দীপান ভট্টাচার্য রচিত 'সিন্ধু সভ্যতায় শাঁখা ও অগস্ত্যযাত্রা' বই সম্পর্কে ঋজু গাঙ্গুলি

দীপান ভট্টাচার্য রচিত 'সিন্ধু সভ্যতায় শাঁখা ও অগস্ত্যযাত্রা' বই


শাঁখা তথা শঙ্খ বাংলার সমাজে প্রচলিত আচার-ব্যবহারে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ইতিহাস পড়ার সুবাদে আমরা জানি, সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতায় এর একাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। কিন্তু উপমহাদেশের ওই রুক্ষ-শুষ্ক অঞ্চল থেকে বহুদূরে এই বাংলায় সেই আচার এল কীভাবে? এ কি শুধুই সমুদ্রবাণিজ্যের স্মারক এবং সেই সুবাদে সৌভাগ্যের চিহ্ন? নাকি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্য কোনো ইতিহাস?

এই ধরনের নানা প্রশ্ন নানা সময় আমাদের মাথায় আসে। সেই প্রশ্নগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে কিছু প্রশ্ন আসে এমন একজনকে নিয়ে— যাঁর সঙ্গে পুরাণের বেশ কিছু অলৌকিক, অসম্ভব কীর্তি জড়িয়ে আছে। তিনি হলেন অগস্ত্য! তাঁর জন্ম থেকে শুরু করে পরিণতি— সবই রহস্যময়। কে তিনি? কী করেছিলেন তিনি?

আলোচ্য বইটি, যা একাধিক গবেষণাপত্রের সমাহার বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না, এই দুটি আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র চিন্তার তন্তুকে ডাবল হেলিক্সের মতো করে মুখোমুখি এনেছে। সেই ডি.এন.এ-ই কি আমাদের প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান দেয়? সেই বিচারের আগে আমরা বরং দেখি, কী আছে এই বইয়ে।

'শুরুর কথা'-র পর এই বইয়ের যাবতীয় লেখাকে তিনটি অংশে ভাগ করা চলে। তারা হল~


(ক) সিন্ধু সভ্যতা:
১. সিন্ধু সভ্যতা ভ্রমণ;
২. সিন্ধু সভ্যতায় শাঁখা বানানোর পদ্ধতি;
৩. সিন্ধু সভ্যতায় শাঁখার ব্যবহার;
৪. বাংলার শাঁখার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

(খ) অগস্ত্য:
৫. শাঁখারিদের দেবতা অগস্ত্যের সন্ধানে;
৬. অগস্ত্যের রাজনৈতিক পরিচয়;
৭. পুরাণ ও তার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য;
৮. দ্বারকার খনন ও নিষ্পত্তি;
৯. দক্ষিণের আকাশে অগস্ত্য নক্ষত্রের উপস্থিতি।

(গ) পরিশিষ্ট:
ক] '৮৩-'৮৮ খননে হরপ্পায় শাঁখার নিদর্শন;
খ] সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-কৃত অনুবাদে তরু দত্তের 'যোগাদ্যা উমা';
গ] সপ্তর্ষিদের পরিচয়;
ঘ] সঙ্গম সাহিত্য থেকে ভেলি রাজাদের নাম;
ঙ] পোদুকোট্টাই রাজ্যের কুদুম্বালুর শিলালেখ;
চ] সিন্ধু সভ্যতায় শঙ্খ থেকে বানানো বিভিন্ন অলংকার ও অন্য বস্তু।
এরপর এসেছে 'পরিভাষা' ও 'তথ্যসূচি'।


কেন এই বইটি আমাদের কাছে অবশ্যপাঠ্য?

প্রথমত, পাঠ্যবইয়ে আমরা সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে যা জানি, তা অত্যন্ত সীমিত। এই সভ্যতা যে কতখানি শিল্পোন্নত ছিল, তার একটি স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় এই বই থেকে।


দ্বিতীয়ত, শাঁখা জিনিসটা যে সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দৃষ্টিতে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা এই বই না পড়লে বোঝা কঠিন।

তৃতীয়ত (এবং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ), অগস্ত্য! বাতাপি-ইল্বল বা সমুদ্র-শোষণ গোছের গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই মানুষটির আসল পরিচয়ের অনুসন্ধান ও তাৎপর্য আমার ধারণারও বাইরে ছিল। এই বইয়ে লেখকের যুক্তিক্রম অনুসরণ করার পর কার্যত আমিও বাধ্য হয়েছি তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে। তবে এই ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এই মিথগুলোর আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ভরসা রাখি যে লেখক পরে সেই বিশ্লেষণটিও আমাদের সামনে পেশ করবেন।

শাঁখা জিনিসটা যে সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দৃষ্টিতে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা এই বই না পড়লে বোঝা কঠিন।
লেখনী অত্যন্ত সহজ। বক্তব্যের মধ্যে মিশে আছে বহু কিংবদন্তি ও অন্য গল্প। কিন্তু এই বইয়ের মূল আকর্ষণ এর প্রতিপাদ্যে। লেখক কার্যত হাত ধরে আমাদের নিয়ে চলেন এক দেশ-কাল থেকে অন্য এক দেশ-কালে। চোখের সামনে গড়ে ওঠে সভ্যতা, তারপর তা রিক্ত হয়ে পড়ে। ক্রমে সবকিছু হারিয়ে যায় নিষ্করুণ বালি, মাটি, জল, আর কালের গভীরে। তবু মানুষ থেমে থাকে না। সে এগিয়ে চলে অন্য কোথা, আর কোনোখানে।

এই বই পাঠকের কাছ থেকে গভীর মনোযোগ দাবি করে। কিন্তু সেই মনোযোগটি দিতে পারলে এ হয় এক আশ্চর্য পথচলা— যাতে চেনা জিনিস দেখা দেয় অচেনা ও নতুন হয়ে।


এই অসাধারণ যাত্রাটিতে আমাদের পথপ্রদর্শক হওয়ার জন্য লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। প্রকাশক আলোকচিত্র ও স্কেচের যথাযথ মুদ্রণ করে বইটিকে সমৃদ্ধতর করে তুলেছেন; তাঁকেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

ভরসা রাখি যে বিদ্যোৎসাহী পাঠক এই বইটিকে আপন করে নেবেন। সেক্ষেত্রে লেখকের কাছে আরও একটি সুপ্রাচীন বস্তুকে নিয়ে কাজের দাবি জানাতে সাহস পাব। সেটি হল সিঁদুর। এর সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে এত মিথ্যা ও আকথা-কুকথা প্রচলিত যে একটি নিবিড় অনুসন্ধান অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।


ইতিমধ্যে, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী হলে এই বইটিকে কোনোমতেই উপেক্ষা করবেন না।


**********
সিন্ধু সভ্যতায় শাঁখা ও অগস্ত্যযাত্রা'
দীপান ভট্টাচার্য


প্রকাশনী: শব্দ প্রকাশন, কলকাতা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৩২০
প্রকাশকাল: ২০২৪
মূল্য ৫৫০

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ