শিখা কর্মকারের লেখা 'ম্যাগনোলিয়ার মুহূর্ত' কাব্যের আলোচনা - লিপিকা সরকার

শিখা কর্মকারের লেখা 'ম্যাগনোলিয়ার মুহূর্ত' কাব্যের আলোচনা - লিপিকা সরকার

প্রথমেই বলি জীবনানন্দ দাশের পর আমি এত সুন্দর ভাবে প্রকৃতিকে লেখার আনাচেকানাচে জড়িয়ে নিতে দেখলাম আমার এই কবি বন্ধুকে। তার প্রতিটি অনুভূতি, ভালোবাসা, বিরহ, ত্যাগ, তিতিক্ষা সবকিছুর মধ্যে কি সাবলীলভাবে চলে এসেছে প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপের অতুলনীয় আবেদন। লেখার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতি প্রেম।

এক একটা কবিতা পড়তে পড়তে তা ছবির মত ভেসে উঠেছে, উপলব্ধি করেছি মনের প্রশান্তি। দীঘির মত শান্ত কিন্তু সমুদ্রের মত গভীর। কিছু লেখার কিছু অংশ উদ্ধৃত না করলে মন মানবেনা। 

 

আজ ভোর নিজেই এক অলিখিত আমন্ত্রণপত্র, এসময় প্রত্যেকটি গাছ এক একটি তীর্থক্ষেত্র..

 

কবিতাটির নাম 'ভোর',  প্রতিটি ছত্রে প্রকৃতির অকুন্ঠ প্রকাশ, মন শুদ্ধ হয়ে ওঠে। 

 

কবি লিখেছেন তার 'ফুটে ওঠা' গদ্যকাব্যে -

সব মাটি-কাদা-পাথরের ভার ও মালিন্য সরিয়ে কেন ফুটে উঠতে পারিনা?.. 


কি অসাধারণ প্রশ্ন, কত দুর্লভ আত্মসমালোচনা! লিখেছেন -

নিজের সোহাগে ভরে দিতে পারিনা ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম?


পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এইভাবেই যদি ভাবা যেত তাহলে এই পৃথিবী কত সুন্দর হয়ে উঠত? 'তেমন কবিতা' তে তিনি এক আহত কবি, নিদারুণ আঘাতে বলে উঠেছেন -

কেন  কবিতা এক ধর্মগ্রন্থ বা সংবিধান হয়ে পথ দেখায় না সহস্রাব্দ ধরে?



অহরহ তিনি খুঁজে চলেছেন সেই পরশপাথর। সমস্ত কবিদের প্রতি তার এই আবেদন বড়ো প্রাসঙ্গিক এই মুহূর্তে।  

'তিতিক্ষা' কবিতায় ভালোবাসা তার কাছে তপস্যার মত ধরা দিয়েছে;  তিনি লিখেছেন, 

 

তুমি ভুলে যাও-যে সত্যিকারের ভালোবাসায় মগ্ন, তার অভিধানে প্রতিশোধ বলে কিছু নেই, তার প্রেমের প্রান্তর জুড়ে থাকে শুধু তিতিক্ষা…

 

এই জটিল সমাজে যখন সম্পর্করা সব অগোছালো, যখন মানুষ বড়ো বেশি আত্মকেন্দ্রিক তখন তিনি স্বপ্ন দেখেন নতুন একটা সমাজের তাই তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন-

হাঁসেদের পায়ে পায়ে মাখা সহজ নম্রতার মত ফিরে আসে স্নিগ্ধ সম্পর্কেরা


কি অপূর্ব নরম অথচ গভীর ভাবনা!

আবার অসহনীয় বিরহে কাতর হয়ে কবি লিখেছেন -

শীতের দিনের মতো ছোট হয়ে আসছে আমাদের উচ্চারিত সম্পর্ক।


কি অসামান্য রূপকের ব্যবহার। আবার কোথাও রাধা হয়ে বলেছেন -

ভেসে যাই আমি প্রত্যেকবার অসহ্য সুখে - / অঝোর বৃষ্টি নামে ভেতরে কোথাও। 


তার প্রতিটি অনুভূতিতে প্রকৃতির অনায়াস বিচরণ। কি সহজে তিনি লেখেন -

 চাঁদ উঠলে ঘুম আসেনা কাঠবিড়ালীদের। গুপ্ত মিটিং চলে বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ে- প্রান্তরে, গুহায় ও খাদে।


এইভাবেই লেখার প্রতিটি ছত্রে তিনি প্রকৃতির অমলিন ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে থেকেছেন।

নিজের দেশ থেকে অনেক দূরে থাকেন কবি তাই অভাববোধ করেন আত্মীয়, বন্ধুদের। ভারতে থাকা তার বাবার কথা লিখতে গিয়ে কবি লিখেছেন -

তোমাকে যা শোকে ভেঙ্গে মতিচ্ছন্ন করে দেয়, সে সব কথা উহ্য রাখি..


কী ভীষণ দায়িত্ববোধ! আবার গাছ প্রেমিক বাবার কথা লিখতে আর এক জায়গায় তিনি লিখেছেন -

জানি এভাবেই তুমিও তিলে তিলে শান্ত ও সবুজ হয়ে যাচ্ছ


প্রকৃতিকে অন্তর থেকে ভালো না বাসলে এ কথা লেখা যায় না।


এইভাবেই বই যত এগিয়েছে তত প্রকৃতির সাথে তার একাত্মতা অনুভব করেছি, কি অসাধারণ ভাবে লিখেছেন -

.... পেকে রঙিন হয়ে উঠতে থাকা টমেটো আর আম দেখে ভাবি ওদের ভেতর কেউ গেয়ে যায় গান? নাকি নিস্তব্ধতা রং লাগিয়ে দেয় ওদের ত্বকে?..


প্রকৃতির প্রতি নিগূঢ় ভালোবাসা না হলে কি এইভাবে ভাবা যায়? পড়তে পড়তে নিজেও হারিয়ে গেছি প্রকৃতির আঁচলে, এখানেই বোধহয় কবির সার্থকতা যে তিনি একজন্য সাধারণ পাঠককেও তার মত করে ভাবিয়ে তুলতে পারেন।

আবার কোন কোন লেখায় স্পর্শ পাই সেই অসীমকে পাওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষার, লিখছেন -

চেষ্টা করেও বোঝাতে পারিনি তোমায়, জীবন আর মৃত্যুকে সরিয়ে তোমার কাছে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।


অনুভব করছেন সেই পরমের ডাক, লিখেছেন -

পৃথিবীর সব শেকল ভেসে চূরমার হয়, সব বন্ধ দরজা খুলে যায়, সব কাঁটাতার নরম হয়ে আসে সেই ডাকে


আহা! মন কিছু সময় চুপ করে থাকে। এইভাবেই সারা কাব্যগ্রন্থ জুড়ে  নিসর্গ প্রেম আর তার মনের আকুতি। এ যেন এই অসীম, অনিন্দ্য প্রকৃতির প্রতি তার প্রেমাঞ্জলি। তার অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার। তার কবিতা এখানেই আরো ভীষণভাবে পূর্ণতা পায় যখন তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে লেখেন-

সারা জীবনের সঞ্চয় বলতে তুমিই। তোমাকে জড়িয়ে আছি বলে আত্মার ভেতরঘর পর্যন্ত তোমারও যাতায়াত আছে বলে মনে হয়, এখনো দু-একটা মুহূর্ত বেঁচে আছি।


বেঁচে থাক এমন কবিতারা। ছড়িয়ে পড়ুক তাদের সুগন্ধ আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে দূরে আরো বহু দূরে। আমরা সুবাসিত হই।


**********
ম্যাগনোলিয়ার মুহূর্ত
শিখা কর্মকার


প্রকাশনা - এবং অধ্যায়
মূল্য - ২২৫.০০

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ