বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও অন্যান্য - আশুতোষ বিশ্বাস

আশুতোষ বিশ্বাস  রচিত ‘বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও অন্যান্য’ বইয়ের প্রচ্ছদ



বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবিগণের রচনার বিশ্লেষণ বিষয়ক লেখালেখির পরিমাণ অপ্রতুল। নতুন সময়ের নতুন দশকের কবিলেখকগণের আলোচনা করতে আমরা বড় কৃপণ। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের এমন শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এসেছেন কবি, শিক্ষক, গবেষক আশুতোষ বিশ্বাস। কর্মসূত্রে তিনি শিক্ষক হলেও আজীবন থেকে গেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। ছড়িয়ে দেন কবিতার দ্যুতি। এক অপার কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাংলা ভাষার সাহিত্যসম্ভারের দিকে। সম্পাদনা করেন আলোক কণার সাহিত্য পত্রিকা 'তারারা'। সন্ধিৎসু ছাত্রের আবেগ ও দীর্ঘ চর্চার অভিজ্ঞান দুইয়ের প্রেরণায় খোঁজেন মণিমুক্তা। সৌভাগ্যের বরে তার হাত ভর্তি হয়ে যায়। বাংলা ভাষার মূঢ় পাঠকদের সামনে ছড়িয়ে দেন প্রাপ্ত রত্নাবলী। তেমনই একটি মণিমাণিক্য খচিত আলোচনা সম্ভার তিনি সম্প্রতি বাংলা সাহিত্যসভায় উপস্থাপন করেছেন। একাধিক কবির সাহিত্যকীর্তির আলোচনা সমালোচনা সমৃদ্ধ অমূল্য গ্রন্থটির নাম ‘বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও অন্যান্য’। বইয়ের শিরোনামের মর্ম বোঝা যায় সূচিপত্র পাঠে।


সূচিপত্র


  • ফিরে দেখা: বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি
  • শামসুর রাহমানের কবিতা: অস্থির রাজনীতির সুস্থির দিশা নির্দেশক
  • যৌনতার নন্দনবিশ্ব: আল মাহমুদের 'সোনালি কাবিন'
  • শহীদ কাদরী: প্রিয়কে অভিবাদন
  • হুমায়ুন আজাদ: এক নিঃসঙ্গ কবি-পুরুষ
  • কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ: বিমূঢ় সময়ের বিভ্রান্তির কবি নন
  • সাম্য রাইয়ানের কবিতা: শান্ত সমাহিত ঘাসে ঘাসে মুকুলিত বুনোফুল-প্রশস্তি
  • গ্রন্থ সহায়তা
  • সহায়ক পত্র-পত্রিকা


প্রথম প্রবন্ধ ‘ফিরে দেখা: বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি’ রচনাটি বেশ তথ্যসমৃদ্ধ। ১৯৭১ এর পরের দশকে রচিত বাংলা কবিতা সম্পর্কে সারগর্ভ আলোচনা করেছেন। লেখক ধরে ধরে তাদের কাব্যবোধ, মনোভঙ্গি, স্বকীয় শৈলী প্রভৃতি উন্মোচন করেছেন। রচনার বাক্যে বাঁকে গবেষকের নিষ্ঠা স্পষ্ট। সাহিত্যের এই মুক্তির দশকে পাঠকের কী প্রত্যাশা ছিল, আর কী প্রাপ্তি ঘটেছে সে বিষয়ে পাই তথ্যনির্ভর উপস্থাপন।

কবিগণের প্রত্যেকে ছিলেন পূর্ববর্তী দশকের উত্তাল সময়ের যাত্রী। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রত্যেকের চেতনায় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। এদের রচনাসম্ভার যুদ্ধোত্তর বাঙালির রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি হতে পারত। প্রসঙ্গক্রমে লেখক সাক্ষ্য মেনেছেন ফরিদ আহমদ দুলালের একটি মতকে। ফরিদ আহমদ দুলাল বলেছিলেন-


যাদের চেতনায় এতসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুসঙ্গ হয়ে তোলপাড় করে, তাদের কবিতার বিষয়, মেজাজ ও বাক্যবন্ধ বৈচিত্র্যপূর্ণ হবে- অনেক বেশি সাহসী হবে সে কথা তো বলাই বাহুল্য। সত্তরের কবিতা হবে তেজদীপ্ত-ঋজু ও অহংকারী। পৃষ্ঠা- ১৬



এই কবিগণ প্রত্যেকে একাত্তর পূর্ববর্তী অস্থির সময়ের শিকার; একাত্তরের নৃশংস জীবনচিত্র হৃদয়ে অংকিত। কিন্তু কবিগণের কাছে নতুন দেশ, নতুন ভাবনা, নতুন সময় নিয়ে যে প্রত্যাশা ছিল, তা আর সেভাবে পূরণ হল না। গ্রন্থলেখক জানান-


কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন মনোভূমে সত্তরের কবিরা সেভাবে ছাপ রাখতে পারলো না। কবিতা-পাঠক সাধারণের হৃদয়ে পাহাড়সমান উচ্চাশা পূরণে ব্যর্থ হলেন। পৃষ্ঠা- ১৬-১৭



একই প্রসঙ্গে মাহবুব হাসানের একটি বক্তব্য উপস্থাপন করে লেখক নিজের চিন্তার যথার্থতা প্রতিপাদন করেছেন। মাহবুব হাসান বলেছেন-


স্বাধীনতা যুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভ বা অর্জন দুটি ভিন্ন মাত্রায় স্থাপিত হলেও সত্তরের অনেক কবিই এর দু-এর মধ্যকার তাৎপর্যপূর্ণ ফারাক বা বিন্যাস উপলব্ধি করতে পারেননি। পৃষ্ঠা- ১৭



এই বিষয়টি নিয়ে সমালোচক আশুতোষ বিশ্বাস একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন। গবেষকের প্রাজ্ঞতা নিয়ে আমাদের জানান যে, কবিগণ আসলে দশকের পর দশকব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান চাচ্ছিলেন। এত বেশি অভিঘাত বইতে বইতে তারা ক্লান্ত। উচ্চকণ্ঠ বহনের দায় থেকে তারা মুক্তি খুঁজতেছিলেন। হয়ে উঠলেন আত্মমগ্ন, অন্তর্মূখী। প্রতিবাদ ও আক্রমণহীন ভুবনে জলের মত এক শান্ত ও নিস্তরঙ্গ জীবনের জন্য উন্মুখ হলেন। লেখক বলেন -

আর এই কারণেই সত্তরের কবিরা হয়েছেন মিতভাষী, রোমান্টিক স্বপ্নমেদুর, বিকেলের রঙিন মেঘের ঘোড়ায় চড়ে পারি দিতে পেরেছেন মননের সপ্তসিন্ধুপারে। পৃষ্ঠা- ১৮



প্রায় পয়তাল্লিশ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ আলোচনায় তিনি প্রায় পঁচিশজন কবির কাব্যকীর্তি আলোচনা করেছেন। চল্লিশটি উৎসের তথ্য ব্যবহারে নিজের মতামতকে করেছেন সুদৃঢ়। বইয়ের ছাপ্পান্নতম পৃষ্ঠায় তিনি স্বীকার করেন যে,


বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, এটা ঠিক যে এই আলোচনা সম্পূর্ণ হবার নয়। পৃষ্ঠা- ৫৬



তিনি সবিনয়ে নিজের আলোচনার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন। রচনাটিতে প্রায় পঁচিশজন কবিকে আলোচনা করা হলেও তিনি আরো একাধিক কবিকে সত্তর দশকের কবি হিসেবে উল্লেখযোগ্য মনে করেন।


কবি-শিল্পীর চোখে নতুন স্বপ্ন দানা বাঁধতে না বাঁধতে স্বপ্নভঙ্গের কঠিন চড়া বাস্তবতা ডানা মেলে ধরে। তাই সত্তর দশক বড়োই অসহিষ্ণু, বড়োই ভঙ্গুর, বেদনাঘন, ভাঙা স্বপ্ন জোড়া লাগাতে সত্তর দশকে বিপুল সংখ্যক কবি-শিল্পী আবির্ভূত হয়েছেন। কেউ সাময়িকভাবে তাদের সৃষ্টির কাছে থেকেছেন, আবার বাড়তি-ঝড়তি আত্মার অসন্তোষে কেউ তার পরেও লিখে গেছেন। তবে সর্বজন গ্রহণীয় সত্তর দশকের লিখিয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কবিরা হলেন- সমুদ্র গুপ্ত, আবসার হাবীব, আবিদ আজাদ, আবিদ আনোয়ার, আবু করিম, আবু হাসান শাহরিয়ার, আশরাফ আহমদ, আশরাফ মীর, আসাদ মান্নান, আহমদ আজিজ, আকবাল আজিজ, কামাল চৌধুরী, খুরশীদ আনোয়ার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, জাহিদ হায়দার, ত্রিদিব দস্তিদার, দাউদ হায়দার, নিতাই সেন, ময়ুখ চৌধুরী, মাহবুব হাসান, মাহমুদ কামাল, মুজিবুল হক কবীর, মোস্তাফা মীর, মোহন রায়হান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শামসুল ফয়েজ, শামীম আজাদ, শাহাদাত বুলবুল, শিহাব সরকার, সুজাউদ্দিন কায়সার, সৈয়দ হায়দার, সোহরাব পাশা, স্বপন দত্ত, ফরিদ আহমদ দুলাল, হোসেন আজাদ, আসরাফুল মোসাদ্দেক, আশুতোষ ভৌমিক, জরিনা আখতার, জাফরুল আহসান, দুখু বাঙাল, দুলাল সরকার, নাসির আহমেদ, ফারুক মাহমুদ, বিমল গুহ, মতিন বৈরাগী, মনজুরুর রহমান, মাহবুব বারী, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং হাসান হাফিজ প্রমুখ। পৃষ্ঠা-২০



আশুতোষ বিশ্বাস তার ‘বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও অন্যান্য’ বইয়ে আলাদা প্রসঙ্গ হিসেবে ছয়জন বাংলাদেশি কবির মননভূমি বিশ্লেষণ করেছেন। সূচিপত্রে প্রদত্ত শিরোনামে কবিগণ সম্পর্কে লেখকের মনোভূমি ও সিদ্ধান্ত পরিস্ফুট।

শামসুর রাহমান সম্পর্কিত রচনা শুরু করেন অশ্রুকুমার সিকদারের বক্তব্য দিয়ে। সেখানে তিনি বলেছিলেন-


নাগরিক বৈদগ্ধ্যে সবচেয়ে আধুনিকতাবাদী শামসুর রাহমান, তিনিই সবচেয়ে বেশি প্রতীচ্য-প্রভাবিত। যেমন তিনি রোমান্টিক, তেমনই তাঁর কবিতায় আছে 'যন্ত্রণাসম্ভব আত্মানুসন্ধান'। পৃষ্ঠা- ৬২



শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক সচেতনার প্রতি লেখকের মনোযোগ বেশি। একাধিক সময়ের কবিতা বিশ্লেষণে তুলে আনেন কবির আধুনিক মানবতাবাদী রাজনৈতিক মননের স্বরূপ। এগারো পৃষ্ঠাব্যাপী আলোচনার উপসংহারে সিদ্ধান্ত টানেন এভাবে-


রাজনীতির অস্থির পরিবেশে শামসুর রাহমান স্তাবকতার পন্থা কখনই অনুসরণ করেননি। অকৃত্রিম হৃদয়বৃত্তি দিয়ে মানুষের পাশে থেকেছেন, মানবতার দ্বারে জাগ্রত তাঁর আত্ম-প্রদীপ অসহায় রাজনীতির পেষণে পিষ্ট মানুষের জন্য তাঁর এষণা তাদের পক্ষেই করে গেছে মস্তিষ্কের প্রজ্ঞাক্ষরণ। পৃষ্ঠা- ৭২



আল মাহমুদকে নিয়ে রচনাটি বেশ বড়। প্রায় উনিশ পৃষ্ঠাব্যাপী প্রবন্ধে 'সোনালি কাবিন' কাব্যে কবির অন্তর্ভাব মেলে ধরেছেন। চৌদ্দটি চতুর্দশপদী কবিতা সজ্জিত এই কাব্য বাংলা সাহিত্যের হৃদয়ে স্থায়ী ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তাই এই কাব্যের মর্মখনন আশুতোষ বিশ্বাসের প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি দেখেন যৌনতাড়িত কবির তরল ভাবাবেগ এই কাব্যের প্রধান বিষয়।

আদিম নগ্নতার উল্লসিত বিলাসে কবি বিশ্বাস ও নীতির সাথে আপোষ করতে ইচ্ছুক। শরীরি সংশ্লেষ লালসায় তিনি অনায়াসে সাংখ্যদর্শনের আশ্রয় নেন। নিজেকে মুক্তপুরুষ হিসেবে প্রেমবতী, কলাবতীর কোলে সমর্পণ করতে চান। কবির এই নাস্তিক্যবোধের কারণ হিসেবে তন্বিষ্ঠপাঠক ও সমালোচক ড. ফজলুল হক তুহিন একটি ব্যাখ্যা দেন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন-

মার্কসবাদী চেতনায় বিশ্বাসের ফলে কবি একদিকে ধর্মহীনতা, অন্যদিকে নারীপ্রেমের প্রসঙ্গে সামষ্টিক স্বার্থের জয়গান গেয়েছেন। পৃষ্ঠা- ৮১



গ্রন্থলেখক দীর্ঘ আলোচনায় কবির ভঙ্গুর বিশ্বাসবোধ, শক্তিশালী শিল্পবোধ, কামকাতরতা, অপ্রচল শব্দ ব্যবহারের সক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি ফেলেছেন। উপসংহারে তাই বলেন-


সাম্যবাদী রাজনীতি, প্রেমের অভিলাসে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি, অস্টাদশী নারী আর বাংলার নদীপারের দুই দিগন্তে সুবিস্তৃত পাকা ফসল-নারীরই প্রতিকল্প, এই বিকল্প থেকে পুরুষের অধরে লালসার কস সৃজন, বাংলা কবিতায় আল মাহমুদের স্বীয় প্রতিষ্ঠিত ঘরানা, প্রাচীন ইতিহাসের হৃদয়ে চোখ রেখে নিজেই রচনা করলেন নিজের ইতিহাস। পৃষ্ঠা- ৯২



শহীদ কাদরীকে নিয়ে রচনাটি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের। স্বল্প কয়েকটি পৃষ্ঠার বক্তব্যে কবি শহিদ কাদরীর কাব্যভাষার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। রচনার শেষে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন-


শহীদ কাদরী তাঁর সমস্ত চিন্তকের সামনে সব পথ খুলে দিয়ে নিজের রচিত পথে নিজেই এগিয়ে গেছেন- পেছনে যারা তাঁকে অনুসরণ করবেন তাদের জন্য দেবদারু কবিতার শান্ত সমাহিত অনন্ত পথভ্রমণের ইঙ্গিত দিয়ে যান। পৃষ্ঠা- ৯৬



অভিমানী কবি শহীদ কাদরীর পরে বিশ্লেষণ করেছেন বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী হুমায়ুন আজাদের কবিসত্ত্বাকে। প্রবন্ধ ও উপন্যাসের পাশাপাশি তার কবিতার সংখ্যা কম নয়। তার শিশুতোষ গদ্যগুলো কবিতার স্বাদে সিক্ত। প্রবন্ধ উপন্যাসের বাক্যভঙ্গিতেও কবিতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। প্রথাবিরোধী হুমায়ুন আজাদ কবিতাতেও সৃষ্টি করেছেন স্বতন্ত্র পথের মৌলিক ধারা।

নিজের কাব্যচেতনার আন্তপ্রেরণা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ কোন একটি সাক্ষাৎকারে খোলামেলা মন্তব্য করেছিলেন। তার বক্তব্য লেখক সযতনে তুলে ধরেন। যেখানে হুমায়ুন আজাদ বলেন-

তাদের সাথে আমার ভিন্নতা বিষয়ে, সৌন্দর্যের তীব্রতায় ও শিল্পকলাবোধে। আমার কবিতার স্টাইলে দেখতে হবে এর ভাষা ব্যবহার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, এর ছন্দ মানা ও না-মানা; এর কল্প-রূপক প্রতীক ও স্টাইলের অন্তর্ভুক্তি। পৃষ্ঠা- ১০২



 দীর্ঘ আলোচনা শেষে লেখক মন্তব্য করেন-


দ্বিধা নেই হুমায়ুন আজাদের সৃজিত অক্ষরেরা বেঁচে আছে, তাঁর নদী-গাছপালা বেঁচে আছে, তাঁর মনন সাহস চন্দ্ররেখা বেঁচে আছে, তারাই তার হয়ে কথা বলবে, তাঁর অপূর্ণতা একদিন পূর্ণতা পাবে। গতানুগতিক কবিবৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদ আধুনিক বাংলা কবিতায় যে নতুন প্রস্রবণ আনলেন সেই নিষ্যন্দ বাঙালি পাঠক শতাব্দীর পর শতাব্দী নিরবধি পান করে যাবেন। পৃষ্ঠা- ১১১-১১২



নতুন সহস্রাব্দের এক দশক পার করে কবিতাকাশে দেখা মেলে সৈয়দ সাখাওয়াৎ- এর। কবি সম্পর্কে লেখক ঘোষণা করেন-


কবি সৈয়দ সাখাওয়াৎ বিমূঢ় বিভ্রান্তির কবি নন- মূঢ় ম্লান মূক সময়ের কবি নন। তিনি কবি এই প্রযুক্তি সভ্যতার উড্ডীন, বিজ্ঞান আর যুক্তির তীব্র আলোক প্রস্ফুটিত ঝলমলে সময়ের চনমনে কবি। পৃষ্ঠা- ১১৪



নাতিদীর্ঘ রচনায় কবির তিনটি কাব্যকেই আলোচ্য করে তোলা হয়েছে। একাধিক কবিতার উল্লেখ করে বিশ্লেষণ করেছেন কবির মগ্নচৈতন্যের নানাবিধ রঙের খেলা। কবি যে নিজের কাব্যদর্শন সম্পর্কে প্রথম থেকে ভীষণভাবে ওয়াকিবহাল তা নির্ণয় করেন। পরিশেষে কবি সম্পর্কে তার নির্মোহ উপলব্ধি-


সৈয়দ সাখাওয়াৎ একজন আদ্যোপান্ত কবি। পেশা যাই হোক, প্রবল নেশার মতো কবিতাচর্চা তাঁকে সব সময় পেয়েই থাকে।… তাঁর কবিতায় ক্ষোভ আছে, তাঁর কবিতায় প্রতিবাদ আছে, তাঁর কবিতায় সোজাসাপটা বজ্রকঠিন ঝঙ্কার আছে- নেই কোন আপস। পৃষ্ঠা- ১২২



পনেরো পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ রচনায় আশুতোষ বিশ্বাস বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র তিস্তা ধরলা দুধকুমর নদীঘেরা জেলা কুড়িগ্রামে বাসকারী কবি সাম্য রাইয়ানের কবি মনোভূমির প্রতি আলোকপাত করেছেন। হৃদয়ের সকল উষ্ণতা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে তরুণতম এই কবির কাব্যসাগরে দিয়েছেন সচেতন সন্তরণ। নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকের কবি তিনি। আলোচক মনে করেন, সাম্য রাইয়ানের-


চেতনাদ্যুতি সময়কে উপচে আগামী সময়ের জন্য ফলদায়ী বর্ণিল ছায়াচিহ্ন রেখে যায়। পৃষ্ঠা- ১২৪



‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার মাধ্যমে মুদ্রণ জগতে কবির সচেতন যাত্রা শুরু হয়। প্রকাশিত প্রথম কবিতার নাম দেখে অনুমান করা যায় যে, এক মুক্ত স্বাধীন সমাজ ও সংস্কৃতি তার চির আরাধ্য। রচনা করেছেন সাতটি কাব্য। প্রতিটি কাব্যে ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। সময়ের বাঁকে বাঁকে নতুন আলোকরেখায় আলোকিত করেছেন নিজের শিল্পীসত্তাকে। বিষয়, ভাষা ও শৈলীতে বাংলা কাব্যধারায় সৃষ্টি করেছেন নতুন ও মুক্ত তরঙ্গ। আর সেজন্য আশুতোষ বিশ্বাস ঘোষণা করেন-


সাম্য রাইয়ান গতানুগতিক ধারা প্রবাহিত জলে আটকে থাকা প্রতিভা নিয়ে আসেননি, বরং যেখান থেকে সাধারণ অনেকেই ভাবনা বন্ধ করে দেন- সেখান থেকেই তাঁর ভাবনাপ্রক্ষালন শুরু। পৃষ্ঠা- ১২৬



২০২৩ সালে প্রকাশিত 'হালকা রোদের দুপুর' কাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে আলোচক কবির বিশিষ্টতা সম্পর্কে একটি সাহসী মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন-


 … এই সময়েই তার কবিতার ধারাবাহিক নিবিষ্ট কাব্যপাঠকের কাছে একটি 'সাম্য রাইয়ানীয়' উন্মুক্ত কবিতার হরিৎক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে বোঝা যায়। পাঠক যেন এত এত কবিদের ভিড়েও সাম্য রাইয়ানকে আলাদা করে চিনে নিতে পারছেন। এই চেনাটা অবশ্যই যে কোন কবির কাছে বড় শ্লাঘার, বড় আনন্দের। নিজস্ব কাব্যভাষা, ধ্বনিঝঙ্কার আর রূপকল্পের মুদ্রাগত ব্যবহারবিধিও কোন কোন ক্ষেত্রে সাম্য রাইয়ানকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করছে। পৃষ্ঠা- ১৩৬



নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সাম্য রাইয়ানকে আলোচ্য হিসেবে নির্বাচন করায় আশুতোষ বিশ্বাস পাকা জহুরীর পরিচয় দিয়েছেন। সত্তরের কবিদের আলোচনা করতে গিয়ে সমকালের তরুণতর কবিকে বিবেচনায় নিয়ে নিজের মানবিক ঔদার্য্য ও পরিণত বৌদ্ধিক চেতনার প্রতি সুবিচার করেছেন। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক নান্দনিক সৌকর্য বিচারে তার দক্ষতা প্রশংসনীয়। তিরিশ না পেরোনো সাম্য রাইয়ান প্রসঙ্গে তার অন্তিম বক্তব্যটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন-


সাম্য রাইয়ান দুহাত খুলে বুক চিতিয়ে লিখে চলেছেন, কাব্য মায়াপ্রপঞ্চের ফলভারী নোয়ানো মাথার ডালে ডালে হাসিফল, বিষাদফল, বাসনাফল উন্মেষ বেদনার অস্থির-প্রমত্ত প্রয়াস আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গননন্দিত প্রতিভাস আজ না হোক কাল পাঠকমুখে ঘুরে ঘুরে আসবে। পৃষ্ঠা- ১৩৭



আলোচ্য গ্রন্থের প্রতিটি রচনার শেষে তথ্যসূত্রের উল্লেখ আছে। লেখক নিজের প্রলম্বিত অবসর সময়ের আবর্তে উদ্ভূত চিন্তাবুদবুদ সাগরে প্রগলভ হননি। যথাযথ তথ্যের নিরিখে অনিবার্য যৌক্তিক উপাদান নির্বাচন করেছেন। ফলে তার সিদ্ধান্তে যেমন রয়েছে এক মানবিক আন্তরিকতা তেমন রয়েছে সুচারু সিদ্ধান্তের বাস্তবতা। বইয়ের শেষে একষট্টিটি গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ তালিকা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি অনুধাবনে আকর গ্রন্থগুলো গবেষক, কৌতুহলী পাঠক সকলের জন্য সহায়ক হবে। রয়েছে সহায়ক পত্র-পত্রিকার তালিকা। তন্নিষ্ঠ পাঠকদের সুবিধার্থে লোভনীয় গ্রন্থপঞ্জীটি গ্রন্থগত ওয়েবসাইটের 'পুনঃপাঠ' বিভাগে পুনঃপ্রকাশ করা যেতে পারে।

বোর্ড বাঁধাইয়ে প্রকাশিত বইটি বেশ শক্তপোক্ত। মুদ্রণ গাঢ় ও স্পষ্টতর। বইয়ের মলাট, প্রচ্ছদ, পৃষ্ঠার সুবিন্যাস দেখে প্রকাশকের আন্তরিকতা অনুভব করা যায়। ঢাকাস্থ ঘাসফুল প্রকাশনীর কর্ণধার মাহ্‌দী আনাম এই বই প্রকাশ করে আধুনিক বাংলা সাহিত্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে অশেষ উপকার করেছেন। ধন্যবাদের চেয়েও অধিক কিছু তার প্রাপ্য। নান্দনিক, মার্জিত প্রচ্ছদ করেছেন সাহাদাত হোসেন। একটি পরিশীলিত ধন্যবাদ তিনি পেতেই পারেন। কিছু দৃষ্টিকটু বানানবিচ্যুতিকে উপেক্ষা করে বইটিকে একটি সর্বাঙ্গসুন্দর প্রকাশনার সম্মান দেয়া যায়। ব্লার্বে প্রকাশিত একটি বাক্যে আলোচ্য বইয়ের চারিত্র্য সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে বলা হয়েছে-


এই গ্রন্থ আসলে ঢেউয়ের শীর্ষ থেকে এক পলকের জন্য কাব্যসমুদ্রের পেছনে ফিরে দেখা।



বাংলা সাহিত্য সমালোচনায় আশুতোষ বিশ্বাসের হাতে আরো ফুল ফুটুক। তার মননশীল প্রজ্ঞা মগ্ন পাঠককে আরও সমৃদ্ধ করবে- একথা দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করা যায়।



**********

বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবি ও অন্যান্য
আশুতোষ বিশ্বাস


প্রচ্ছদ: সাহাদাত হোসেন

প্রকাশনী: ঘাসফুল, ঢাকা
প্রকাশকাল ২০২৪,বইমেলা
পৃৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৪৪
মূল্য: ৪০০ টাকা
ISBN: 978-984-98968-1-4
__________


এই বই নিয়ে আরেকটি আলোচনা রয়েছে 'গ্রন্থগত' ওয়েবসাইটে। পড়ুন-

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ