বিন্দু - জ্যামিতিতে খুব পরিচিত এবং আবশ্যিক একটি টার্ম। সাধারণত যার দৈর্ঘ্য, প্রস্ত ও উচ্চতা অতি নগন্য কিন্তু অবস্থান সুনির্দিষ্ট তাকে বিন্দু বলে। কিন্তু সেই অতিপরিচিত গানিতিক হিসেব-নিকেষ নয়, এখন যে বিন্দু সম্পর্কে পাঠানুভূতি ব্যক্ত করছি তা সাহিত্য রসে পরিপূর্ণ, কুড়িগ্রাম বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত একটা লিটলম্যাগ যার নাম "বিন্দু"। অবস্থান সুনির্দিষ্ট হলেও নিরবে-নিভৃতে পরিব্যপ্ত হওয়া দৈঘ্য-প্রস্ত-উচ্চতায় এই বিন্দু'র পরিব্যপ্তিকে এখন সিন্ধু বলাই যায়। কয়েকদিন আগে সম্পাদক মারফত লিটলম্যাগটির ২৭তম সংখ্যা হাতে পেয়েছি। তুমুল ব্যস্ততা আর মানসিক অস্থিরতার ভেতরেও এর পাতা ওল্টানোর লোভ সামলানো সম্ভব হয়নি।
শুরুতেই বিন্দুস্বর শিরোনামে সম্পাদকীয় অংশটি এর ব্যতিক্রম এবং অবিচল পথচলার সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করে। সাহিত্যের অগ্রগতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব সম্পর্কে সম্পাদকের দুটি লাইন তুলে না ধরলেই নয়,
ইতিহাসে এমন সময় আসে, যখন এক বছরে দশ বছরের অগ্রগতি হয়, আবার এমন সময় আসে যখন দশ বছরেও এক বছরের অগ্রগতি সম্ভব হয় না। প্রথম প্রপঞ্চে চলছে বর্তমান। একথা কি ভুল বলা হবে? সময় সাক্ষ্য দেবে।
বাংলাদেশের লিটলম্যাগ মুভমেন্ট এবং বিন্দু'র -এই সুদীর্ঘ পথচলার আখ্যান উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন,
বিগত ১৭টি বছর ধরে যা করে চলেছি, তা সম্পাদনা না; আসলে লড়াই।
চলতি সংখ্যাটি সম্পর্কে অতিসংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়ে পাঠকের প্রতি কী দারুণ আমন্ত্রণ -
পাঠক, এইবার পাতা ওল্টান
পাতায় পাতায়
লেগে আছে কুয়াশা,
ওকে অনুভব করুন
এমন আমন্ত্রণে কি পাতা না উল্টে থাকা যায়?
শুরুতেই পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে 'শ্রুতি আন্দোলন' -এর তাত্ত্বিক, একাধারে কবি, অনুবাদক ও ফরাসি ভাষাবিদ পুষ্কর দাশগুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার। যে সাক্ষাৎকারটির গ্রহীতা ছিলেন প্রবীর রায়। চারজন লেখকের ছোটগল্প চারটি একেবারে ভিন্নতার স্বাদ আনয়ন করে। "ফুলের বিবাহ" শিরোনামে ব্রহ্মার বরে স্বয়ং সরস্বতী হবার গল্প লিখেছেন আদিবা নুসরাত। "করোটিতন্ত্র" শিরোনামে সৌমাল্য মুখোপাধ্যায়ের শক্তপোক্ত লেখাটিকে গল্প নাকি গদ্য বলে অবিহিত করা যায় - সেই দ্বিধা থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি। আইরিন সুলতানা রচিত "বেড়া" গল্পটি সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর পরিবর্তন এবং প্রকৃতির প্রতি মানবজাতির নিষ্ঠুরতাকেই নির্দেশ করে। তাসমীম দিশার "হাসনাহেনা" যেন একটি মিষ্টি প্রেমের চমৎকার গল্প।
লিটলম্যাগের চিরাচরিত অংশ হিসেবে একগুচ্ছ কবির একগুচ্ছ কবিতা পাঠ অন্যরকম তৃপ্তি দেয়। সংখ্যাটিতে কবিতা লিখেছেন তানজিম তামান্না, হাসনাত শোয়েব, ফেরদৌস লিপি, রাজিব দত্ত, শুভ্র সরকার, মাহফুজুর রহমান লিংকন, ইহিতা এরিন, দেশিক হাজরা, পাপড়ি গুহ নিয়োগী, শুভদীপ দে, অসীম নন্দন, অমিত মজুমদার এবং মোকলেছুর রহমান।
তানজিম তামান্নার -
ভেঙে পড়া ধ্বংসস্তুপের নিচে
একদিন মুছে যেতে পারে গোপন প্রণয়
প্রশ্বাস থেকে নিঃশ্বাসের দূরত্বে
বেদনাও তখন হেসে উঠতে পারে ঠাট্টারসে!
শুভ্র সরকারের -
মায়ার ভেতর লগ্ন বয়ে যায়
পথে ফিরে দেখি অতীতে যেন
সদাভ্রাম্যমাণ আশ্চর্য জীবন।
মাহফুজুর রহমান লিংকনের -
বিপ্লবের আলপনা হাতড়াতে হাতড়াতে মুঠোয় বন্দি সিঁদুর, সিঁথিতে লেগে গিয়ে উদ্যানে মানুষের কোলাহল!
ইহিতা এরিনের -
সক্রেটিস বললেন, নো দাইসেল্ফ
মহামতি শুনুন, একা না হলে নিজেকেও জানা যায় না।
কিংবা অসীম নন্দন রচিত "সিভি রেখে যান" কবিতাটি - এই লাইনগুলো পড়লে মোহাবিষ্ট না হয়ে পারা যায়!
সুবিমল মিশ্র স্মরণে আলাত এহ্সানের "দ্রোহের সমুজ্জ্বল অক্ষরে লেখা 'সুবিমল মিশ্র'"প্রবন্ধটিতে উঠে এসেছে সুবিমলের সাহিত্য ও হাসান আজিজুল হকের সাথে ঐতিহাসিক বিতর্ক প্রসঙ্গ। আর বিশেষ আয়োজন হিসেবে রয়েছে দুইটি ক্রোড়পত্র। 'কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র'র প্রতিষ্ঠাতা এবং লিটলম্যাগ সংরক্ষণের প্রয়াসের অন্যতম যোদ্ধা সন্দীপ দত্তকে নিয়ে "ছোট কাগজের বড় যোদ্ধা" শীর্ষক ক্রোড়পত্রটিতে লিখেছেন - আশুতোষ বিশ্বাস, সব্যসাচী মজুমদার, সুবীর সরকার, স্বাগতা বিশ্বাস ও সাম্য রাইয়ান।
"ছোট কাগজের বড় কবি" শীর্ষক ক্রোড়পত্রে কবি শাহেদ শাফায়াতের কবিতার অন্তর্ঘাত ও অন্তরালের কারুকে উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন - নাভিল মানদার, আহমেদ নকীব, ধীমান ব্রক্ষচারী, সুশান্ত বর্মন এবং হিম ঋতব্রত।
সবমিলিয়ে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ এ সংখ্যাটিকে বিন্দুতে সিন্ধু বললে খুব বেশি অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না।
**********
বিন্দু পত্রিকা
বর্ষ ১৮ । সংখ্যা ২৭ । ২০২৪
সম্পাদক: সাম্য রাইয়ান
প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত
বিনিময়: ১৩০ টাকা
কুড়িগ্রাম, বাঙলাদেশ থেকে প্রকাশিত
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম