এ এক আশ্চর্য বই। সত্যেন সেনের ( ১৯০৭-১৯৮১) লেখা 'গ্রামবাংলার পথে পথে' পড়তে পড়তে চোখে জল আসে। যাদের আমরা ভুলে যেতে চেয়েছি, চারণের বেশে ঘুরে ঘুরে লেখক সেইসব আধিয়ার চাষি মজুরদের বুকের আগুনকে আবিষ্কার করেন।
প্রশ্ন তোলেন —
যাঁরা নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অংশ জনসাধারণের জন্য তিলে তিলে দান করে দিয়েছেন, গণ আন্দোলনের পথে যাঁরা আমাদের অফুরন্ত শক্তি ও প্রেরণার উৎস হতে পারেন, তাঁদের আমরা এমন করে হারিয়ে ফেলি কেন?
শুধু প্রশ্ন তোলেন না, কৃষক সংগঠনের কাজে ঘুরতে ঘুরতে কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলনের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সন্ধান করে চলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন রংপুর দিনাজপুর খুলনা যশোরের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে।
উপলব্ধি করেছেন :
দেশের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা একদিন মুক্তির সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন, এই সমস্ত হতভাগ্য আধিয়ার চাষিদের দুঃখ লাঞ্ছনা তাঁদের মনে কোনো দাগ কাটতে পারেনি। দেশের নেতারা যে সমস্ত দাবিদাওয়ার ফিরিস্তি দিতেন, এখানকার এই চিরবঞ্চিত নিঃস্ব মানুষগুলির বাঁচার দাবি তাদের মধ্যে স্থান পেত না।
ফসল কাটার পর জোতদারদের খোলানে তুলে, তার অর্ধেক আগে মিটিয়ে দিতে হত। জোতদার জমিদারের কর্মচারীদের হাতের কৌশলে অর্ধেকও পেত না চাষিরা। তারপর নানা বাহানায় আরো কিছু আত্মসাতের পর আসত ঋণ মেটানোর পালা। সে-ঋণ মৃত্যুর আগে শোধ হত না। জোতদারের দয়ায় যা-টুকু পেত তাই নিয়ে কদিন কোনোমতে সংসার চালিয়ে আবার হাত পাততে হত জোতদারের কাছে।
পণের টাকা জোগাড় করা যেত না বলে অনেক চাষির বিয়েই হত না, তেমন যুবকদের কথ্যভাষায় বলত 'ঢ্যানা'। ঢ্যানাদের ব্যর্থ জীবনকে নিয়ে রংপুর নীলফামারি অঞ্চলে অনেক গান রচিত হয়েছিল, সেগুলি 'ঢ্যানার গান' নামে পরিচিত। তেমনই একটি গান :
বাপাই রে বাপাই
না যাইস বিদেশে।
কোষ্টার উপর টাকা নিয়া
তোর বিয়াও চৈতমাসে।
কিন্তু কোষ্টা অর্থাৎ পাট বিক্রি করেও, যা পাওয়া যেত তা দিয়ে বিবাহ সম্ভব হত না।
মানুষ কতদিন আর সহ্য করে এসব!
জামসেদ আলী চাটি, তন্ননারায়ণ, স্পষ্টরাম, জয়মনি, কম্পরাম, জাল মোহাম্মদ, রূপনারায়ণ,কৃষ্ণদাস সামন্ত, লাঠিয়াল হীরালালদের মতো সাধারণ কৃষকদের নেতৃত্বেই একদিন আন্দোলন সংগঠিত হল। হাটের তোলা দেওয়ার বিরুদ্ধে, মেলায় তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সবশেষে তেভাগা আন্দোলনের জন্য কত কত নাম না-জানা চাষি শহিদ হয়েছেন সেদিন , আমরা তার খবর রাখিনি।
সেই অকথিত ইতিহাস তুলে এনেছেন সত্যেন সেন। এই আশ্চর্য বই পড়তে পড়তে আমাদের আরো একটি বইয়ের কথা মনে পড়বে — সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'আমার বাংলা'।
সত্যেন সেনের পরিচয় কী দেব! বাংলাদেশের অন্যতম ঔপন্যাসিক। জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় জেলেই কাটিয়েছেন। কৃষক সমিতির আর কমিউনিস্ট পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন।
'দৈনিক সংবাদ' পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলি একসঙ্গে নিয়ে ১৯৬৫ সালে প্রকাশ পায় 'গ্রামবাংলার পথে পথে'। এ বই আমাদের পড়তেই হবে।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম