"অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী" - আহমদ ছফার আত্মজৈবনিক প্রণয়োপাখ্যান। পৃথিবীতে মানব শিশু জন্মগ্রহণ করার পর প্রত্যেকের একটি নাম দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে সেই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে পুরো পৃথিবীর কাছে। যখন নাম রাখা হয় তখন নামের সাথে সম্পর্ক অনুভব করার বোধ থাকে না আমাদের। কিন্তু ওই নামটি মানবজীবনে পুরো পৃথিবীর সাথে যোগসূত্র তৈরি করে। এমনকি মৃত্যুর পরেও নামেই অস্তিত্ব টিকে থাকার সম্ভবনা থাকে। আহমদ ছফা তার প্রেয়সীর এই অতি পরিচিত নামকে ছুড়ে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন "ওই নাম তোমার জন্য একটি কারাগার স্বরূপ।" তিনি নিজের মত করে মানবীকে নির্মাণ করবার আকাঙ্ক্ষায় নতুন নাম দিতে গিয়েও নানাবিধ দ্বিধাদ্বন্দ্বে জর্জরিত হন। ঈশ্বরী নাম দিতে গিয়ে ভাবেন, তাহলে তো ঈশ্বরের সাথে প্রেয়সী জড়িয়ে যাবে। কিন্তু সে তো একান্ত নিজস্ব। যেখানে কারোর কোন অংশে নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত অপ্রকাশকে মূর্ত করে তোলবার সক্ষমতার কথা চিন্তা করে অবশেষে 'সোহিনী' নামে ধাতস্থ হন। সোহিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
তুমি আমার কাছে অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা। অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ। অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী।
কথায় কথায় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন,
এতোকাল স্মৃতি নিয়েই বেঁচে ছিলাম। তোমার স্পর্শে আমার সমস্ত সত্তা জেগে উঠেছে। কাদায় আটকানো হাতি যেমন ডাঙায় ওঠার জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করে, আমিও সেরকম স্মৃতির জলাভূমি থেকে ছুটে বেড়িয়ে আসার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি প্রাণপন। কাজটা সহজ নয় সোহিনী। একজন মানুষের শরীরে একটা হাত কিংবা পা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে অবশ হয়ে গেলে মানুষ যেমন স্বেচ্ছায় আপন হাতে সে অঙ্গটি কেটে বাদ দিতে পারে না, সে রকমই অতীতকে বর্তমানে টেনে তুলে তার জীর্ণ অংশ ছেঁটে ফেলাও একরকম অসম্ভব।
এরপর তিনি সোহিনীকে উদ্দেশ্য করে উত্তম পুরুষের জবানিতে খুলে বসেন অতীতের ডালা। নিজেকে জাহিদ হাসান পরিচয় দিয়ে শুরু করেন তার জীবনে আসা প্রথমে দুরদানা এবং পরে শামারোখ নামে দুজন নারীর গল্প। ধারণা করা হয় দুরদানা চরিত্রে উঠে এসেছে শামীম সিকদার। আর শামারোখ চরিত্রে বর্ণনা করা হয়েছে সুরাইয়া খানমের কথা। শেষের দিকে শাহরিয়ার চরিত্রে কবি আবুল হাসানের উপস্থিতিও রয়েছে এখানে। তবে যে সোহিনীকে উদ্দেশ্য করে এ প্রণয়োপাখ্যান রচিত হয়েছে, সেই সোহিনী পাঠক মহলে আজও অজানা। আহমদ ছফা সম্ভবত দ্বিতীয় খন্ডে সোহিনীকে ঘিরে তার আবর্তিত অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জীবন তাকে সে সময় দেয়নি। সোহিনী থেকে যায় পাঠকের কৌতুহলে।
সত্য কল্পকাহিনির চাইতে আশ্চর্যতরো। যে কাহিনির মূলে সত্যের স্পর্শ নেই, সে কাহিনী মূল্যহীন। সব মিলিয়ে আহমদ ছফার আত্মজৈবনিক উপন্যাস 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' একটি অসাধারণ প্রেমের উপন্যাস। বইটি থেকে পছন্দসই এবং মনে গেঁথে রাখার মত কিছু উল্লেখযোগ্য লাইন —
- কোনো কোনো মানুষের রাশিই এমন যে বিপদ তাদের প্রতি আপনিই আকৃষ্ট হয়। (পৃ.৫৬)
- নিজের স্বার্থের প্রশ্ন না থাকলে কেউ কারো জন্য সামান্য বাক্য ব্যয় করতেও কুণ্ঠিত হয়। (পৃ.৫৭)
- আমার ঘরের অবস্থা যতো করুণই হোক না কেনো আমি ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারবো না। যা আমার নয়, আমার বলে প্রদর্শন করতে পারবো না। (পৃ.৬০)
- আমরা তো মাটির পৃথিবীতে বাস করি। নিতান্ত অনিচ্ছায় হলেও দৈনন্দিন কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়। এটা-সেটা কতো কিছু করতে হয়। মানুষের সমাজে মানুষের মতো বাস করতে হলে কতো দায়-উপরোধ রক্ষা আর কর্তব্য-কর্ম করে যেতে হয়। (পৃ.৬৭)
- মানুষের যতো রকম ব্যাধি আছে তার অর্ধেক সামাজিক ব্যাধি। বিপ্লবী কর্মকাণ্ড হলো এ ধরনের রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের মোক্ষম ঔষধ। (পৃ.৯২)
- অনেক সময় মানুষ সত্য প্রকাশের ছলে, নিজের মনের প্রচ্ছন্ন ঈর্ষাটাই প্রকাশ করে। (পৃ.৯৯)
- মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন রাজা হওয়ার প্রস্তাবও অবহেলায় প্রত্যাখ্যান করতে হয়।(পৃ.১০৭)
- অতিরিক্ত পরিশ্রম, অতিরিক্ত দুঃখ প্রকাশের মতো অতিরিক্ত আনন্দও মানুষকে ক্লান্ত করে ফেলে।(পৃ.১১৯)
- জলন্ত আগুনে যে পোকারা ঝাঁপ দিয়ে মরে তাতে কি আগুনের অপরাধ আছে? কারণ পোকাদের ভাগ্যই আগুনে পুড়ে মরা। (পৃ.১২৭)
- একমাত্র সুন্দরের বাতাবরণের মধ্য দিয়ে মিথ্যেকে সত্যে রূপান্তরিত করা যায়। (পৃ.১৩০)
- জীবন শিল্প নয়, কবিতা নয়। জীবনে যা ঘটে শিল্প এবং কবিতায় তা ঘটে না। জীবন জীবনই। জীবনের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না এবং ভয়ানক নিষ্ঠুর। সমস্ত প্রতিশ্রুতি, সমস্ত প্রতিজ্ঞা, সমস্ত স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের ওপারে জীবনের লীলাখেলা। (পৃ.১৪৩)
**********
অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী
আহমদ ছফা
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশক: আহমেদ মাহমুদুল হক (মাওলা ব্রাদার্স)
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৬, অস্টম মুদ্রণ: মার্চ ২০২১
মুদ্রিত মূল্য: দুইশত টাকা মাত্র
পৃষ্ঠা: ১৪৪
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম