'ছোটনদী' পত্রিকা, জুলাই ২০২৪ সংখ্যা সম্পর্কে আলোচনা: নুসরাত জাহান

'ছোটনদী' পত্রিকা, সংখ্যা জুলাই ২০২৪ সম্পর্কে আলোচনা: নুসরাত জাহান

বাঙালী সংস্কৃতির ছোটকাগজ 'ছোটনদী'। লেখক, শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক আবু হেনা মুস্তাফা'র সম্পাদনায় উলিপুর সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ছোট কাগজটি সম্প্রতি প্রকাশনার এক দশক পূর্ণ করলো। সে উপলক্ষে আলোচনাসভার আয়োজনে উপস্থিত থাকার থাকার সুবাদে লেখক এবং পাঠক সৃষ্টিতে 'ছোট নদী'র এ যাত্রার সফলতা অবলোকন করবার সুযোগ হয়েছিলো সেদিন। যাইহোক,  কিছুদিন আগে দশম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যাটি যখন হাতে পেলাম তখন এক অস্থির সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা। উৎকণ্ঠায় কাটানো সময়গুলোর ফাঁকে ফাঁকে পাতা ওল্টালেও সে অর্থে মনোনিবেশ করা হয়ে ওঠেনি। সদ্যগত হওয়া বিদ্যুৎবিহীন রাতে যখন পুনরায় চোখ বুলাচ্ছিলাম তখন মনে হলো সংখ্যাটি নিয়ে একটু বলা উচিত।

কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. মনজুরুল ইসলাম রচিত "লিটল ম্যাগাজিনের দায়" শিরোনামে খুব তথ্যসমৃদ্ধ একটি নিবন্ধ রয়েছে একদম শুরুতেই। নিবন্ধটিতে লিটলম্যাগ সম্পর্কে একদম সুবিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সাধারণত লিটলম্যাগগুলো সমাজে বহুল প্রচলিত ধারণার নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার প্রয়াসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।  ১৮৯০-১৯৫৩ সালে হয়ে আসা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে লেখকদের ভূমিকা এই লিটল ম্যাগাজিনের কল্যানেই নির্মিত। সেসময়কে উপস্থাপন করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, 

 

এই সময়ে ফ্রান্স, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মান লেখকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাহিত্য আন্দোলন গতিকে দুর্বার করেছিলো। এক্ষেত্রে প্রধান কারণটি ছিলো বাণিজ্যভিত্তিক জনপ্রিয় লেখার বিপরীতে গিয়ে সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনে উপযোগিতা ভিত্তিক লেখার প্রতি গুরত্ব প্রদান। লিটল রিভিউ, পোয়েট্টি, ইগোয়িস্ট এবং ব্লাস্ট এ প্রকাশিত আর্নেস্টন হেমিংওয়ে, টি এস এলিয়ট এবং জেমস জয়েস এর রচিত লেখাগুলিই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

 

ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী হবার সুবাদে এই সমস্ত লেখকদের সাথে পূর্বপরিচয় ছিলো। যার ফলে বিষয়গুলো রিলেট করে অনেক সহজ হয়েছে। এছাড়াও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত তিনটি প্রভাবশালী সাময়িকী, যথাক্রমে  — রবিনসন ক্রুসোর the Review (1704), রিচার্ড স্টিলির the Tatler (1709-1711) এবং জোসেফ এডিসন ও রিচার্ড স্টিলি প্রকাশিত the Spectator (1711-1712) এর কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি সাময়িক পত্রই তৎকালীন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনীতি, সমাজ জীবন ও সংস্কৃতিভিত্তিক লেখা প্রকাশ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশেষ করে ট্যাটলার এবং স্পেকটেটর এ নারীদের লেখার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়।

নিবন্ধটির শেষে সংযুক্ত রয়েছে সম্পাদকের সাক্ষাৎকার। যেখান থেকে আমার মনেও পুঞ্জীভূত হওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। কথায় কথায় উঠে এসেছে ইতিহাস চর্চা, প্রকাশনা এবং ছোট নদীর পথচলার নানাবিধ গল্প এবং অভিজ্ঞতার কথা। সূচীপত্র এবং লেখা সাজানোর প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "আমরা লেখাগুলোকে এলোমেলো ভাবে সাজাই -যাতে পুরো পত্রিকা খুঁজে লেখক তার নিজের লেখাটি বের করে পড়ে। এরফলে পুরো পত্রিকাটায় তার চোখ বুলানো হয়ে গেলো। সেজন্য আমরা সূচীপত্র রাখি না।" মানহীন লেখা ছাপানোর প্রসঙ্গেও রয়েছে চমৎকার ব্যাখ্যা।

বিশ শতকের সবচেয়ে আলোকিত ও আলোচিত ফরাসী দার্শনিক, জিল লুইস রেনে দল্যুজ (১৯২৫-১৯৯৫)। এক্লেক্টিসিজম বা বহুত্ববাদ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এই দার্শনিকের সম্পর্কে সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দারের লেখাটিও দারুণ তথ্যবহুল। ড. শহিদুল হাসানের "জঁ বাতিস্ত শোভালিয়ের বর্ণনায় ব্রহ্মপুত্র নদ" এবং সজীব কুমার বণিকের "অ্যানথ্রোপোসিন যুগে ইতিহাস দর্শন" কিছু অজানা অতীতের তথ্য যেমন জানায় তেমনি ইতিহাস জানবার তৃষ্ণাও বাড়ায় বহুগুণে। টিভি ব্যক্তিত্ব ও নাট্য আন্দোলনকর্মী পঙ্কজ বণিকের আত্মজৈবনিক "থিয়েটারওয়ালা" এবং ডাঃ এটিএম আব্দুর রাজ্জাক রচিত স্বাস্থ্যবিষয়ক "মাজা ব্যথার জানা-অজানা" ধারাবাহিক রচনা দুটির প্রথমটি যেমন ব্যক্তিজীবনের চমকপ্রদ সব অভিজ্ঞতা উন্মোচন করছে তেমনি দ্বিতীয়টি স্বাস্থ্যসচেতনা কিংবা বিষয়সংশ্লিষ্ট ধারণা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করছে। হরেশ্বর রায়ের "গুণীরা হারিয়ে যাচ্ছেন" কঙ্কন সরকারের পরিবেশ ভাবনা, সালমান আজাদের "উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কয়েকটি কথা", আবদুস সাত্তার ছোটনদী নিয়ে স্মৃতিচারণ মূলক লেখা, বিশেষ রচনা "সোনার বাংলার সোনার মানুষ", কোনটা রেখে কোনটার কথা বলবো!

বেশ কয়েকটি অণুগল্প সাদামাটা থিমে দুর্দান্ত মনে হয়েছে। যেমন — মোঃ জুলফিকার আলি সেনার "তৃতীয় নয়ন", আহম্মেদুল কবিরের " সমর্পন", আঁখিতারা আলমের "অ্যাডভেঞ্চার অফ ভিলেজ", আবদুস সালাম রচিত " "নাড়িপোঁতা", জোনাঈদ জীমের " সুখীনুর" ইত্যাদি। তরুণ লেখক দীপন কুমার রায় রচিত প্রেম-বিরহের রোমাঞ্চকর গল্পটিও বেশ লেগেছে। ফাঁকে ফাঁকে নবীন-প্রবীণ লেখকদের কবিতাগুলোও অসাধারণ ছিলো।  এরমধ্যে নাজিম রাসেলের "মা", মেহেদী হাসান মিলনের " গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম", ডাঃ রফিকুল ইসলামের "প্রলোভন", রাকিবুল হাসান গোলজার রচিত " চৈত্র-বৈশাখ", হাসান পলাশের "ভালোবাসাময়ী মা", আবু সাঈদ মোল্লার " বুদ্ধিজীবীর মগজ", মুকুল রাজের "দূরদৃষ্ট", অন্তর চন্দ্র এর দুটি কবিতা " স্যাড দ্যা ডেথ পাসওয়ার্ড" এবং "দ্যা লাস্ট পাসওয়ার্ড" উল্লেখযোগ্য। নাম উল্লেখ না করা কবিতাগুলোও বেশ। ফেইসবুকের কল্যাণে প্রণয় কৃষ্ণ রায়ের "রাজশ্রী নামা" -এর সাথে পূর্ব পরিচয় ছিলো। এ শিরোনামে বারোটি ক্ষুদ্র রচনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা থেকে প্রকাশিত বাঙালী সংস্কৃতির ছোটকাগজ "ছোটনদী" এর এ সংখ্যাটি বেশ সমৃদ্ধ বলে মনে হয়েছে। প্রান্তিক সাহিত্যের জাগরণে পত্রিকাটির নিরন্তর পথচলা অব্যহত থাক, এই প্রত্যাশা।

**********
ছোট নদী (বাঙালী সংস্কৃতির ছোটকাগজ)
দশম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা। জুলাই, ২০২৪খ্রীষ্টাব্দ। আষাঢ়, ১৪৩১বঙ্গাব্দ।
সম্পাদক: আবু হেনা মুস্তাফা
উৎপাদন ব্যায়: একশত টাকা
উলিপুর সাহিত্য পরিষদ, উলিপুর, কুড়িগ্রাম থেকে প্রকাশিত।


মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ