আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বিলম্বিত কাফকা এবং রূপান্তর - মাসরুর আরেফিনের 'ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র' সম্পর্কে রাজু আলাউদ্দিন

মাসরুর আরেফিনের 'ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র'


কাফকার লেখার প্রথম ইংরেজি অনুবাদ হয়েছিলো ১৯৩০সালে। ইংরেজি অনুবাদ হওয়া মানে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় ছড়িয়ে পড়ার নিশ্চয়তা। বাংলা ভাষায় আমরা যেসব অনুবাদ পাঠ করি তা মূলত ইংরেজি অনুবাদের গর্ভজাত সন্তান। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে তিরিশ ও চল্লিশ দশকে কাফকার বাংলা অনুবাদ তো দূরের কথা, তার কোনো উল্লেখও আমাদের কোনো লেখকদের লেখায় উচ্চারিত হতে দেখি না। ১৯৫০ সালে নৃপেন্দ্র সান্যালের অনুবাদে ‘দেশ’ পত্রিকায় বিচার উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় (বিচার, ফ্রানৎস কাফকা, অনুবাদক নৃপেন্দ্র সান্যাল, দেজ পাবলিশিং, দ্বিতীয় সংস্করণ: অক্টোবর ২০০১, পৃ: বারো)।  সেটা সত্যি হলে, এরপর প্রায় ১৮ বছরের ব্যবধানে পূর্ব বাংলায় কাফকা সম্পর্কে ঔৎসুক্যের প্রথম দীপটি জ্বেলেছিলেন (লেখাটির শিরোনাম ‘কাফকা: তাঁর প্রথম উপন্যাস’) মফিজুল আলম নামের এক কাফকা-প্রেমিক ‘শিল্পকলা’ ( আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবদুস সেলিম সম্পাদিত) শীর্ষক এক অগ্রসর চৈতন্যের সাহিত্যপত্রিকার দ্বিতীয় সংকলনে (পৃষ্ঠা: ১৩-১৭, চৈত্র, ১৩৭৬), আর এরও প্রায় বছর তিনেক পরে ৭২ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় ‘সাহিত্যচিন্তা’ পত্রিকায় আর্যদেব-এর অনুবাদে মিলেনাকে লেখা কাফকার চিঠি।

এর বছর দুয়েক পরেই ১৯৭৪ সালে প্রথমবারের মতো সরাসরি জার্মান ভাষা থেকে প্রণব ভট্টাচার্যের হাতে অনূদিত হলো কাফকার Die Verwandlung বা আমরা যাকে `মেটামরফোসিস'  বলে আজ জানি, প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে ‘বিকল্প’ নামক এক সাহিত্য পত্রিকায় (পৃষ্ঠা: ৮৯-১৪৫, ভাদ্র-আশ্বিন ১৩৮১)। ৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ‘গাঙ্গেয় পত্র’ সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশিত হয় অঞ্জন সেন-এর অনুবাদে `শকুন' গল্পের অনুবাদ।  লক্ষণীয় এই যে আমাদের সাহিত্যের প্রধান লেখকদের কোনো সাড়া আমরা দেখতে পাবো না আশির দশকের সূচনা পর্যন্ত। অথচ তিরিশের লেখকরা, বিশেষ করে কবিরাই, ততদিনে ইংরেজি অনুবাদের কল্যাণে বাংলা ভাষায় নাগরিকত্ব (Naturalization) দিয়েছেন একাধিক আলেমান কবিদের; সুধীন দত্তের হাতে হানস কারোসা, হাইনরিখ হাইনে এবং গ্যাটে, বুদ্ধদের বসুর মারফত হোন্ডারলিন ও রাইনার মারিয়া রিলকে। কিন্তু যিনি, ফ্রানৎস কাফকা, উপরোক্ত কবিদের সমগ্র যোগফলের অধিক মহিমায় বিশ্বসাহিত্যকে অভিভূত করার নিশ্চয়তা নিয়ে উপস্থিত, যিনি তার দিনপঞ্জীর পাতায় গভীর আস্থার সঙ্গে জানিয়ে দিলেন

‘Far, far away from you, world history unfolds, the world history of your soul.’



দিনপঞ্জীর এই বক্তব্যই শিল্পকুশলতার সর্বোচ্চ দক্ষতায় মুকুরিত হয়ে ওঠে তার গল্পে ও উপন্যাসে। তার ব্যাপারে আমাদের সেকালের লেখকরা কেন উদাসীন (বা অনবহিত?) ছিলেন তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হয়তো আছে কিন্তু সেই ব্যাখ্যা আমাদের সাহিত্যের ঊনতাকে আর আগাম সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করতে পারবে না। শেষের এই কথাটা বললাম এই জন্যে যে প্রতিটি সাহিত্য বড় ধরণের বাঁক বদলের আগে অপর ভাষার, অপর সাহিত্যের প্রাণস্পর্শে সে স্ফূরিত হয়ে ওঠে, বড় ধরনের উল্লম্ফনের প্রাণশক্তিকে সে আহরণ করে ‘অপর’-এর কাছ থেকে। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল  এবং জীবনানন্দ-- চারজনই অন্য ভাষার কবি লেখকদের আত্মাকে শুষে নিয়ে নিজ ভাষায় সুপারনোভার মতো বিস্ফোরিত হয়েছিলেন। নিকটতম এবং জনপ্রিয় উদাহরণ হিসেবে মার্কেসের সেই স্বীকারোক্তির কথা (“তাঁর ‘রূপান্তর’ গল্পটা সতেরো বছর বয়সে পড়েই মনে হয়েছিলো যে আমিও লেখক হতে পারি।” --- পেয়ারার সুবাস, গার্সিয়া মার্কেস, অনুবাদ: খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৫, পৃ: ৩৬-৩৭) মনে পরবে আমাদের যিনি লেখক জীবনের শুরুতেই অর্থাৎ চল্লিশের দশকে বোর্হেসের অনুবাদে (১৯৪৩ সালে) কাফকার Metamorphosis পড়ে মুগ্ধ হয়ে লেখকজীবনকে নিশ্চিত করে তুলেছিলেন। আরও আশ্চর্য এই যে সেই  ১৯৩০ সালেই চিলেতে ‘বাবেল’ (এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন এনরিকে এসপিনোসো) নামক সাহিত্য পত্রিকা (Babel. Revista de arte y crítica 53, Santiago de Chile, primer trimestre de 1930. N° dedicado a Kafka) কাফকা নিয়ে বের করেছিলো বিশেষ সংখ্যা ।

বাক্যের সৌন্দর্য, সাবলীলতা, নির্ভুলতা এবং বিশ্বস্ততার প্রশ্নে মাসরুরের সাফল্য আমাদেরকে চমৎকৃত না করে পারে না।
আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের যে-রাজপথ, তার বাইরে অনুবাদের উপস্থিতি সলজ্জ ও কুন্ঠিত কিশোরের মতো। সেখানেও চল্লিশ দূরে থাক, আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হলো প্রায় আশির দশক পর্যন্ত কাফকার প্রবেশবার্তা--লক্ষণীয় মাত্রায়-- শোনার জন্য। এর আগে দু’ একজনের লেখায় কাফকার নাম উচ্চারিত হয়ে থাকতে পারে তবে তা শ্রুতিগ্রাহ্য বা হৃদয়গ্রাহ্য রূপে খুব যে প্রবল ছিলো তা মনে হয় না। কাফকা অনুবাদ বা চর্চার পেছনে আমাদের এই বিলম্বের পেছনে কী কারণ তা কেবল অনুমান করা সম্ভব। অনুমান কি এই যে আমাদের পূর্ব-পুরুষরা পশ্চিমের লেখক ও সমালোচকদের দ্বিধায় দীর্ণ ও সিদ্ধান্তহীন ছিলেন বলেই? খোদ পশ্চিমেই কাফকার পুনর্বাসন ঘটেছে বহুবিতর্ক ও দ্বিধাদ্বন্দের  পর। ডান কিংবা বাম--কোনো  শিবির  থেকেই কাফকাকে নিরঙ্কুশ স্বাগত জানাবার কোনো আয়োজন আমাদের প্রধান লেখকদের মধ্যে আশির দশকের আগে পর্যন্ত দেখা যায় না। কাফকা সম্পর্কিত ‘অবক্ষয়ী’, ‘অমাময়ী’ এবং ‘ধর্মনিষ্ঠতা’র পশ্চিমী আদি অপপ্রচারগুলোই কি আমাদেরকে দ্বিধাগ্রস্ত করে রেখেছিলো কাফকা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে? তার মানে কি এই যে পশ্চিমে কাফকা বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হলো? অথচ, কী আশ্চর্য সেই তিরিশ, চল্লিশের দশকেই, কাফকার সমসাময়িক বা পরবর্তী আলেমান লেখকদের রচনাপাঠের কথা শুনতে পাই তাদের লেখায়; জীবনানন্দে টমাস মান, বুদ্ধদেবে রিলকে, হোল্ডারলিন, গ্যোয়েঠে প্রমুখ।

তবে রাজনীতি ও সাহিত্য বিষয়ে আমাদের লেখকদের অস্বচ্ছ ধারণাকে উপেক্ষা করেই শেষ পর্যন্ত, দেরিতে হলেও, কাফকা যে বাংলা ভাষায় প্রবেশাধিকার পেলেন-- এটাকেও খাটো করে দেখার কিছু নেই। কল্পনাপ্রবণ পাঠক হিসেবে আমরা হয়তো ভাবতে পারি এরকম যে বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ার অনুবাদের মাধ্যমে পরবর্তী বাংলা কবিতার জন্য যে অমেয় সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করেছিলেন, ঠিক তেমনি, যদি তিনি বা তার মতো যোগ্য কেউ কাফকা অনুবাদ করতেন তাহলে বাংলা কথাসাহিত্যের বহু বিচিত্র উল্লম্ফনের সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে তোলা যেত। যেমনটা বোর্হেস স্প্যানিশ ভাষায় ফকনার (১৯৪১ সালে) এবং কাফকা (১৯৪৩ সালে) চল্লিশের দশকে অনুবাদের মাধ্যমে নিজের জন্য যেমন, তেমনি তার পরবর্তী লেখক, যেমন মার্কেস, কাব্রেরা ইন্ফান্তে, কোর্তাসার, বার্গাস যোসা, কার্লোস ফুয়েন্তেস প্রমুখদের জন্য সম্ভাবনার সড়ক তৈরি করে দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি কাফকার অনুবাদ ও চর্চার সূচনা-- চোখে পরার মতো-- আশির দশকের শুরুতে এবং ধীরে ধীর তা জোয়ারের রূপ ধারণ করে এখন কাফকা এক প্রণম্য ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হয়েছেন। তবে আপাতবিসদৃশ হলেও  সত্য এই যে পশ্চিমবঙ্গে শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন, সুবিমল মিশ্র প্রমুখের হাতে কাফকা-চর্চার নির্ভুল সূত্রপাত হলেও আবার সেখানেই কাফকার অনুবাদ হয়েছে বিপজ্জনক পথে; ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির স্বেচ্ছাচারকে পুঁজি করে। ‘পাঠক সমাবেশ’ থেকে প্রকাশিত মাসরুর আরেফিনের অনুবাদে “ফ্রানৎস কাফকা: গল্পসমগ্র”- এর গুরুত্বকে  পুরোপুরি বুঝে ওঠার আকাঙক্ষায় আমি পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত কাফকার লেখার অনুবাদগুলো মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। বহু ভাষায় যাদের স্বাচ্ছন্দ্য অনায়াস, বহুসংস্কৃতিতে যাদের স্ফূর্তি স্বভাবশোভন, এবং ইংরেজি যাদের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা তারা অনুবাদে অসংবেদনশীল, ভ্রমাত্মক ও দায়িত্বহীন কী করে হতে পারেন তা বোধের অতীত। ‘এবং মুশায়েরা’ থেকে প্রকাশিত “ফ্রানৎস কাফকা সমগ্রগল্প”  পাঠ করতে গিয়ে অবাক হয়েছি সম্পাদনা ও অনুবাদের মান দেখে। এর সম্পাদক--যিনি অনুবাদকদেরও একজন-- মনোজ চাকলাদার। ‘প্রাককথন’ নামে গ্রন্থের শুরুতেই ছয় পৃষ্ঠার যে প্রবন্ধটি লিখেছেন তাতে বাক্যগঠনগত ক্রুটিতো আছেই, এমন কি কাফকা সম্পর্কেও ধারণা এতই অস্বচ্ছ ও ভাসা ভাসা যে কাফকা সম্পর্কে অজ্ঞপাঠককেও তা বিরক্তি ও বিবমিষার শিখরে নিয়ে যাবে। ভদ্রলোক বাংলাভাষা ও সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্য ও কাফকা সম্পর্কে নির্ভুল ও গভীর কোনো ধারণাই রাখেন না। অথচ প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করে বসে আছেন। ইংরেজি ভাষা সম্পর্কেও কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই তার। ফলে পুরো গ্রন্থটি বিপর্যয়ের এক কুতুব মিনার হয়ে উঠেছে। এর বিপরীতে মাসরুরের বইটি তথ্যের প্রাচুর্যে ও সুশৃঙ্খল বিন্যাসে, সম্পাদনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিস্তারে, মূল্যায়ণের স্বচ্ছতা ও সাবলীলতায়, অনুবাদের সততা ও পূর্ণাঙ্গতায়, ঢীকাভাষ্যের সমাবেশে হয়ে উঠেছে এমন এক দৃষ্টান্ত যা কাফকা-প্রেমিকরা আগে দেখেছেন বলে মনে হয় না।


মনোজ চাকলাদারের ‘প্রাককথন’ এবং মাসরুরের ‘ভূমিকার আগে’ থেকে কিছু উদ্ধৃতি হাজির করলেই পাঠক বুঝতে পারবেন দু’জনের মানগত পার্থক্য। মনোজ যে বাংলা বাক্যও ঠিক মত লিখতে পারেন না তার নমুনা দেখুন:

“তিনটি অসমাপ্ত উপন্যাস এবং আঠারোটি ছোট বড় গল্প আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতা ঘটেছে।”
“Before the law তো রয়েছে সে বিচারকের কাছে পৌঁছতে পারে না, যুক্তি সঙ্গত বিচারতো পায় না। (পৃ :১১)


অন্যদিকে মাসরুরের একটি বাক্য কেবল নমুনা হিসেবে এখানে উল্লেখ করছি:

এত অল্পসংখ্যক লেখা লিখে এবং জীবদ্দশায় একটিও উপন্যাস প্রকাশ না করে (আরো নিখুঁত করে বললে, একটি উপন্যাসও সম্পূর্ণ না লিখে), ফ্রানৎস কাফকা বিংশ শতাব্দীর বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকের অভিধা পেয়ে গেছেন। (পৃ-২০)


মাসরুরের গ্রন্থে ‘অনুবাদকের কথা’, ‘ভূমিকার আগে’ এবং ‘ভূমিকা’সহ ৭৬ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রচনার কোথাও বাক্যের ত্রুটিতো দূরের কথা, কোনো অস্বচ্ছতা, অপ্রাসঙ্গিকতা এবং অনাবশ্যক প্রগলভতা নেই। বিশ্বসাহিত্যের পরম্পরায় কাফকার সঠিক অবস্থানটিকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য যে বিপুল পরিমাণ তথ্যভান্ডারের মুখোমুখি তিনি হয়েছেন তাকে তিনি সামাল দিয়েছেন এবং বিন্যস্ত করেছেন নিপুণভাবে এবং নিষ্ঠা সহকারে। অন্যদিকে, মনোজ তার ‘প্রাককথন’ ও ‘ফ্রানৎস কাফকা জন্ম মৃত্যুর মাঝখানে’ নামক লেখা দুটোর মোট ৩৪ পৃষ্ঠায় কাফকা সম্পর্কে আমাদেরকে বলেন এক শিশুতোষ গল্প যা প্রায়শই কাফকার লেখা থেকে উদ্ধৃতির ভারে নুব্জ, এলোমেলো শব্দের কঙ্কালে ঠাসা, লক্ষ্যহীন ও ক্রুটিপূর্ণ বাক্যের বস্তিতে বিসদৃশ। বিশ্বসাহিত্যের পরম্পরায় কাফকার কী অবস্থান সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তো দূরের কথা, সামান্য ইশারাও নেই। অথচ কাফকাকে এর বাইরে; কেবল কাফকা কেন, কাউকেই পরম্পরার বাইরে গিয়ে সঠিকভাবে চিনে নেয়া সম্ভব নয়। মানবজাতির ইতিহাস, রাজনীতি, শিল্প ও সাহিত্যের যোগসূত্রগুলো লক্ষ্য না করলে কাফকাকে যেমন বুঝা যাবে না, তেমনি কাফকাকে বাদ দিয়েও আমাদের সময়ের আসল চেহারাটি বুঝা যাবে না। কাফকা সম্পর্কে স্বতন্ত্র এক প্রবন্ধে কার্লোস ফুয়েন্তেস আমাদেরকে এ ব্যাপারে আরও নিশ্চিত করে তোলেন ছোট্ট এই উক্তিটির মাধ্যমে:

Kafka, the fundamental writer of the terrible twentieth century, without Kafka, we could never understand the age we live in.
(This I believe, Carlos Fuentes, Random House, 2005, P-155)


কাফকার মতো এত শক্তিশালী ও প্রভাবক লেখক বিশ শতকে আর দ্বিতীয়টি নেই। আবার শিল্পের সুক্ষ্ম ও জটিলতর বুননের বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি কাফকার বক্তব্যের যাদুকরী প্রভাবের প্রেক্ষিতে মার্কিন সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম কাফকাকে বিশ শতকের অন্য দু’ তিনজনের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে যা বলেছিলেন তাও কাফকার শিল্পীসত্তা ও ভাবুকসত্তার স্বাতন্ত্র্যকে বুঝার জন্য খুবই দরকারি:

Kafka, as person and as writer, was a sequence of giant paradox. His large fictions-- The Trial and The Castle do not challenge Proust's In Search of Lost Time and Joyce's Ulysses, or even Mann's The Magic Mountain. And yet one thinks of the twentieth century as the era of Kafka and Freud, rather than of Proust and Joyce. ( Genius, Horald Bloom, Worner Books, 2000, P 204-205)


অর্থাৎ অন্য লেখকদের তুলনায় কাফকার শিল্পকুশলতার সবলতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা সাহিত্যের প্রতি ন্যায় বিচারের জন্য যেমন জরুরী, তেমনি কাফকার সার্বজনীন উপলব্দির বিশ্বপ্লাবী চুম্বকীয় শক্তির ব্যাপারেও সমান জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। এই সতর্কতাই আমাদেরকে সঠিক কাফকার কাছে নিয়ে যাবে। ব্লুমের সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায় কাফকা শিল্পকুশলতায় প্রুস্ত, জয়েস, এমনকি তার অনুজপ্রতিম লেখক মানের সমকক্ষ না হলেও, তাদের সম্মিলিত প্রভাবশক্তির তুলনায় কাফকার অবস্থান অনেক উপরে। ফলে কাফকাকে সঠিকভাবে বোঝার জন্য প্রচলিত হুজুগ এড়িয়ে আমাদের অনেক বেশি সতর্কতাও প্রয়োজন। এরকম একজন লেখককে ভূমিকা ও অনুবাদে উপস্থাপনের আগে যে প্রস্তুতি ও পান্ডিত্য, দক্ষতা ও পরিশ্রম দরকার তার কোনোটাই মনোজের নেই। অন্যদিকে, মাসরুর এই সব গুনের সমন্বয়ে কাফকাকে বাংলা ভাষায় যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা আমাদের মধ্যে গৌরববোধের অনুভূতি এনে দিতে পারে। খোদ ইংরেজিতেও আজকাল এই নিষ্ঠা ও পান্ডিত্য নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় খুব কম। মাসরুরের অনুবাদের দু'একটি নমুনা পরখ করার আগে এখনই আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো যে এই বইয়ের শেষে ‘পরিশিষ্ট’ বলে যে অংশটি আছে সেখানে রয়েছে মাসরুরের পরিশ্রম, পান্ডিত্য ও দক্ষতার দৃষ্টান্ত। ১২০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ পরিশিষ্টে প্রতিটি রচনার উৎস, বিভিন্ন সংস্করণের রূপ ও প্রকাশকালের উল্লেখ, রচনার পরিপ্রেক্ষিত ও উদ্দীপক কারণসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে। অর্থাৎ খুঁতখুঁতে ও অতিকৌতূহলী পাঠকদের পরিশ্রম ও সময়ের সাশ্রয় ঘটবে এই একটিমাত্র গ্রন্থেই, তাকে আর প্রাসঙ্গিক অন্যসব বইয়ের খোঁজে ছুটাছুটি করতে হবে না।

কাফকাকে নিয়ে আমাদের তিরিশ ও চল্লিশ দশকের প্রধান লেখদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন লেখা নেই তা আগেই বলেছি। যদিও ইংরেজি ভাষার বাইরে, স্প্যানিশ ভাষায় বোর্হেসের হাত ধরে ১৯৪৩ সালে এবং ফরাসি ভাষায় পল ক্লদেলের হাত ধরে ১৯৪৭ সালে কাফকা প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করেছেন। বলা যায় আমাদের এখানে পঞ্চাশের দশকের লেখকদের কেউ কেউ আশির দশকে প্রথম তার ব্যাপারে কৌতুহলী হয়ে উঠলেন। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের পর প্রায় পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ নিরবতার যৌথ অপরাধের একক প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই যেন মাসরুর আমাদের সামনে কাফকার এক পরিপূর্ণ ও নির্ভুল উপস্থাপন নিয়ে হাজির হলেন।

কাফকা অনুবাদ বা চর্চার পেছনে আমাদের এই বিলম্বের পেছনে কী কারণ তা কেবল অনুমান করা সম্ভব।
মনে পড়ছে, কাফকা সম্পর্কিত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনটি ছিলো ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়ের কাফকা বিচার  নামক সম্পাদিত বইটি যেটি বেরিয়েছিলো আশির দশকের মাঝামাঝি। কিন্তু কাফকার রচনার গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ, ভূমিকা ও পাঠ-পর্যালোচনাসহ মাসরুরের বইটি প্রথম না হলেও অতুল্য মানে এটি অদ্বিতীয়। মানের প্রশ্নে আসুন এবার অনুবাদের দু‘একটি নমুনা পরখ করে দেখা যাক। কাফকাকে নিয়ে আধুনিক যুগের প্রায় সব বড় লেখকরাই লিখেছেন। কিন্তু কাফকাকে নিয়ে বোর্হেসের ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় গোটা পাঁচেক লেখা রয়েছে, তার মধ্যে ‘কাফকা এবং তার পূর্বসূরী’ এবং ‘ফ্রানৎস কাফকা, শকুন’,--এ দুটি লেখাই সবচেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী। মাসরুর তার গ্রন্থে দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ব্যবহার করেছেন। মনোজও এই প্রবন্ধটাই ব্যবহার করেছেন তার বইয়ে। কিন্তু গল্পগুলো অনুবাদের জন্য ইংরেজি কোন অনুবাদকের উপর ভরসা করেছেন তার কোনো উল্লেখ নেই মনোজের বইটিতে। অথচ কাফকার ইংরেজি অনুবাদের মান ও বিশ্বস্ততা নিয়ে আছে বহু বিতর্ক। এমনকি এও বলতে শুনি যে কাফকাকে মূলে না পড়লে নাকি তাকে মোটেই পাঠ করা বুঝায় না:

“Have you read Kafka?” Milan Kundera asks me.
“Of course,” I reply. “To me, he is the essential writer of the twentieth century.”
Kundera smiles scornfully. “Have you read him in German?” he asks.
“No.”
“Then you have not read Kafka.”
(This I believe, Carlos Fuentes, Random House, 2005, P-155)


তাই যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের মতো আলেমান না-জানা অনুবাদকদের জন্য দরকার অনেক বেশি সতর্কতা। ফলে বিশ্বস্ততার মানদণ্ডে মোটামুটিভাবে নির্ভরযোগ্য ইংরেজি অনুবাদের উপর ভরসা না করলে বাংলা অনুবাদে আমরা সঠিক কাফকাকে পাবো না কোনোভাবেই। মাসরুর এই ব্যাপারে সতর্ক থেকেছেন বলে ‘অনুবাদকের কথা’য় তিনি  আমাদেরকে জানাচ্ছেন :

পাঠকের জানার জন্য বলে রাখছি, ইংরেজিতে কাফকার গল্পগুলোর ক্ষেত্রে (উপন্যাস নয়) ম্যালকম প্যাসলির অনুবাদের চেয়ে আক্ষরিক ও বিস্বস্ত কোনো অনুবাদ নেই; আর অন্যদিকে আন্ডারউডের চেয়ে বেশি পাঠযোগ্য, তরতরে কোনো ইংরেজি ভাষান্তর নেই। আমি যেমনটা আগেই বলেছি বিশ্বস্ততাকে রেখেছি পাঠযোগ্যতার উপরে, তাই উপরের তালিকায় ম্যালকম প্যাসলির নামটিই রয়েছে সবার আগে। ওটাই প্রামান্য ধরে এগিয়েছি মোটামুটি সবসময়। (পৃ: ১৫


অনুবাদের নমুনা হিসেবে কাফকার The Transformation and other stories  বা রূপান্তর নামক ছোট্ট উপন্যাস বা বড়গল্পের ইংরেজি ও বাংলায় কয়েকটি পংক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমে প্যাসলির অনুবাদ:

When Gregor Samsa awoke one morning from troubled dreams he found himself transformed in his bed into a monstrous insect. He was lying on his hard shell-like back and by lifting his head a little he could see his curved brown belly, divided by stiff arching ribs, on top of which the bed-quilt was precariously poised and seemed about to slide off completely. His numerous legs, which were pathetically thin compared to the rest of his bulk, danced helplessly before his eyes.
"What has happened to me?" he thought. It was no dream."
(The Transformation and other stories, penguin , 1992, P-76)


এবার আন্ডারউড থেকে একই অংশের ইংরেজি অনুবাদটা দেখুন:

"Greagory Samsa woke from uneasy dreams one morning to find himself changed into a giant bug. He was lying on his back which was of a shell-like hardness, and when he lifted his head a little he could see his dome-shaped brown belly, banded with what looked like reinforcing arches, on top of which his quilt while threatening to slip off hold. His many legs, pitifully thin in relation to the rest of him, threshed ineflectully before this yes.
What's happened to me?' he thought. This was no dream."
(Franz Kafka: Stories 1904-1924, Rupa & co, 1992, P-91)


মনোজ চাকলাদার এর অনুবাদ করেছেন এভাবে:

এক সকালে অস্বস্তিকর স্বপ্ন থেকে গ্রেগর সামসা জেগে ওঠে, দেখে একটা বিরাট বড়ো পোকায় রুপান্তরিত হয়ে গেছে। শুয়ে আছে শক্ত কিছুতে, বলতে গেলে বর্মের ঢালের উল্টো দিকে, মাথাটা একটু তোলে, দেখতে পায় তার টোমের মতো বাদামী পেটের উপরিভাগটা যেখান থেকে দুটো ভাগ হয়ে গেছে, কোনওরকমে লেপটা লেগে  রয়েছে, যেন পিছলে পড়ে যাচ্ছে। তার বিদঘুটে পাগুলো শরীরের আয়তনের তুলনায় করুনভাবে খুবই সরু, তার চোখের সামনে অসহায়ভাবে দুলছে। আমার কী হয়েছে, ভাবে সে। এতো স্বপ্ন নয়। (পৃ:১৩১)


এবার মাসরুরের অনুবাদে কী দাঁড়িয়েছে তা দেখা যাক:

এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় পড়ে আছে এক দৈত্যাকার পোকায় রুপান্তরিত হয়ে। তার কঠিন খোলার মতো পিঠের উপর সে শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, আর মাথা অল্প তুলতেই তার  চোখে পড়ল গম্বুজ আকারের বাদামি পেট, শক্ত ধনুকের মতো বাঁকানো অসংখ্য শিরায় ভাগভাগ, আর তার উপর লেপটা ঝুলে আছে কষ্টেসৃষ্টে, মনে হচ্ছে পুরোপুরিই পিছলে পরবে যে কোনো সময়। তার অগুনতি পা, শরীরের বাকি অংশের তুলনায় শোচনীয় রকম সরু সরু, অসহায়ভাবে লাফাচ্ছে চোখের সামনে।‘কী হলো আমার’ ভাবল সে। কোনো কিছুই স্বপ্ন না। (পৃ: ১৮৫)


প্যাসলি এবং আন্ডারউড মূল জার্মানের কতটা কাছে বলতে পারবো না, তবে বাংলায় দুই অনুবাদকই ইংরেজি অনুবাদের কাছাকাছি থাকলেও মনোজের তুলনায় মাসরুরের বাংলা রূপটি অনেক বেশি সুখপাঠ্য ও বাক্যগঠনে সুশৃঙ্খল। মনোজ বেশ কিছু শব্দের ভাষান্তর বাদ দিয়ে গেছেন।  অন্যদিকে মাসরুর অভিব্যক্তির পূর্ণাঙ্গতাকে হাজির করেছেন। কেবল শেষ বাক্যটিকে, ‘কোনো কিছ্ইু স্বপ্ন নয়।’-এর পরিবর্তে ‘এতো স্বপ্ন নয়।’ বললে বেশ ভালো হতো।

মনোজের অনুবাদ শিশুর মতো ভাঙা ভাঙা বাক্যে গড়া। সবগুলোকে অর্থের শক্ত বাঁধনে এনে যে পূর্ণাঙ্গ বাক্য গঠনের সৌন্দর্য সৃষ্টি করা দরকার সেটা তার মধ্যে নেই। ইংরেজি Dome শব্দটা নিয়ে কী করবেন বুঝতে না পেরে ওটাকে ইংরেজির কাছাকাছি রেখে দিয়ে বলেছেন ‘টোমের মতো’। কিন্তু বাংলায় টোম-এর কী অর্থ তা আমার জানা নেই। মনোজ নিজেই কি জানেন এর কী অর্থ? টোমের পরিবর্তে ইংরেজি Dome শব্দটাই রেখে দেয়া ছিলো খানিকটা নিরাপদ। এত হাস্যকর ভাষাজ্ঞান নিয়ে তিনি কেন এটা অনুবাদ করতে গেলেন বুঝলাম না ।এটি ছাড়াও তিনি বেশকিছু গল্পের যে অনুবাদ করেছেন তা কখনো মনগড়া, কখনো ভুল; ইংরেজির সঙ্গে তার অনেকক্ষেত্রেই নেই কোনো মিল। আরেকটি নমুনা দেখা যাক A Fasting-Artist গল্প থেকে। প্যাসলি লিখেছেনঃ

“ Public interest in exhibition fasting has suffered a marked decline in recent decades. While one used to be able to make good money by mounting independent productions of this kind on quite a large scale, today that is quite impossible. Time has changed. In those days the fasting-artist was the talk of the town; from day to day of his fast enthusiasm grew; each day everyone wanted to go and see the fasting-artist at least once.”(p-210)


আন্ডারউড থেকে:

“Interest in fasting as an art has declined very considerably in recent decades. Whereas it used to be well worth staging major performances in this discipline on an entrepreneurial basis, nowadays that is quite impossible. Times have changed. Then the whole city used to be involved in what the fasting-artist was doing; everybody wanted to see the fasting-artist at least once daily;” ( p-242)


কিন্তু বাংলায় আলোচ্য দু’জনের অনুবাদে আছে বিস্তর ফারাক। মনোজ এই বাক্যগুলোর অনুবাদ করেছেন এভাবে:

গত কয়েক দশক ধরে মজার অনশন প্রদর্শনী উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এসব বড় খেলাগুলো হত একজন সুদক্ষ পরিচালকের তত্তাবধানে। এতে বেশ পয়সাও পাওয়া যেত, কিন্তু আজকাল তা অসম্ভব। এখন আমরা এক ভিন্ন জগতে বাস করছি। এক সময়ে অনশন প্রদর্শন শহরের লোকদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগাত। পড়ে যেত প্রচন্ড শোরগোল। দিনকে দিন এর উত্তেজনা চরমে উঠত; দিনে অন্তত সকলে একবার দেখতে চাইত।


মনোজ এই গল্পের নাম রেখেছেন ‘এক অনশন-শিল্পী’ নয়, বরং ‘অনশন প্রদর্শক। ’শিল্প ’  কোন অপরাধে ‘প্রদর্শক’ হয়ে যাচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ভুল শব্দার্থে এবং ভুল  বাক্যার্থে যে অনুবাদ তিনি করেছেন তাকে কোনোভাবেই বিশ্বস্ত অনুবাদ বলা যায় না । মাসরুরের অনুবাদে এই অংশটুকু এসেছে এভাবে:

অনশন-শিল্পীদের ওপরে মানুষের আগ্রহ বিগত কয়েক দশকে বেশ কমে গেছে। আগে যেখানে যে-কেউ নিজের উদ্যোগে ওরকম প্রদর্শনীর বড় মাপের আয়োজন করলে অনেক টাকা কামাতে পারত,আজ তা অনেকটাই অসম্ভব। দিনকাল বদলে গেছে। তখনকার দিনে অনশন-শিল্পীকে নিয়ে সারা শহর কী রকম মেতে থাকত; তার না-খেয়ে থাকার দিন যত পার হতো, মানুষের উদ্দীপনা আরো বাড়ত’, সবাই রোজ অন্তত একবার করে হলেও চাইত অনশন-শিল্পীকে দেখতে যাবে;


বাক্যের সৌন্দর্য, সাবলীলতা, নির্ভুলতা এবং বিশ্বস্ততার প্রশ্নে মাসরুরের সাফল্য আমাদেরকে চমৎকৃত না করে পারে না। কিছুই বর্জন করছেন না এবং মনগড়া কিছু জুড়েও দিচ্ছেন না তিনি। ইংরেজি অনুবাদে  যা আছে এবং যেভাবে বলা হয়েছে প্রায় হুবহু সেভাবেই বলার চেষ্টা করেছেন মাসরুর। দুজনের পার্থক্য বুঝতে গেলে আমরা দেখবো গল্পের একেবারে শিরোনাম থেকেই মনোজ ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। অন্যদিকে, মাসরুর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে-- ইংরেজি ও বাংলায় সঠিক ভাষাজ্ঞানের নিশ্চিত ভরসায়-- প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মূলানুগতাকে উদ্বিষ্ট ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এই মূলানুগতা ছাড়া কাফকার মতো অতিসংবেদনশীল শিল্পীর স্বরূপটা আমরা পুর্ণাঙ্গভাবে পাবো না। বর্ণনা কৌশল, ভাষার পরিমিতি, বাচনভঙ্গি যদি আন্ডারউড সঠিকভাবে ইংরেজিতে ধরে থাকেন তাহলে মাসরুর তা সর্বোচ্চ দায়িত্ববোধের সঙ্গে আমাদেরকে বাংলাভাষায় উপহার দিয়েছেন।একজন লেখক কী বলছেন সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কিভাবে বলছেন সেটাও সমান গুরুত্ববহ। বলার ভঙ্গিটিকে যদি অনুবাদে বদলে ফেলা  হয় এবং ভুলভাবে অনুবাদ করা হয় তাহলে লেখকের শৈলী সম্পর্কে আমাদের মধ্যে সঠিক কোনো ধারণা তৈরি হওয়ার সুযোগ পায় না। মনোজ এই জায়গাটিতে পুরোপুরি ব্যর্থ। এমনকি কাফকার বক্তব্যকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও ব্যর্থ তিনি। প্রদর্শনীকে তিনি বলছেন ‘খেলা’, এবং সেটা ‘মজার’ খেলা, ‘শিল্পী’কে তিনি বলছেন ‘প্রদর্শক’। এ রকম আরও বহু ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির কলঙ্কে তার বইটি কদাকার,ফলে অপাঠ্য। মাসরুর এই দুই কলঙ্ক থেকেই নিজেকে মুক্ত রেখেছেন প্রতিটি অনুবাদে।

মাসরুরের অনুবাদ সুখপাঠ্য--এটা এই বইয়ের একটি প্রধান গুণ। পাশাপাশি এর ভূমিকাটিও কাফকা সম্পর্কে আমাদের বহুভ্রান্তি যেমন ঘোচাবে, তেমনি পাওয়া যাবে কাফকা সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন ও মূল্যায়নের আনুপূর্বিক ইতিহাস। কাফকা সম্পর্কে এটি এ পর্যন্ত বাংলায় দীর্ঘতম লেখা হিসেবেই নয়, তথ্যের সমাহারে ও বিশ্লেষণেও এটি অনন্য। কাফকা নিয়ে আমার সামান্য আগ্রহ থেকেই বুঝেছি এটি লিখতে গিয়ে মাসরুর সমুদ্রমন্থন করে অমৃত বের করার দানবীয় পরিশ্রম স্বীকার করে নিয়েছেন। তবু কোনোশিল্পই যেমন চুড়ান্ত বিচারে নিখুঁত নয়, হতেও পারে না, তাই এই ভূমিকার দু’একটি মন্তব্যও আমার মধ্যে বিনীত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন:

এ কথাতো অগ্রাহ্য করা যাবে না যে কাফকার লেখার একেবারে মূলে আছে আধুনিক পৃথিবীতে ব্যক্তির একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা। (পৃ-৬৩)


৯৭/ ৯৮ সালে কাফকাকে নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম জনকন্ঠে । সেখানে এই নিঃসঙ্গতার বিষয়ে যা বলেছিলাম তা এই মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক হতে পারে ভেবে পুনরুক্তি করছি বলে পাঠক ক্ষমা করবেন:

“বিচার-এর শুরুতেই আমরা জোশেফ কে’ নামের এক ভদ্রলোককে দেখতে পাই যিনি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। একটি বাসায় তিনি একাকী থাকেন। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তিনি প্রায় প্রস্তুত। অবশ্য নাস্তাটা এখনও করা হয়নি। বাড়িউলীর রাঁধুনী রোজই সকাল আটটায় তার নাস্তা দিয়ে যায়। কিন্তু আজ সে আসছে না কেন? ব্যাপার কী? এ রকম তো কোন দিন হয় না। অবশেষে কিছুটা বিরক্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে সে ঘন্টা বাজায়। আর তখনই তার দরজায় এ্যানা নয়; এক অচেনা লোক এসে দাঁড়ায়। জোশেফ কে’  ধীরে, ধীরে জানতে পারে লোকটি একজন প্রহরী এবং কে’কে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং আমরা এও লক্ষ্য করি যে কে’-এর একাকীত্বের জীবনকে তারা প্রতি মূহুর্তে ক্ষুন্ন করছে। সে আদৌ একা হতে পারছে না। কোর্ট তাকে অনুসরণ করছে, তার সাথে কথা বলছে--এটা তার ভাবনার মধ্যে কাটার মত বিধে আছে। তার একাকীত্বের জীবন প্রতি মুহূর্তে ধর্ষিত হচ্ছে। তাঁর দুর্গ  উপন্যাসেও একই অবস্থা। ভুমিজরীপকারী কে’ নামের এই চরিত্রটির গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য দুর্গ থেকে  একজন লোক দেয়া হয়; তারা প্রতি মুহূর্তে তাকে অনুসরণ করে। সে কখনোই একা হতে পারে না। যখন সে ফ্রিডার সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলছে তখনও সেই লোক দুটি কাছাকাছি অবস্থান করছে। অর্থাৎ প্রতিটি মুহূর্তে রহস্যময় প্রতিষ্ঠানগুলো কাফকার চরিত্রগুলোর একাকীত্বকে হরণ করছে নানান ছলছুতোয়। আর এটাই হচ্ছে চরিত্রগুলোর ট্রাজেডী।”



এই বিষয়ে চেক লেখক মিলান কুন্ডেরার The art of Novel গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত Somewhere behind লেখাটি  যে-কেউ পড়ে দেখতে পারেন। কুন্ডেরার ব্যাখ্যাকে সমর্থনযোগ্য মনে হয়েছে বলে আমার নিজের লেখাটিতে তার প্রতিধ্বনি করেছি। মাসরুরের এই সুলিখিত দীর্ঘ ভূমিকার কোথাও প্রাসঙ্গিক সূত্রে  কুন্ডেরার নাম উল্লেখিত হলে পাঠকের আস্থা আরও বাড়ানো যেত বলে মনে হয়। কারণ কাফকা মূল্যায়নে এবং পুনর্বাসনে কুন্ডেরার ভূমিকাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করেন সবাই। যেহেতু তিনিও চেক, তায় বিশ্বের প্রথম সারির ঔপন্যাসিক এবং সাহিত্য সমালোচক। হয়তো এমন হতে পারে মাসরুর তার প্রতিশ্রুত পরবর্তী খণ্ডে তাকে উল্লেখ করার পরিকল্পনা করে রেখেছেন। আরেকটি ছোট্ট দ্বিমত প্রকাশ করবো বিনয়ের সাথে। কাফকার উপর প্রভাবের সূত্রে পূর্বসুরীদের একটা তালিকা আমরা দেখতে পাবো ‘ভূমিকার আগে’-তে, তাতে কোনোভাবে যদি গ্রিক দার্শনিক জেনো এবং লাতিন ভাষার আলজেরিয় লেখক লুসিয়াস এপুলিয়াসের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যেত তাহলে পূর্ণাঙ্গতার গৌরব অনেক বেড়ে যেত। কারণ কাফকার আত্মার গহীনে যেমন ছিলেন জেনো (গতিহীনতার ধাঁধার অর্থে), তেমনি  বহিরঙ্গে, গায়ে চড়িয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আপুলিয়াসের রূপান্তরের (Golden Ass বা Metamorphosis-- উভয় নামেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত) যাদুকরী পোষাক। কাফকায় জেনোর উপস্থিতির  কথা বোর্হেসই সম্ভবত প্রথমবারের মতো উল্লেখ করেছিলেন তার ‘কাফকা ও তার পূর্বসুরী’ নামক ছোট্ট প্রবন্ধটিতে। আর এপুলিয়াসের উপস্থিতি এতটাই প্রত্যক্ষ কাফকার রূপান্তর গল্পে যে ভ্রম হয় তিনি বুঝিবা আধুনিক যুগে এসে দুই হাজার বছরের একটি পুরোনো গল্পেরই পুনর্কথন করছেন। পার্থক্য এই যে এপুলিয়াসের ‘গাধা’ এখানে রূপান্তরিত হয়েছে  ‘এক দৈত্যাকার পোকায়’; একজন রূপান্তরিত হচ্ছে ডাকিনীর রোষানলে পড়ে আর অন্যজন সভ্যতার অভিশাপে।


মানবজাতির ইতিহাস, রাজনীতি, শিল্প ও সাহিত্যের যোগসূত্রগুলো লক্ষ্য না করলে কাফকাকে যেমন বুঝা যাবে না, তেমনি কাফকাকে বাদ দিয়েও আমাদের সময়ের আসল চেহারাটি বুঝা যাবে না।

মাসরুরের ভূমিকাটি যেহেতু আমাদেরকে এমন অনেক কিছু দিয়েছে যা আগে আর কখনো পাইনি, তাই এই প্রত্যাশাও আমাদের মধ্যে জেগে ওঠে প্রশ্ন আকারে: কেমন হতো যদি এতে কাফকার শিল্পকুশলতার দিকটিকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতো? কেননা শিল্পকুশলতার প্রশ্নে ব্লুম যে-পার্থক্যটির প্রতি আমাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছিলেন তাকে গুরুত্ব না দিলে কাফকার শক্তি ও দুর্বলতাকে আলাদা করে বুঝা যাবে না। আমার এই প্রত্যাশাকে গৌণ ধরে নিলে মাসরুরের ভূমিকাটিকে কাফকা বিষয়ে একটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ রচনা বলা যায়। মাসরুর এই বইয়ের মাধ্যমে কাফকা অনুবাদ ও চর্চায় যে- লক্ষণীয় মাত্রা যোগ করেছেন তা আমাদের কাছে  এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে-- এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি এর বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করি।  

(কালের খেয়া সাময়িকীর ১৭/০১/২০১৪ তারিখে প্রকাশিত লেখাটিরই ইষৎ বর্ধিত রূপ এটি। )

 

 

**********

ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র
মাসরুর আরেফিন


প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ
প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০১৪
পৃষ্ঠা: ৪৭৩

মূল্য: ১১৯৫.০০ টাকা

ISBN: 9789848866672

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ