নামটা খুব সুন্দর শহর ও কবিয়াল। একটি কবিতায় সে বলেছে
আমি বলতে চেয়েছিলাম যুদ্ধ শেষ হোক,
নয়তো এন্টনি ফিরিঙ্গির দলের নাম লিখিয়ে লিখি একটা করে গান অথবা কবিতা
কবি এবং কবিয়াল কিন্তু আলাদা। কবিয়াল শব্দের মধ্যে একটা গানের সুর, একটা মেঠো গানের সুর, একটা লোকজ সংস্কৃতি যেন কোথাও লুকিয়ে আছে। ধীমান সেই সুরটাকে যেন তার কবিতার শরীরে ধরেছে। শহরের যে বিভিন্ন চিহ্ন, অভিজ্ঞান- তার মধ্যেই সে এই সুরটাকে খুঁজে পেতে চেয়েছে। যেমন
বসন্তকালীন বিষুব কবিতায়
শৈশব হারানো রাস্তার কুকুর
আস্তানা গেড়েছে ফুটপাতের প্রান্তে
যেখানে হাজার কাপের ভিড়ে ময়লার স্তূপ
ট্রামের ঢং ঢং - বাসের পেরিয়ে চলার লড়াই
এসবেই জমে আছে আমার কোন এক বসন্তের পড়ন্ত
রোদের বিকেলবেলা
সারাদিন আমরা যদি একটা শহরের সাউন্ডস্কেপ করি, তাহলে শুনব সারাক্ষণ নানান রকম ধাতব শ,ব্দ এখানে পাখির কলকাকলি, কয়েকটা গাছের পাতা খসে পড়ার মধ্যে যে একটা আওয়াজ, সেসব খুব কম। এখানে নানান রকম ধাতব শব্দ, তার মধ্যেও ধীমান কিন্তু একটা সুর খুঁজে পেয়েছে এবং সেই শহর যেখানে খুন সন্ত্রাস হিংসা খুব বেশি, সেখানে হারিয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করে।
রাত ফুরোলেই ব্যস্ত শ্রমিক দলের সঙ্গে ফিরি। কাজকর্মের ফাঁকে হাওয়ায় মিশে থাকার নিকোটিন নিয়ে চলছি প্রত্যেকটা মুহূর্ত আর তখন বুঝতে পারি আমরা যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি হারিয়ে যাচ্ছি হারিয়ে যাচ্ছি যাচ্ছি
আমাদের যাত্রা শেষ হয়নি এখনো ঘরের মধ্যে থাকা যে নিশ্চয়তার সীমারেখা সেখানে আসতে যাচ্ছে মহাকাল ছদ্মবেশে মৃত্যু গ্রাস করবে, আমাদের জীবন নামক বেঁচে থাকা এক অস্তিত্বকে শূন্যতায় ভাসবে আমাদের মানব সত্তা শহর আগলে রাখবে আমার মৃতদেহ’
ধীমানের কবিতা আমাদের এইখানে এসে চমকে দেয়। শহর ও কবিয়াল শিরোনামের মধ্যে যে আশ্বাসটা ছিল, সেই শহর কি শেষ পর্যন্ত আমাদের আমাদের মৃতদেহ আগলে রাখছে? খেটে খাওয়া মানুষগুলো, যারা শহরে বিভিন্ন কাজ করতে আসে তারা আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কবি বলেছিলেন ‘এই মৃত্যু উপত্যাকা আমার দেশ না’ কিন্তু এখন এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার শহর।
মাটির নিচেই আছে আমাদের ছেলেবেলার স্বপ্ন
মৃত্যু যেখানে ভাইরাস হয়ে অপেক্ষা করছে
সময়ের সঙ্গে সজাগ থেকে।
বুঝতে পারি কিছু কবিতা লেখা হয়েছে অতিমারীর সময়। এই কবিতার বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে আমার মনে হয় ‘যে শব্দ রাগ আমার আপনাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়ে আসছে জন্ম লগ্ন থেকে।‘ এই শব্দ রাগের ভরসায় আমাদের পথ চলা। কেউ খোঁজ নিতে আসুক বা না আসুক, আমাদের একা থাকার গান চলতেই থাকবে। ইতিহাস আমাদের জীবনের শিক্ষা দেবে।
অসাধারণ প্রচ্ছদ এবং মুদ্রণ সৌন্দর্য চোখে পড়ার মত।
**********
শহর ও কবিয়াল
ধীমান ব্রহ্মচারী
এবং অধ্যায়
প্রচ্ছদের ফোটোগ্রাফি- দেবরাজ জানা
নামাংকন – সুপ্রসন্ন কুণ্ডু
প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০২৩
মূল্য ১৫০ টাকা
----------
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম