দার্শনিক লেখক জাহাঙ্গীর হোসেন বিরচিত 'কালের কল্পলোক ৩০২৪' নিঃসন্দেহে একটি বিস্ময়কর জ্ঞানগ্রন্থ। মাত্র ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি পড়ে শেষ করার পর একজন পাঠকের যে অর্জন হবে তা অনেকের জন্য সারাজীবন লেখাপড়া করেও হবে না বলে আমার মনে হয়েছে। একজন প্রথাসিদ্ধ পাঠক যদি বইটি পড়ে শেষ করে তাহলে হয় সে বদ্ধবুদ্ধি থেকে মুক্তবুদ্ধি চর্চার দিকে ৩৬০ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরে যাবে অথবা সে অস্ত্র হাতে লেখককে হত্যার জন্য ছুটে যাবে। এই বইটির কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম। ক্যান্সারে আক্রান্ত লেখক জাহাঙ্গীর হোসেন নিয়মিত ক্যামো ও রেডিও থেরাপি নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাচ্ছেন আর যুদ্ধ করে যাচ্ছেন বিশ্ব-সমাজের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দূর করে প্রগতিশীল মানব সমাজ গঠনের জন্য। সত্য সন্ধানে তিনি কোনোকিছুর সাথে আপোস করেন না। এই বইটি লেখার জন্য তিনি যে সৎসাহসের পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য সহস্রবার স্যালুট জানাই।
লেখার স্টাইল:
আজ ২০২৪ সাল থেকে ১০০০ বছর পরে একজন ঐতিহাসিক কথক প্রাচীন কাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস, প্রথা, মত, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, কুসংস্কার, বিশ্বাস, অবিশ্বাস ইত্যাদি সাবলীল ভাষায় তুলে ধরছেন।
কী আছে গ্রন্থটিতে:
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি বিস্ময়কর Adventurous Journey রয়েছে গ্রন্থটির বর্ণনার পথ ধরে।
প্রথম ভাগে রয়েছে ৩০২৪ সালের ডাইনামিক সভ্যতার সাথে ২০২৪ সালের ধীরগতিসম্পন্ন সভ্যতার তুলনা। ৩০২৪ সালে পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি হবে, তার তুলনায় ২০২৪ সালের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নস্যিতুল্য। ভাবুন আপনি বাংলাদেশ ৫০০ গ্রাম গরুর দুধ একটা চোঙের মধ্যে ঢেলে দিলেন আর সাথে সাথে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার কেউ একটা চোঙের মুখে গ্লাস পেতে একেবার খাঁটি দুধ পেয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালে এক সেকেন্ডে কোনো কাজ হয়ে যাওয়া ৩০২৪ সালের সভ্যতায় খুব ধীর গতির কাজ। তখন তারা কাজের গতি হিসেব করবেন ন্যানোসেকেন্ড বা ফ্রাকশন অফ ন্যানোসেকেন্ডে। তখন থাকবে আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ ও যোগাযোগ। কৃত্রিম সূর্যের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে একই তাপমাত্রা বিরাজ করবে। মানুষ ইচ্ছেমতো বাঁচতে পারবে, কিছুদিন বিশ্রাম মৃত্যুতে থেকে ইচ্ছে করলে আবার জন্ম নিতে পারবে। রোগ-ব্যাধি, অশান্তি, যুদ্ধবিগ্রহ থাকবে না; মানুষ জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে, দলে দলে ভাগ হয়ে কাটাকাটি করবে না; সব মানুষ হবে এক জাতের, এক ধর্মের।
দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে প্রথা, ধর্ম, বিশ্বাস, কুসংস্কার ইত্যাদির ইতিহাস। লেখক পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, সেমেটিক, আব্রাহামিক, সুমেরীয়, এশিরিও, ব্যাবিলনীয়, বৈদিক, আরবীয়সহ শত সভ্যতার ধর্ম, বিশ্বাস, কুসংস্কার, নৃশংসতা ইত্যাদি তুলে ধরেছেন সুনিপুণ তুলিতে। বালকের কলিজা বের করে পাহাড়ের চূড়ায় রেখে দেয়া যাতে তাদের ঈশ্বর সূর্য খুশি হয়ে আবার উদিত হয়; ধর্ম বিশ্বাসের কারণে মৃতের লাশ কেটে রান্না করে খাওয়া কিংবা লাশ টুকরো করে শকুন দিয়ে খাইয়ে মুক্তির আশা করা ইত্যাদিসহ অজস্র লোমহর্ষক তথ্য রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। ধর্মের ইতিহাসে পশুবলি, নরবলি, পাথর চুম্বন, লিঙ্গ পূজা, যোনি পূজাসহ অসংখ্য কুসংস্কার; মারামারি, হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট, দাসপ্রথা, ঈশ্বরপ্রতিনিধিদের সীমাহীন যৌনতা ইত্যাদি অত্যন্ত সাহসের সাথে তুলে ধরা হয়েছে যা জেনে ৩০২৪ সালের মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই অসাধারণ শ্রমসাধ্য অসাধারণ একটি কাজ উপহার দিয়েছেন দার্শনিক লেখক জাহাঙ্গীর হোসেন।
আমার ভালো লাগার কারণ:
এই ধারণা আমার মধ্যেও কাজ করেছে আগে থেকেই। আমি আমার কবিতা 'কে কে লক্ষ বছর বাঁচতে চান' এর মধ্যে বলেছি মানুষে তার দাঁত, নখ, হাড় ব্যাংকে জমা রাখতে পারেন। তাহলে একসময় বিজ্ঞানীরা আবার সেই মানুষকে তৈরি করতে পারবেন। এর সাথে লেখকের দর্শন মিলে যাওয়ায় আমি দারুণভাবে উপভোগ করেছি।
বইটির ফলাফল:
হতে পারে বইটির কিছু বিষয় সাইয়েন্স ফিকশনের মতো কাল্পনিক। কিন্তু পাঠককে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যেতে সমূহ ভূমিকা রাখবে। বইটি পড়ার আগে ও পরে পাঠক নিজেকে আলাদা মানুষ হিসাবে দেখতে পাবেন। পৃথিবীকে শান্তির স্বর্গ বানানোর বীজ বপন করা আছে বইটির ভেতরে।
বইটি সম্পাদনা করার জন্য জনাব আসিফ হাসান নবীকে ধন্যবাদ।
**********
কালের কল্পলোক ৩০২৪ সাল
জাহাঙ্গীর হোসেন
প্রচ্ছদ: নাবিলা মারজুক শান্তা
প্রকাশক: বইদূত, হুগলি, ভারত
প্রকাশকাল: ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৬০
মূল্য: ৪৫০টাকা (বাংলাদেশ), ৪০০ রুপি (ভারত)
ISBN: 978-93-92349-32-5
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম